পোলট্রি বর্জ্য অপসারণ

1130

পোলট্রি বর্জ্য অপসারণ

পোলট্রি বর্জ্য অপসারণ খামারিদের কাছে সাধারণত একটি অবহেলিত বিষয়। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় পোলট্রি খামারিরা বর্জ্য অপসারণে কোন রকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে না বরং অনেকেই উদাসীনতার পরিচয় দেয়। খামারের রোগাক্রান্ত মৃত মুরগি খামারের আশে-পাশে যে কোন স্থানে ছুঢ়ে ফেলে দেয় ;যা একবারেই কাম্য নয়। এছাড়াও পোলট্রি লিটার সুনির্দিষ্ট স্থানে ফেলে না, রোগাক্রান্ত মুরগি স্বল্প মুল্যে বাজারে বিক্রি করে অথবা স্থানীয়ভাবে বিনামূল্যে গ্রামের গরীব লোকদেরকে দিয়ে থাকেন। এতে রোগ জীবাণু সহজে ছড়িয়ে পরে ও কিছু জুনোটিক জীবাণু (Zoonotic Organisms) রয়েছে যা মানব জীবনকেও হুমকির মূখে ঠেলে দেয়।

বিশেষ করে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস এ অক্রান্ত মুরগি অনেকে গ্রামের গরীব মানুষকে দিয়ে থাকেন ;যা কোনভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এভাবে চলতে থাকলে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস সহ অন্য যে কোন রোগ জীবাণুর বিস্তার কোন ভাবেই ঠেকানো সম্ভব হবে না বরং মুরগি খামার ও খামারের চারপাশের পরিবেশ থেকে রোগ জীবাণুর মূলোৎপাটন করা দিন দিন কঠিন থেকে আরো কঠিনতর হচ্ছে। এছাড়াও অনেক ছোট খামারি ও অনেক ছোট ছোট ব্রিডার খামারি অজ্ঞতাবশত রোগাক্রান্ত মৃত মুরগি খামার সংলগ্ন পুকুরে বা ডোবায় সরাসরি নিক্ষেপ করে ও তা মাগুর মাছকে খেতে দেয় ও ছোট ছোট বাণিজ্যিকভাবে গরে ওঠা ব্রয়লার বা লেয়ার খামারিরা অনেকক্ষেত্রেই কুকুর বা শেয়ালকে খেতে দেয়; যা কখনোই বিজ্ঞানসম্মত নয়। সুতরাং পোলট্রি রোগ বিস্তার রোধে খামারিদের উচিৎ পোলট্রি বর্জ্য অপসারণে যথেষ্ঠ সতর্ক ও যত্নশীল হওয়া এবং এ বিষয়ে যথাযথ অভিজ্ঞতা অর্জন করা।

পোলট্রি বর্জ্য যথাযথভাবে অপসারণ পোলট্রি রোগ নিয়ন্ত্রন ও নির্মূলে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। অযত্ন ও অদক্ষভাবে পোলট্রি উৎপাদন করলে খামারের মুরগি প্রায়শই রোগাক্রান্ত থাকে ও স্থায়ীভাবে রোগ জীবাণু নির্গত হয়। তাতে খামারের মুরগির অধিক মৃত্যুহার সহ উৎপাদন
কমে যায় এবং খামারের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায়। অতএব পোলট্রি খামার থেকে সময় মতো পোলট্রি বর্জ্য অপসারণ করা সুস্থ ও লাভজনক পোলট্রি পালন খামার ব্যবস্থাপনার একটি অন্যতম হাতিয়ার।

পোলট্রি বর্জ্যের ধরণ
পোলট্রি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় খামারে বিভিন্ন ধরণের পোলট্রি বর্জ্য তৈরী হয় । যেমন—

মৃত মুরগি, বিষ্ঠা, ড্রেসিং বর্জ্য, হ্যাচারী বর্জ্য, পোলট্রি খামারের লিটার অন্যতম। পোলট্রির জীব- নিরাপত্তার লক্ষে পোলট্রি থেকে উৎপাদিত এ সব বর্জ্য নিয়মতান্ত্রিকভাবে অপসারণের ব্যবস্থা করতে হবে। নিম্নে পোলট্রি বর্জ্য অপসারন সমন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা
করা হলো-

