পোলট্রি খামারে রোগ বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণের উপায়

492

পোলট্রি খামারে রোগের সংক্রমণ বা বিস্তার নানাভাবেই হয়ে থাকে। এক শেড থেকে অন্য শেডে,এক খামার থেকে অন্য খামারে এমনকি এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় রোগের বিস্তার ঘটে থাকে। খামারে খামারে রোগের বিস্তারে পোলট্রি খামারি কিংবা পোলট্রি খামার পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট সকলেই সমান ভাবে দায়ী। পোলট্রি খামারে কিছু কিছু রোগ আছে সংক্রামক,কিছু আছে ত্রুটিপূর্ণ ব্যাবস্থাপনা জনিত আর কিছু রোগ আছে অপুষ্টিজনিত যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পোলট্রি শিল্পের বিকাশে হুমকি স্বরূপ। পোলট্রি খামারে রোগের বিস্তার পদ্ধতিসমূহ নিম্নে সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরা হলো যাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পোলট্রি খামারিদের সচেতনতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়।

১।ডিমের মাধ্যমে বিস্তার
এই জাতীয় রোগের বিস্তারকে Trans Ovarian disease-ও বলা হয়। যা ডিমের ভ্রুনের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে। এগুলো হলো নিম্নরূপ—-
ক) সালমোনেলোসিস
খ)মাইকোপ্লাজমোসিস
গ)এভিয়ান লিউকোসিস
ঘ)ইনফেকশাস ব্রংকাইটিস
ঙ)এভিয়ান এনসেফালোমাইয়েলাইটিস
চ)এভিয়ান এডিনোভাইরাস ইনফেকশন (IBH,EDS-76)
ছ)এভিয়ান রিও ভাইরাস ইনফেকশন
জ)ফাউল টাইফয়েড
ঝ)রাণীক্ষেত রোগ

উল্লিখিত রোগ সমূহের বিস্তার প্রতিরোধে ব্রিডার্স ফার্ম ও হ্যাচারি মালিকদের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

২।হ্যাচারি বাহিত সংক্রমণ

একই ছিদ্রপথে বিষ্ঠা ও প্রস্রাব ত্যাগের পাশাপাশি মুরগি ডিমও পারে। ঠিক একই সময় ডিমের খোসা কিছু জীবাণু দ্বারা সংক্রামিত হয়। এমনকি ডিম লিটারের সংস্পর্শে এসে অপরিস্কৃত ডিম পরবর্তীতে হ্যাচারির যন্ত্রপাতি সমূহকে দূষিত করে।আর এটিই হল হ্যাচারি বাহিত রোগ। এই রোগ জীবাণু সমূহ নিম্নরূপ —
ক)স্ট্যাফাইলোকক্কোসিস
খ)স্ট্রেপটোকক্কোসিস
গ)এসকারেসিয়া কোলি ইনফেকশন
ঘ)প্রোটিওসিস
ঙ)সালমোনেলোসিস
চ)এসপারজিলোসিস
ছ)ক্যানডিডিয়াসিস
জ)কলস্ট্রিডিয়াল ইনফেকশন

এ সমস্ত জীবাণুর বিস্তৃতি হ্যাচারির যথাযথ নকশা,ব্রিডিং ফ্লকের উন্নত ব্যাবস্থাপনা,হ্যাচারি ব্যাবস্থাপনা এবং হ্যাচিং এর জন্য উপযুক্ত ডিম বাছাই,ডিম সংরক্ষণ ইত্যাদি যথোপযুক্তভাবে করতে হবে।
৩।হ্যাচারি থেকে ফার্মে জীবাণুর বিস্তৃতি:-
কিছু কিছু জীবাণু আছে যা দ্রুতই হ্যাচারি থেকে খামারে বিস্তার লাভ করে। এগুলো হলো নিম্নরূপ —
ক)ব্রুডার নিউমোনিয়া
খ)অমফ্যালাইটিস
গ)স্ট্যাফাইলোকক্কোসিস
এ সমস্ত জীবাণুর বিস্তৃতি ঠেকাতে হ্যাচারি পর্যায়ে হ্যাচারি মালিকদের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

৪।পোলট্রি খামার স্থায়ীভাবে সংক্রমণ হওয়া:-
কিছু কিছু জীবাণু আছে যা উড়ে এসে জুড়ে বসে। বিশেষ করে কিছু পুরাতন পোলট্রি খামার এবং দুর্বল ব্যাবস্থাপনাযুক্ত খামারে কিছু কিছু রোগ জীবাণু স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তুলে। ঐ সমস্ত পোলট্রি খামারে নতুন বাচ্চা মুরগি খুবই জীবনের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে এবং জীবাণু দ্বারা সহজেই সংক্রামিত হয়ে থাকে। এসব জীবাণুর মধ্যে —
ক)গামবোরো রোগ
খ)সালমোনেলোসিস
গ)মারেক’স ডিজিজ (MD)
ঘ)স্ট্যাফাইলোকক্কোসিস
ঙ)ই .কোলি ইনফেকশন
চ)কক্সিডিওসিস

