ফাউল টাইফয়েড রোগ
ফাউল টাইফয়েড রোগ গৃহপালিত যে কোন পাখির সেপ্টিসেমিক রোগ। এ রোগ তীব্র ও ক্রোনিক উভয় ধরণের হয়। ফাউল টাইফয়েড রোগে পাখির মৃত্যুর হার জীবাণুর ভিরুলেন্সের উপর নির্ভর করে।
প্রাথমিকভাবে পাখির ফাউল টাইফয়েড রোগ মুরগি ও টার্কিতে সনাক্ত করা হয়। পরবর্তীতে হাঁস,কবুতর,ময়ূর,তিতির ও ফ্যাজেন্ট সহ অন্যান্য পাখির দেহেও সনাক্ত হয়।
এ রোগের কারণ হলো সালমোনেলা গ্যালিনেরাম নামক ব্যাকটেরিয়া। এ রোগের বিস্তার পৃথিবীর সর্বত্রই।
সুপ্তিকাল
স্বাভাবিক অবস্থায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব বাচ্চা মুরগি/বাচ্চা টার্কি এবং পূর্ণ বয়স্ক মুরগি ও টার্কিতেও প্রায় সমান।সাধারণত এ রোগের সুপ্তিকাল ৪ – ৫ দিন।
রোগের লক্ষণ
যদিও এ রোগ পূর্ণ বয়স্ক মুরগি ও টার্কিতে আক্রান্তের প্রবণতা বেশি। কিন্তু বাচ্চা মুরগি ও বাচ্চা টার্কিও এ রোগে সংক্রামিত হয়। কারণ এ রোগের জীবাণু ডিমের মাধ্যমে বাচ্চা মুরগি ও টার্কিতে ছড়ায় ।ফাউল টাইফয়েড রোগে বাচ্চা মুরগি ও বাচ্চা টার্কি আক্রান্ত হলে এ রোগের লক্ষণ সমূহও সালমোনেলা পুলোরাম রোগের মতোই।
বাচ্চা মুরগি ও বাচ্চা টার্কির ক্ষেত্রে,আক্রান্ত ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার পরেই ট্রেতে মারা যায়। এমনকি আক্রান্ত বাচ্চার মাধ্যমে এ রোগ ভালো বাচ্চাতেও সংক্রামিত হয়। এ রোগে আক্রান্ত বাচ্চা দেখতে নিদ্রালুভাব (somnolence) ,ধীরে বেড়ে ওঠা (poor growth) দুর্বল,খাদ্য গ্রহণে অনীহাভাব,বাচ্চার পায়ুপথের চারপাশে সাদাটে বিষ্ঠার প্রলেপ ,কষ্টদায়ক শ্বাস নেওয়া অথবা শ্বাসকষ্ট এ রোগের অন্যতম লক্ষণ।
বাড়ন্ত ও বয়োপ্রাপ্ত পাখির ক্ষেত্রে
ক) মুরগি
তীব্র প্রকৃতির আক্রান্ত হলে মুরগির হঠাৎ করে খাদ্য গ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়। পাতলা সাদাটে পায়খানা করে,পালক ঝুলে পরে,মাথা ও ঝুটি ফ্যাকাসে হয়ে যায়,ঝুটি কুঁচকে যায়,দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়,আক্রান্তের ৪দিন পরে মারা যায়। তবে আক্রান্ত মুরগি কোন কোন সময় ৫ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
খ) টার্কি
আক্রান্ত টার্কির পিপাসা বেড়ে যেতে পারে। খাদ্য গ্রহণে অনীহা সহ সর্বক্ষেত্রেই অনীহা ভাব। অসুস্থ টার্কি সুস্থ টার্কি থেকে আলাদা থাকার প্রবণতা থাকে দেখা যায়,পায়খানা সবুজ থেকে হলদেটে সবুজ ডায়রিয়া থাকতে পারে। অসুস্থ টার্কির দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে ৪৪ থেকে ৪৫৹সে. হবে।
আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার
মুরগি ও টার্কির ক্ষেত্রে আক্রান্তের হার ও মৃত্যুর হারে তারতম্য হতে পারে। ফাউল টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত মুরগির মৃত্যুর হার ১০থেকে ৫০% কিংবা তারো বেশি হতে পারে।
তবে টার্কির ক্ষেত্রে এ রোগে আক্রান্ত টার্কির মৃত্যুর হার মুরগির মৃত্যুর হারের চেয়ে বেশি হতে পারে।এ রোগে আক্রান্ত টার্কির মৃত্যুর হার গড়ে ২৬.৫% হয়ে থাকে।
পোস্টমর্টেম পরীক্ষা
মুরগির ক্ষেত্রে, অতি তীব্র প্রকৃতির আক্রান্ত হলে মুরগির যকৃত,প্লিহা ও কিডনি লালচে (congested) ও আকারে বড় হবে। এ লক্ষণ সমূহ বাড়ন্ত মুরগির ক্ষেত্রেও থাকতে পারে।
