ইকো-ইঞ্জিনিয়ারিং বা ইকোলজিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং হলো এমন একটি পদ্ধতি যেখানে প্রকৌশল প্রযুক্তি ও জীবপ্রযুক্তির সমন্বয় করে পোকা দমন, উদ্ভিদ ও প্রাণিক‚লের সংরক্ষণ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা যায়। ফলে উপকারী পোকামাকড়ের খাদ্য ও আশ্রয়ের উৎস বৃদ্ধি পায় এবং পরিবেশগত ভারসাম্যতা রক্ষা হয়।
রাইস ইকো-সিস্টেমে ধানক্ষেতের আইলে পুষ্পমধু উৎপাদনকারী বিভিন্ন শাক-সবজি, ফল ও ফুলের চাষ করে বিভিন্ন উপকারী পোকামাকড়ের আশ্রয় ও খাদ্যের উৎস তৈরি করার মাধ্যমে ক্ষতিকর পোকা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিকে ইকো-ইঞ্জিনিয়ারিং বলা হয়ে থাকে।
যেমন: গুাঁদা, কসমস, সবজি, ডাল ও তেলজাতীয় ফসল যেমন: শিম, মুগডাল, সূযর্মুখী ইত্যাদির ফুল বিভিন্ন উপকারী পোকামাকড়ের আশ্রয় ও খাদ্যের উৎস হিসেবে কাজ করে এবং বিভিন্ন ক্ষতিকর পোকা যেমন: বাদামি গাছফড়িং, সবুজ পাতাফড়িং, পাতামোড়ানো পোকা ও মাজরাপোকার পরজীবী ও পরভোজী উপকারী পোকাগুলো এসব ফুলের পুষ্পমধু খেয়ে বেঁচে থাকে এবং ক্ষতিকর পোকার প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণে রাখে ফলে বিষাক্ত কীটনাশকের ব্যবহার ছাড়াই ধান উৎপাদন করা সম্ভব হয় এবং এতে ধানের ফলনেরও কোনো ঘাটতি হয় না।
ধানের জমির আইলে ফুলের চাষ করে ক্ষতিকর পোকার প্রাকৃতিক শত্রæ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে কীটনাশক ছাড়াই বাংলাদেশে ধান উৎপাদন করা সম্ভব। ধানের জমির আইলে ফুলের চাষ করে পোকামাকড় দমনের এ পদ্ধতিই ইকো-ইঞ্জিনিয়ারিং নামে পরিচিত
রাইস ইকো-সিস্টেমে এর উপকারিতা
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কীটতত্ত¡ বিভাগের বিজ্ঞানীরা গত ২০১৪-১৫ বোরো মৌসুম থেকে ধানের প্রধান শত্রু পোকা দমনের জন্য ধানের জমিতে আইল ফসল হিসেবে গাঁদা, কসমস, ও সূযর্মুখী ফুলের চাষ করে ক্ষতিকর পোকা দমনে সাফল্য পেয়েছেন। বতর্মানে ধান উৎপাদন অনেকাংশে নিভর্র করে অতিরিক্ত মাত্রার কীটনাশক ব্যবহারের ওপর। যা পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বিকল্প পদ্ধতি দরকার। ব্রি গাজীপুরে ইকো-ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতির মাধ্যমে কীটনাশকের ব্যবহার ছাড়াই পোকা দমনে সফলতা পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ধানের জমির আইলে বাহারি রঙবেরঙের পুষ্পমধু (নেকটার) সমৃদ্ধ ফুল (যেমন- গাঁদা, কসমস, সূযর্মুখী, তিল, তিসি ইত্যাদি) চাষ করলে ধানের ক্ষতিকারক পোকার প্রাকৃতিক শত্রু যা বন্ধু পোকা নামে পরিচিত সেগুলো এসব ফুলে আশ্রয় নেয় এবং ফুলের পুষ্পমধু থেকে খাদ্য গ্রহণ করে দ্রুত বংশবিস্তার করে।
রয়েছে বাড়তি আয়ের সুযোগ
ইকো-ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতি থেকে কৃষকরা তাদের ধানের জমির পতিত আইলে লাগানো ফুল ও অন্যান্য ডাল ও তেলজাতীয় শস্য থেকে অতিরিক্ত বাড়তি আয়ও করতে পারবে। অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে উপকারী পোকামাকড়ের সংখ্যা প্রকৃতি থেকে কমে গেছে।