ক) মৃত মুরগি অপসারণ সময় ,জ্বালানী ও শ্রমিকের অভাবে খামারের মৃত মুরগি অপসারণের ক্ষেত্রে খামারিরা প্রায়ই এক ধরণের অবহেলাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা
যায় যে, মৃত মুরগি ঠিকভাবে অপসারণ না করে খামারের সন্নিকটে বাহিরে খামার থেকে নীচু
ভূমিতে নিক্ষেপ করে। সবচেয়ে খারাপ দিক হলো ,মুরগিতে রোগ প্রকাশের ঠিক সংকটপূর্ণ মুহূর্তে
এক সাথে খামারের অনেক মুরগি মারা যায় তখন সেগুলো পদ্ধতিগত ভাবে অপসারণ করা খুবই দূঃসাধ্য
। তাই সংকটপূর্ণ মুহূর্তে রোগের বিস্তার ঠেকাতে মৃত মুরগি অপসারণে বাড়তি যত্নের প্রয়োজন।
খামারের বাহিরে নিক্ষেপকৃত রোগাক্রান্ত মৃত মুরগি কুকুর , বিড়াল , শেয়াল , বন্য পাখি
ও শকুন ভক্ষণ করলে রোগের বিস্তার খুবই সহজ হয় ও এ সব মৃত মুরগি ভক্ষনকারী প্রাণি রোগের
বাহক হিসাবে ভূমিকা রাখে। মৃত মুরগি ভক্ষণকারী প্রাণির মাধ্যমে জীবাণু অতি সহজে ও খুবই
দ্রুত ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে গেলে তা’ প্রতিরোধ করা খুবই কঠিন ও তা’ আর হাতের নাগালে
থাকে না। এ ছাড়াও এ সব মৃত মোরগ-মুরগি থেকে রোগ জীবাণু বাতাসের মাধ্যমেও বিভিন্ন এলাকায়
ছড়িয়ে পরে। তাই রোগাক্রান্ত মৃত মুরগি অপসারণে খামরিগণ যূতসই দু’ধরণের পদ্ধতি ব্যবহার
করতে পারে।

১। গর্তে পুতে রাখা পদ্ধতি (Burrial method) : —

মৃত মুরগির সৎকারের জন্য এ পদ্ধতি খামারির কাছে সবচেয়ে বেশী গ্রহণ যোগ্য। এ উদ্দেশ্যে প্রতি দশ হাজার (১০,০০০) মুরগির ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি খামারের জন্য ৬ ফুট ব্যাস ও ৬ ফুট গভীরতা বিশিষ্ট িএকটি গর্তই যথেষ্ঠ। এ পদ্ধতির উল্লেখ যোগ্য দিক হলো কম শ্রম সাধ্য, একটি গর্ত এক বৎসর পযর্ন্ত ব্যবহার করা যেতে পারে, কোন রাসায়নিক পদার্থ ছাড়াই মৃত মুরগি দ্রুত পচে যায়,সঠিকভাবে ঢেকে রাখলে দূর্গন্ধ ছড়ায় না এবং কুকুর , বিড়াল বা শেয়াল ইচ্ছে করলেই সহজে মৃত মুরগি গর্ত থেকে টেনে বের করতে পারে না।

২। সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে ফেলা পদ্ধতি (Burning method) : —

এ পদ্ধতি সবচেয়ে উপযুক্ত ‍ও বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতি। তবে বেশি ব্যয় বহুল
পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে মৃত মুরগি বৈদ্যুতিক গরম চুল্লিতে পুড়িয়ে সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে ভস্মিভূত
বা ছাই করে দেওয়া হয়। এ পদ্ধতিতে চুল্লি স্থাপনের সময় খেয়াল রাখা দরকার যে, মৃত মুরগি
পোড়ানোর সময় যেন সেখান থেকে উৎপাদিত গন্ধ বাতাসের মাধ্যমে খামার কিংবা আবাসিক এলাকার
দিকে প্রবাহিত না হয়।