এ সমস্ত রোগ জীবাণু প্রতিরোধে উপযুক্ত জীবাণু নাশক প্রয়োগের মাধ্যমে পোলট্রি খামার জীবাণু মুক্তকরণ করতে হবে।

৫।বায়ু বাহিত রোগ

কিছু কিছু জীবাণু মুরগির শ্বাসতন্ত্রের প্রতি খুবই সংবেদনশীল। এ সমস্ত জীবাণু আক্রান্ত মুরগির শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে খামারের অন্য মুরগিতেও সংক্রামিত হয়। বিশেষ করে খামারের মুরগি কোন প্রকার ধকলে আক্রান্ত হলে এ সময় সুস্থ্য মুরগিও শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হয়। এসব জীবাণুর মধ্যে —
ক)মাইকোপ্লাজমোসিস
খ)ল্যারিংগোট্রাকিআইটিস
গ)রাণীক্ষেত রোগ
ঘ)ইনফেকশাস ব্রংকাইটিস
ঙ)এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা

৬।বয়স্ক মোরগ মুরগি রোগের বাহক হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে : –
কিছু কিছু জীবাণু দ্বারা খামারের মুরগি আক্রান্ত হওয়ার পর মুরগি পূণরায় সুস্থ হলেও পরবর্তীতে যে কোন সময় বয়স্ক মুরগি রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। অধিকাংশ সুস্থ সবল মুরগির পরিপাকতন্ত্র স্বাভাবিকভাবেই অনেক রোগ জীবাণুর আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। যা যে কোন ধকলের পরবর্তী সময়ে রোগ বিস্তারে কাজ করে। এই সকল মুরগি সুস্থ মুরগির সংস্পর্শে এলে সুস্থ মুরগিও পরবর্তীতে আক্রান্ত হয়। কিছু কিছু জীবাণু আছে যা বয়স্ক মুরগির শরীরে আশ্রয় নেয়। এসব জীবাণুর মধ্যে —
ক) মাইকোপ্লাজমোসিস
খ)ফাউল টাইফয়েড
গ)ইনফেকশাস কোরাইজা
ঘ)সালমোনেলোসিস
ঙ)ইনফেকশাস ব্রংকাইটিস
চ)ইনফেকশাস ল্যারিংগোট্রাকিআইটিস
ছ)রাণীক্ষেত রোগ
জ)মাইট,লাইস,টিক ইত্যাদি।

এ জাতীয় রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পেতে হলে অল্প বয়স্ক মুরগিকে পূর্ণবয়স্ক মুরগির সংস্পর্শে আসতে দেয়া যাবে না। এজন্য পূর্ণবয়স্ক মুরগি সর্বদা অল্প বয়স্ক মুরগি থেকে আলাদাভাবে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

৭।মেকানিক্যাল ক্যারিয়ার

অনেক জীবাণু আছে যা খামারির মনের অজান্তেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বিস্তৃতি লাভ করে। বিশেষ করে শ্বাসতন্ত্রের রোগ ,বহিঃপরজীবি এমনকি কিছু ছোঁয়াচে রোগ। যেমন –
ক) রাণীক্ষেত রোগ
খ)গামবোরো রোগ
গ)এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা
ঘ)ফাউল পক্স ইত্যাদি।

খামারে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি বিশেষ করে ডিম ও খাদ্য পরিবহনের গাড়ি,ডিম ও ডিমের ট্রে পরিবহনের গাড়ি,ভ্যান ,খাঁচা ইত্যাদি। এছাড়াও পোলট্রি খামারে কর্তব্যরত কর্মচারী,ম্যানেজার,খামার পরিদর্শক,কনসালট্যান্ট,সরকারি কর্মকর্তা ইত্যাদির মাধ্যমেও রোগ জীবাণু এক খামার থেকে অন্য খামারে ছড়াতে পারে।

অন্যান্য কারণের মধ্যে কুকুর,বিড়াল,ইঁদুর,শেয়াল,টিকটিকি,মশা,মাছি,শকুন বন্য পাখি বিশেষ করে যারা মৃত মুরগি ভক্ষণ করে তাদের মাধ্যমে খামারের রোগ জীবাণু এক খামার থেকে অন্য খামারে বিস্তৃতি লাভ করতে পারে। এছাড়াও দূষিত খাদ্য ও পানির মাধ্যমেও রোগ জীবাণু এক খামার থেকে অন্য খামারে ছড়াতে পারে। দূষিত খাদ্য বিশেষ করে ছত্রাক যেমন- আফলাটক্সিন,ওকরাটক্সিন,T 2 টক্সিন ইত্যাদি। ফিসমিল কোন কোন সময় সালমোনেলার জীবাণু বহন করতে পারে। পানির মাধ্যমে বিশেষ করে ই.কোলিই,হিমোফিলাস প্যারাগেলিনেরাম,পাসচুরেলা ইত্যাদি রোগ জীবাণুর বিস্তার ঘটে।

ফার্মসএন্ডফার্মার/ ০২ অক্টোবর ২০২১