গবেষণায় আরও জানা যায়, ধানের চারা রোপণের পর ৩০-৪০ দিন জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ থেকে বিরত থাকলে উপকারী পোকামাকড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় যা পরে ক্ষতিকর পোকার ক্ষতির মাত্রা অথৈর্নতিক ক্ষতির দ্বারপ্রান্তের নিচে রাখে। এ অবস্থায় ধানের জমিতে ফুল চাষ করে বন্ধু পোকামাকড়কে আকৃষ্ট করা যায়।
ধানের আইলে চাষকৃত ফুলগাছে উপকারী পোকামাকড় আশ্রয় নেয় এবং খাদ্য গ্রহণ করে। এ অবস্থায় ক্ষতিকারক পোকামাকড় ধানের জমিতে আসামাত্র ফুলগাছে আশ্রয় নেওয়া উপকারী পোকামাকড় সহজেই বুঝতে পারে এবং ধান ক্ষেতে গিয়ে বিভিন্নভাবে (সরাসরি খেয়ে কিংবা তাদের ডিমের ওপর ডিম দিয়ে) তাদের ধ্বংস করে।
এভাবে কীটনাশক ছাড়াই ক্ষতিকর পোকার ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে ধান উৎপাদন করা যায়। উপকারী পোকা মাকড় বিভিন্নভাবে ক্ষতিকারক পোকাকে ধ্বংস করে। যেমন-পরজীবী পোকা, ট্রাইকোগ্রামা জহিরি (ঞৎরপযড়মৎধসসধ ুধযরৎর) ধানের পামরি পোকার ডিমের মধ্যে নিজের ডিম পেড়ে শতকরা ৮৭ ভাগ পামরি পোকার ডিমকে ধ্বংস করে
বিভিন্ন দেশে ইকো-ইঞ্জিনিয়ারিং গবেষণা
গত এক দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন-ভিয়েতনাম, চীন, ফিলিপাইন এই পদ্ধতিতে ধানের পোকামাকড় দমনে সফলতা পাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার চালসর্ স্টাটর্ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জিওফ গুর ৪ বছর এশিয়ার তিনটি দেশে (ভিয়েতনাম, চীন, ফিলিপাইন) এ পদ্ধতির ব্যবহার মাঠপযাের্য় ছড়িয়ে দিতে কাজ করেছেন। তার গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এই পদ্ধতিতে ধানের ক্ষতিকারক পোকা ৫০% দমন করে কীটনাশক প্রয়োগের মাত্রা ৭০% হ্রাস করা সম্ভব।
এ ছাড়া এ পদ্ধতি ব্যবহার করে ধানের ফলন ৭% বাড়ানো সম্ভব। এ পদ্ধতি ব্যবহার করলে মাটিতে বসবাসকারী (ডেট্রিভোরস) বিভিন্ন পোকার সংখ্যাও বৃদ্ধি পায় যা মাটির উবর্রতা শক্তি বাড়ায়। বাংলাদেশের ধানের জমি ছোট ছোট খাঁদে বিভক্ত থাকায় এই পদ্ধতির মাধ্যমে পোকা দমনে সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক বেশি।
কমাবে কীটনাশকের ব্যবহার
ব্রির গবেষণায় দেখা গেছে, কীটনাশক ব্যবহৃত ধানক্ষেতের তুলনায় ধানক্ষেতের চারপাশের আইলে ফুলগাছ লাগানো জমিতে উপকারী পোকামাকড় ও পরজীবীতার পরিমাণ বেশি দেখা যায়। চারবার কীটনাশক ব্যবহার করে ধান ক্ষেতে যে ফলন পাওয়া যায় ধানক্ষেতের চারপাশের আইলে ফুলগাছ লাগিয়ে একই রকম ফলন পাওয়া যায়।
সুতরাং ধান চাষিরা কীটনাশক ব্যবহার না করে ধান ক্ষেতের চারপাশের আইলে পুষ্পমধুযুক্ত ফুলগাছ (গাঁদা, কসমস) লাগিয়ে ধান চাষ করতে পারেন। এর ফলে কৃষকের উৎপাদন খরচও কমবে এবং কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পরিবেশও রক্ষা পাবে। পুষ্পমধুযুক্ত ফুলগাছ ছাড়াও বাণিজ্যিক ফুল সূযর্মুখীও ব্যবহার করা যেতে পারে।
এ ছাড়া ধান ক্ষেতের চারদিকের আইলে তিল, লতানো শিম ও মুগ ডালের মতো শস্য চাষ করে একদিকে যেমন শস্যের বৈচিত্র্যতা বাড়িয়ে উপকারী পোকামাকড় সংরক্ষণ করা যায় এবং অন্যদিকে কিছু বাড়তি আয়ও করা সম্ভব। তবে এই পদ্ধতি ব্যাপকভাবে মাঠপযাের্য় কৃষকের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া এবং কৃষককে কীটনাশকের ব্যবহার থেকে বিরত রাখাইয়ের সফলতার প্রধান চ্যালেঞ্জ।
ফার্মসএন্ডফার্মার/১৬সেপ্টেম্বর২০