পোলট্রি শিল্পে সংকট নিরসন ও খামারিদের অস্তিত্ব রক্ষায় হস্তক্ষেপ কামনা

132

উৎপাদন খরচের বিপরীতে ন্যায্য দাম না পাওয়া, অপপ্রচার এবং বাজার তদারকি সংস্থার চাপের কারণে প্রান্তিক খামারিরা দিন দিন আরও বেশি প্রান্তিক হয়ে পড়ছেন। ইতোমধ্যে বিপুল খামার বন্ধ হয়ে গেছে, কমেছে উৎপাদন। এ অবস্থা চলতে থাকলে ডিম-মাংসের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে, দেখা দেবে পুষ্টি ঘাটতি। তাই প্রান্তিক খামারিদের সুরক্ষা এবং ডিম-মুরগির উৎপাদন বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন পোলট্রি সংশ্লিষ্টরা। গতকাল বৃহস্পতিবার ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) মিলনায়তনে বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) আয়োজিত মিট দি প্রেস অনুষ্ঠানে পোলট্রি শিল্প-সংশ্লিষ্ট সাতটি সংগঠনের নেতারা এ আহ্বান জানান।

বিপিআইসিসির সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, ২০২২ ও ২০২৩ সালের বেশিরভাগ সময় ডিম ও মুরগি উৎপাদনকারী খামারিরা লোকসান করেছেন; উৎপাদন খরচের চেয়েও কম মূল্যে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়েও খামারিরা চেষ্টা করেছেন উৎপাদন সচল রাখতে, দেশের মানুষের জন্য প্রোটিন সরবরাহ অব্যাহত রাখতে। এজন্য তাদের প্রশংসা পাওয়ার কথা ছিল অথচ খামারি ও উদ্যোক্তাদের ললাটে জুটেছে অপবাদ আর অপমান। মধ্যস্বত্বভোগীরা অনায্য মুনাফা করেছে অথচ খড়গ নেমেছে উৎপাদকদের ওপর।

খালেদ বলেন, এভাবে বাজারে স্থিতিশীলতা আসবে না। খামারিরা লাভ করতে পারলে যারা সরে গেছে তারা আবার ফিরে আসবে। উৎপাদন বাড়লে বাজারও স্থিতিশীল হবে। পোলট্রি শিল্পের চলমান সংকট নিরসনের মাধ্যমে এ খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে তাই তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) সভাপতি কাজী জাহিন হাসান এবং সাধারণ সম্পাদক মো. মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘ডিম ও মুরগির খামারি-উদ্যোক্তারা মিথ্যা কথা বলছেন! শত শত কোটি টাকা লুটে নিয়ে যাচ্ছেন! ডিম-মুরগির বাজারে সিন্ডিকেট!’Ñএমন অপপ্রচার ছড়ানোর কারণে বিভ্রান্তি দিন দিন আরও ঘনীভূত হয়েছে। তাছাড়া ‘প্রান্তিক খামারি’ বনাম ‘করপোরেট খামারি’র বির্তক সৃষ্টির মাধ্যমেও দেশীয় খামারি ও উদ্যোক্তাদের অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর অপচেষ্টা হচ্ছে। ডিম-মুরগি আমদানি করা হলে তা দেশেরই ক্ষতি করবে। তিনি বলেন, এক দিন বয়সী ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার সাপ্তাহিক চাহিদা যেখানে ছিল প্রায় ১ কোটি ৭০ থেকে ৮০ লাখ, বর্তমানে তা ১ কোটি ৩০ লাখে নেমে এসেছে। লেয়ার মুরগির চাহিদা ১১ লাখ থেকে কমে হয়েছে সাড়ে ৯ লাখ।

মাহাবুবুর রহমান বলেন, ২০২২ সালে এক দিন বয়সী মুরগির বাচ্চা বিক্রি করে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নাকি শত শত কোটি টাকা লোপাট করেছিলÑএমন প্রচারণা চালানো হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা ছিল একেবারেই উল্টো। লাভ তো দূরের কথা ব্রয়লার ও লেয়ার খামারিদের লোকসান হয়েছিল প্রায় ৪৬৫ কোটি টাকা। মাত্র কয়েকদিনের মূল্যবৃদ্ধিকে একটি চক্র হীন স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেছিল। ব্রিডার্স সেক্রেটারি আরও বলেন, ডিম ও মুরগি একই দিনে একই মার্কেট এবং দেশের বিভিন্ন মার্কেটে একেক দামে বিক্রি হচ্ছে। যেখানে ক্ষুদ্র খামারিরাই প্রধান উৎপাদক ও সরবরাহকারী সেখানে

সিন্ডিকেট করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, এক সময় বলা হয়েছিল কাজী ফার্মস, প্যারাগন বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে অথচ এবার ডিমের মূল্যবৃদ্ধির সময় এ দু’টি প্রতিষ্ঠানসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মূল্য বৃদ্ধি না করলেও বাজারে দাম বেড়েছে। কাজেই আমাদের বুঝতে হবে যে, একটি স্বার্থান্বেষী মহল দেশীয় পোলট্রি শিল্প ধ্বংসের লক্ষ্যেই ‘করপোরেট ও প্রান্তিক খামারি’র বিতর্ক সৃষ্টি করছে।

এদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে।

ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (এফআইএবি) সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে ভূট্টা, সয়াবিন মিলসহ ফিড তৈরির অন্যান্য উপকরণ এবং ওষুধের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে। তিনি বলেন, ডলার সংকটের কারণে এলসি করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে এনওসি দিয়ে আমদানি করা ফিড গ্রেড পণ্যকেও ফুড গ্রেড লেবেল দিয়ে উচ্চহারে শুল্কায়ন করা হচ্ছে; আবার মিস ডিক্লারেশনের অভিযোগে একই সঙ্গে ২০০ শতাংশ জরিমানা করা হচ্ছে।

নজরুল বলেন, টেকনিক্যাল যুক্তি দেখিয়ে সয়াবিন মিল নামক এসআরও সুবিধা প্রাপ্ত একটি অত্যাবশ্যকীয় কাঁচামাল আমদানিতে কয়েক কোটি টাকার শুল্ক আদায় করা হয়েছে, কেবল একটি আমদানিকারকের কাছ থেকে। সাগরে কয়েকটি জাহাজ ভাসছে। প্রতিদিন প্রতিটি জাহাজকে কয়েক হাজার ডলার করে জরিমানা গুনতে হচ্ছে। এসব কিছুর কারণেও উৎপাদন খরচে কোনোভাবেই লাগাম টানা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি বলেন, ডিমের দৈনিক উৎপাদন ৫ কোটি থেকে বর্তমানে ৪ কোটির নিচে নেমে এসেছে। প্রান্তিক ও ছোট খামারিরা মোট চাহিদার ৮৫ শতাংশ ডিম উৎপাদন করছে। তিনি বলেন, খামারিদের মাঝে ভয় নয়; বরং আশা জাগিয়ে তুলতে হবে। বিদ্যুৎ বিলে ভর্তুকি দিতে হবে। প্রয়োজনে ভর্তুকি মূল্যে বাচ্চা, ফিড এবং ওষুধ দিতে হবে। পোলট্রি বিমাকে খামারিবান্ধব করতে হবে, সফল খামারিদের পুরস্কৃত করতে হবেÑতাহলে বন্ধ হয়ে যাওয়া খামারগুলো আবার চালু হবে। তিনি বলেন, ডিমের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে যখন তুমুল হইচই হচ্ছে তখনও ব্রয়লার খামারিরা লোকসানেই মুরগি বিক্রি করছেন অথচ সেদিকে কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ১৭০ থেকে ১৭৫ টাকা উৎপাদন খরচের ব্রয়লার মুরগি চলতি মাসে গাজীপুর পাইকারি বাজারে বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৩৫ থেকে ১৪৫ টাকা কেজি দরে। মার্কেট সংশোধন হলে তখন হয়তো আবার আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে।

এনিমেল হেলথ কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আহকাব) সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আফতাব আলম বলেন, প্রায়ই খামার ও খুচরা বাজারের মাঝে বড় ধরনের ফারাক লক্ষ করা যাচ্ছে। ১০.৭৫ টাকায় উৎপাদিত ডিমের সঙ্গে ২ টাকা যোগ করলেও খুচরা পর্যায়ে ডিমের দাম ১২.৭৫ টাকার বেশি হওয়া সমীচীন নয় অথচ বাজারে তা ক্ষেত্র বিশেষে ১৫ টাকা এমনকি কোথাও কোথাও ১৭ টাকা পর্যন্ত উঠতে দেখা গেছে। আইনসিদ্ধ মুনাফার চেয়েও অনেক কম লাভ করা সত্ত্বেও হেনস্তা হচ্ছেন উৎপাদক-খামারিরা। ব্রয়লার মুরগির বাজারে খামার থেকে ভোক্তা পর্যায়ের মাঝে ৪০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত ফারাক থাকছে যেখানে খামারি হয়তো লাভ করছেন কেজিতে মাত্র ৩-৪ টাকা। কখনও আবার লোকসানেও বিক্রি করতে হচ্ছে কিন্তু তখনও মধ্যস্বত্বভোগীদের মুনাফায় কোনো কমতি হচ্ছে না। তাহলে খামারি টিকবে কীভাবে? এ অবস্থার উন্নয়নে তিনি বাজার তদারকি সংস্থার হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

ডিম-মুরগির উৎপাদন খরচ কমাতে ফিড তৈরির বিকল্প কাঁচামাল-রাইস ডিডিজিএস, ব্রোকেন রাইস, সরগম, বার্লি, কটন সিড মিল, সানফ্লাওয়ার সিড মিল, মিলেট, পিনাট প্রভৃতি পণ্যগুলোকে শুল্কমুক্ত পণ্যের এসআরওতে অন্তর্ভুক্ত করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রতি অনুরোধ জানান। তাদের ভাষায় এতে লেয়ার ফিডের উৎপাদন কেজি প্রতি ৩-৪ টাকা হ্রাস পাবে। তারা অভিযোগ করে বলেন, ডলার সংকটের সুযোগ নিয়ে সিড ক্র্যাসিং ইন্ডাস্ট্রি সয়াবিন মিলের দাম অনায্যভাবে বাড়িয়ে চলেছে। এক্ষেত্রে সরকারের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মাঝে বক্তব্য দেনÑওয়ার্ল্ডস পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখার সহসভাপতি মো. তৌহিদ হোসেন, বাংলাদেশ এগ্রো ফিড ইনগ্রিডিয়েন্টস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এম আমিরুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত কুমার দেব, ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা ও সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম প্রমুখ।