সাব একিউইট ও ক্রোনিক অবস্থায় যকৃতের রঙ বাদামি সবুজাভাব অথবা ব্রোঞ্জ রঙের এবং আকরে বড় হতে পারে। যকৃতে মিলিয়ারি টাইপের সাদাটে ধূসর রঙের ফোকাই থাকবে। পেরিকার্ডাইটিস,পেরিটোনাইটিস ও ফেটে যাওয়া ওভা দেখা যাবে। ওভার ব্রোঞ্জ রঙের হতে পারে। ইনটেস্টাইনে ক্যাটারেল ইনফ্ল্যামেশন থাকবে।
বাড়ন্ত বাচ্চা মুরগির ক্ষেত্রে, ফুসফুস,হৃদপিণ্ড ও গিজার্ডে সাদাটে ধূসর বর্ণের ফোকাই থাকবে।
টার্কির ক্ষেত্রে
লক্ষণ সমূহ প্রায় মুরগির রক্ষণের মতোই হবে। তবে বুকের মাংসপেশী দেখতে কালচে অর্থাৎ অর্ধসিদ্ধ মাংসের ন্যায় হবে। হৃদপিণ্ডে ছোট ধূসর বর্ণের নেক্রোটিক ফোকাই অথবা পেটিকি থাকতে পারে। যকৃত আকারে বড় ও ভঙ্গুর হবে। যকৃতের রঙ ব্রোঞ্জ থেকে মেহগনি রঙের হবে।
টার্কির ক্রোপে খাদ্য জমা থাকবে। প্রোভেন্ট্রিকুলাসের মিউকাস মেমব্রেন ছিড়ে যাবে। গিজার্ডে খাদ্য জমা থাকবে তবে গিজার্ডের ওয়াল সহজে ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। ডুয়োডেনামে ক্ষতের সৃষ্টি হবে। এ ক্ষত সিকা পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে।
চিকিৎসা
এ রোগের চিকিৎসায় বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এন্টিবায়োটিক রয়েছে। এক এক জন প্রাকটিশনার এক এক ধরণের এন্টিবায়োটিক পছন্দ করে থাকেন। তাই এ রোগের চিকিৎসার জন্য ভালো প্রাকটিশনারের স্মরাপন্ন হওয়াই শ্রেয়। তবে এ রোগের চিকিৎসায় সালফোনেমাইড,অক্সিটেট্রাসাইক্লিন,ক্লোরটেট্রাসাইক্লিন,ফ্লুমিকুইন,এনরোফ্লোক্সাসিন ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা
উন্নত অনেক দেশেই এ রোগ প্রতিরোধে কোন ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয় না। তবে আমাদের দেশে সালমোনেলা রোগের ভ্যাকসিন পাওয়া যায়। উন্নত দেশগুলোতে এ রোগকে সমূলে ধ্বংস বা মুলোৎপাটন করা হয়। খামারে সালমোনেলা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে খামারের টার্কি ও মুরগি ধ্বংস করে দেয়া হয়।
ফাউল টাইফয়েড ও পুলোরাম রোগ প্রতিরোধের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে
ফাউল টাইফয়েড রোগ ও সালমোনেলা পুলোরাম রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ভালো খামার ব্যবস্থাপনার উপর বেশি গুরুত্বারোপ করা উচিত।
কারণ প্রাথমিকভাবে পোলট্রি ও টার্কিই ফাউল টাইফয়েড ও সালমোনেলা পুলোরাম রোগের আঁধার হিসেবে কাজ করে। তবে মুক্তভাবে চলাফেরা করে এমন সব পাখি ও অন্যান্য বন্য পাখি এ রোগ বিস্তারের জন্য মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ফাউল টাইফয়েড ও সালমোনেলা পুলোরাম সম্পূর্ণভাবে মুলোৎপাটন করতে হলে সালমোনেলা মুক্ত ব্রিডার্স ফার্ম গড়ে তুলতে হবে। তাই ব্রিডার ফার্মের চারপাশে ৫ কিমি সীমা পর্যন্ত কোন বাণিজ্যক পোলট্রি ও টার্কি খামার স্থাপন করা যাবে না।
সুস্থ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফাউল টাইফয়েড রোগ ও সালমোনেলা পুলোরাম সহ অন্যান্য রোগ জীবাণু নিয়ন্ত্রণে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ সমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে –
১। মুরগি বাচ্চা ও টার্কি বাচ্চা পুলোরাম ও ফাউল টাইফয়েড মুক্ত ব্রিডার ফার্ম থেকে সংগ্রহ করতে হবে।
২। পোলট্রি ও টার্কি খামারকে পুলোরাম ও টাইফয়েড রোগ জীবাণু মুক্ত করে নিতে হবে। এ লক্ষ্যে খামারকে ভালোভাবে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে ও গুণগত মানের জীবাণু নাশক দ্বারা স্প্রে করে নিতে হবে ।পরবর্তী ধাপে ফিউমিগেশন করতে হবে।