খ) বিষ্ঠা অপসারণ
(Disposal of droppings
or manure) : —

সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে পোলট্রি পালনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শেড থেকে মুরগি
ঝাক (Flock) বের করে দেওয়ার
পর পরই কেবল তাদের বিষ্ঠা শেড থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। ডিপ লিটার (Deep litter Method) কিংবা পিড়ামিডাল
খাঁচা (Pyramidal
cage)
পদ্ধতিতে পালনকৃত মুরগির অপসারিত বর্জ্য জমির
সার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। অপর দিকে ব্যাটারী খাঁচা পদ্ধতিতে মুরগি পালন করলে আবাস গৃহের
দূর্গন্ধ এড়ানোর লক্ষে পোলট্রি শেড প্রতিদিন অথবা দু’দিনে অন্ততঃ পক্ষে একবার পোলট্রি
বিষ্ঠা সরিয়ে ফেলে পরিস্কার- পরিচ্ছন্ন করা উচিৎ। পোলট্রি বিষ্ঠা ৩ ,৬ অথবা ১২ মাস
পর্যন্ত একত্রে স্তুপাকারে জমিয়ে রাখলে উক্ত বিষ্ঠা জমিতে উৎকৃষ্ঠমানের কম্পোস্ট সারে
রূপান্তরীত হয়। যা ক্ষেতের জমিতে সরাসরি প্রয়োগ করা যায় কিংবা সংরক্ষেণের পর তা’ কয়েক
দফায় জমিতে ব্যবহার করা যায়। সংরক্ষণকৃত বিষ্ঠা থেকে যাতে পূণরায় রোগ জীবাণু উক্ত খামারে
কিংবা পার্শ্ববর্তী কোন খামারে না ছড়ায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়াও বায়ু প্রবাহের
গতি লক্ষ্য রেখে বিষ্ঠা সংরক্ষণের গর্ত খামার কিংবা খামার লাগোয়ার এক কর্ণারে নিরাপদ
স্থানে স্থাপন করতে হবে।

গ) ড্রেসিং বর্জ্য
অপসারণ (Disposal
of dressing waste) : —

খামারি তাঁর নিজের প্রয়োজনে যখন খুব স্বল্প সংখ্যক সুস্থ জীবন্ত ব্রয়লার
মুরগি (Live
birds)
খামার এলাকার খুব কাছাকাছি ড্রেসিং করে তার থেকে প্রাপ্ত বর্জ্য তেমন কোন সমস্যার সৃষ্টি
করে না। কিন্তু সমস্যা বাধে যখন খামার এলাকার ভেতর অথবা খামারের খুব কাছাকাছি একইসাথে
অনেক মুরগি ড্রেসিং করে কোথাও বিক্রি করা হয়। কারণ ড্রেসিংকৃত মুরগির এতো বেশী বর্জ্য
অপসারণ করা বেশ কঠিন ও কষ্টো সাধ্য হয়। মাঝে-মধে যখন নিজের ব্যবহারের জন্য কিংবা খামারেই
বসে ২-৪ টি মুরগি খুচরা বিক্রি করতে হয় সে ক্ষেত্রেও ড্রেসিং বর্জ্য যথাযথভাবে অপসারণ
করা উচিৎ।

মানুষের জন্য ভক্ষণের অযোগ্য অংশ বিশেষ করে মুরগির মাথা , পালক ও পা
যেগুলো তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায় তা’ পুড়িয়ে ফেলা
উচিৎ। পক্ষান্তরে , আর্দ্রতাযুক্ত ভক্ষণের অযোগ্য অংশ বিশেষ করে মুরগির নাড়ি-ভুড়ি
, বিষ্ঠা ইত্যাদি গর্ত করে মাটির নীচে পুতে রাখতে হবে। গর্তের মধ্যে অতিরিক্ত গরমে
ফার্মেন্টেশন হলে পরবর্তীতে তা’ জমিতে ব্যবহার উপযোগী সার হিসাবে ব্যবহার কিংবা স্বল্প
মূল্যে বিক্রি করা যাবে। রোগ জীবাণু যাতে বাতাসে না ছড়ায় কিংবা কুকুর ,বিড়াল যেন বর্জ্য
অংশ গর্ত থেকে পূণরায় গর্ত থেকে টেনে বের করতে না পারে সে লক্ষ্যে ভালোভাবে ঢেকে রাখার
ব্যবস্থা করতে হবে।

ঘ) হ্যাচারী থেকে
উৎপাদিত বর্জ্য অপসারণ (Disposal
of hatchery waste) : —

বর্জ্য পদার্থের উল্লেখযোগ্য অংশ হ্যাচালী থেকে পাওয়া যায়। যার মধ্যে
অনুর্বর হ্যাচিং ডিম , মৃত ভ্রুণ , ফুটন্ত ডিমের খোসা দূর্বল ও মৃত বাচ্চা ( Infertile
hatching eggs, dead embryos,eggs shell from hatching eggs ,dead chicks or
weaklings etc) অন্যতম। সন্তোষজনক হ্যাচারী
ব্যবস্থাপনার পরেও প্রায় ১০-১৫% ডিম অথবা ভ্রুণ (Embryos) ইনকিউবেটরে হ্যাচিং এর সময় নষ্ট হয়। হ্যাচারী বর্জ্যের
মধ্যে ডিমের খোসা (Egg shells) ,মৃত ভ্রুণ (Dead
embryos)
,অনুর্বর ডিম (Infertile eggs) ও মৃত বা দূর্বল বাচ্চা (Dead
or weak chicks) হ্যাচরী উপজাত দ্রব্য (Hatchery by-products
meals)
বা হ্যাচারী রেসিডিউ মিল (Hatchery residue meals) হিসাবে ব্যবহৃত
হয়। যা পরবর্তীতে প্রোটিনের উৎস হিসাবে পশুজাত খাদ্য (Animal
feeds)
বিশেষ করে পোলট্রি খাদ্যে ব্যবহৃত হয়। তাই
হ্যচারী বর্জ্য অপসারণের পরিবর্তে উক্ত বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পশু খাদ্য
তৈরীতে ব্যবহার করা যেতে পারে।

হ্যাচারী বর্জ্য খুব বেশী দূর্গন্ধের কারণে নাড়াচড়া (Handling
of hatchery waste) খুবই কষ্টকর ।
বিশেষ করে হ্যাচারীর কাচা বাই-প্রোডাক্ট (Raw hatchery
by-products) আরো বেশী আপত্তিকর দূরগন্ধযুক্ত হওয়ায় এর নাড়াচড়া করা আরো কঠিন (Very
difficult handling due to strong off odour )
কাজ । তবে এ ধরণের সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো হ্যাচারী বাই-প্রোডাক্টের
সাথে বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক উপকরণ বিশেষ করে বায়বীয় জীবাণুনাশক (Gaseous
sterilents) ব্যবহারের মাধ্যমে জীবাণুমুক্তকরণ
করে নিতে হবে। বায়বীয় পদার্থের (Among Gasious sterilents) মধ্যে সাধরণত মিথাইল ব্রোমাইড (Methyl
bromide)
এবং ইথাইনিল অক্সাইড (Ethylene Oxide) ব্যবহৃত হয়।
হ্যাচারী বর্জ্য হাত দ্বারা নাড়াচড়া (Handling) করার সময় অতি
গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়ে বিবেচনায় রাখা দরকার তা’ হলো হ্যাচারী বর্জ্য পদার্থে যেন রোগ
সৃষ্টিকারী খুব বেশী পরিমান জীবাণুর সংক্রমণ না থাকে। কারণ তাতে মানুষের স্বাস্থের
উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে এবং হাত দ্বারা স্পর্শকারী ব্যক্তির জন্য ঝুকিপূর্ণ
হতে পারে। এ জাতীয় সমস্যা প্রতিরোধে রোগাক্রান্ত মুরগির ডিম হ্যাচিং এর জন্য নির্বাচন
না করা এবং ইনকিউবেটরের ট্রে (Tray) থেকে সময় মতো মৃত ভ্রুণ (Dead
embryos)
সরিয়ে ফেলা। আরো সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করতে হবে ভ্রুণের মৃত্যুর হার যতোদূর সম্ভব সর্বোনিম্ন
মাত্রায় রাখা।

ফার্মসএন্ডফার্মার/২৯আগস্ট২০