৩। নতুন বাচ্চাকে পুলোরাম ও ফাউল টাইফয়েড মুক্ত গুণগত মানের রেডি খাবার সরবরাহ করতে হবে।
৪। বাহির থেকে যাতে পোলট্রি ও টার্কি শেডের অভ্যন্তরে সালমোনেলা জীবাণু প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে —
ক) মুক্তভাবে চলাফেরা করে এমন সব পাখি সালমোনেলা জীবাণু বহন করে।
তাই এসব পাখির বিচরণ খামারের অভ্যন্তরে কোনভাবেই কাম্য নয়। এক কথায় বলতে গেলে খামারকে অবশ্যই ‘বার্ডস প্রুফ হতে হবে।
খ) ধেড়ে ইঁদুর,নেংটি ইঁদুর, খরগোশ সালমোনেলার বাহক হিসেবে কাজ করে। তাই পোলট্রি ও টার্কি খামারকে এগুলো থেকে মুক্ত রাখতে হবে।
গ) বিভিন্ন কীটপতঙ্গ বিশেষ করে মাছি,উকুন,মাইট,মিলওয়ার্ম থেকে পোলট্রি ও টার্কি খামারকে মুক্ত রাখতে হবে।
ঘ) কুকুর,বিড়াল,শেয়াল ও খরগোশকে খামারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না।
ঙ) পোলট্রি ও টার্কি খামারে সর্বদা বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে। প্রয়োজনে পানিতে ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পানিতে ১থেকে ৩ গ্রাম ব্লিচিং পাউডার প্রতি ১০০ লিটার পানিতে মিশিয়ে এক ঘণ্টা পর ব্যবহার করতে হবে। তবে পোলট্রি ও টার্কিকে ওরালি ভ্যাকসিন প্রয়োগ করলে সে ক্ষেত্রে খাবার পানিতে ব্লিচিং পাউডার ভ্যাকসিন প্রয়োগের একদিন পূর্ব থেকে ভ্যাকসিন প্রয়োগের দিন ও ভ্যাকসিন প্রয়োগের পরের দিন পর্যন্ত মোট তিন দিন ব্যবহার করা যাবে না। এমনকি কোনো রকম জীবাণু নাশক স্প্রে করাও যাবে না ।
চ) খামারে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা সহ পড়নের ময়লাযুক্ত কাপড়,ছেঁড়া ফাটা জুতো বা স্যান্ডেল পরিধান করে খামারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। নিয়মানুযায়ী খামারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে হলে প্রতিনিয়ত ধৌত ও ক্যালেন্ডার করা কাপড় এবং পালিশ করা জুতো
ব্যবহার করে খামারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যাবে। এছাড়াও খামারে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ,ডিমের ট্রে,খাদ্য ও পানির পাত্র,খাদ্য ও ডিম পরিবহনের গাড়ি ,ভ্যান,রিক্সা ইত্যাদি খামারের অভ্যন্তরে স্প্রে না করে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। সাধারণ মানুষের প্রবেশ সীমিত করতে হবে। তবে তা অবশ্যই স্প্রে করার পর।
ছ) ফাউল টাইফয়েড রোগ ও সালমোনেলা পুলোরাম নিয়ন্ত্রণে খামারের মৃত টার্কি বা মুরগি অবশ্যই মাটির নিচে গর্ত করে পুঁতে রাখতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে মাটির গর্তে পুঁতে রাখা মৃত টার্কি ও মুরগি কোনভাবেই কুকুর কিংবা শেয়াল গর্ত থেকে বের করতে না পারে। মৃত টার্কি ও মুরগি গর্তে পুঁতে রাখার সময় ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করতে হবে। সুযোগ থাকলে মৃত টার্কি ও মুরগি পুড়ে ফেলতে হবে। তবে সালমোনেলা নির্মূলে মৃত টার্কি ও মুরগি পুড়ে ফেলাই উত্তম কাজ। কারণ সালমোনেলা গ্যালিনেরাম জীবাণু মৃত টার্কি ও মুরগির দেহে এক সপ্তাহ পর্যন্ত সক্রিয় থাকে;যা পূণরায় মৃত টার্কি ও মুরগি থেকে সুস্থ টার্কি ও মুরগি খামারে ছড়িয়ে যেতে পারে। তবে তা নির্ভর করবে পরিবেশের তাপমাত্রার উপর।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২৪আগস্ট২০