পোল্ট্রির ‘মারেক্স’ রোগের কারণ জেনে প্রতিকার করুন

774

marex1

পোল্ট্রি শিল্পের জগতে মারেক্স রোগ এমন একটি মারাত্মক রোগ যেটা আপনার স্বপ্নকে ধুলিসাৎ করে দিতে পারে। ষাটের দশকে এটার ভয়াবহতা খামারীরা টের পেয়েছিল। তবে দ্রুত ভ্যানসিন আবিষ্কার ও প্রতিরোধ করা সম্ভব। মারেক্সের সেই ভয়াবহতা হয়তো নাই কিন্তু আজো এটি আমাদের পোল্ট্রি শিল্পে বিরাট হুমকি হয়ে আছে। তাহলে জেনে নিন কিভাগে রোগ ছড়ায় ও এর জন্য আপনিই বা কি করতে পারেন।

এটি একপ্রকার ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট মুরগির লিম্ফোপ্রোলিফারেটিভ রোগ। এ রোগকে ফাউল প্যারালাইসিসও বলা হয়ে থাকে। অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এ রোগ হয়ে থাকে তবে তা সাধারণত উন্নতজাতের মুরগিতেই দেখা যায়।

সব বয়সের মুরগিতেই এ রোগ হতে পারে তবে প্রধানত ২-৫ মাসের বাড়ন্ত মুরগি এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। আক্রান্ত মুরগির বহিরাভাগের স্নায়ু এবং অনেক সময় গোনাড, বিভিন্ন ভিসেরাল অঙ্গ, ত্বক, চোখ, মাংস ইত্যাদিতে ও রোগের সৃষ্টি হয়। এ সমস্ত ক্ষতস্থানে প্রধানত লিম্ফোব্লাস্ট এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের লিম্ফোসাইট এবং কখন ও কখন ও প্লাজমা কোষের অনুপ্রবেশ ঘটে।

কীভাবে মারেক্স রোগের বিস্তার ঘটে:

যেকোনোভাবে এ রোগের ভাইরাস সুস্থ মুরগিকে আক্রান্ত করতে পারে। বাতাসের সাহায্যে সহজেই এ ভাইরাস এক স্থান হতে অন্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে রোগের বিস্তার ঘটাতে পারে। রোগাক্রান্ত মুরগির ঘরের ধুলাতে এ ভাইরাস কয়েক সপ্তাহ জীবিত থেকে রোগ বিস্তার করতে পারে। আক্রান্ত মুরগির বিষ্ঠা ও লিটারে স্বাভাবিক তাপমাএায় এ ভাইরাস জীবিত থাকতে সক্ষম। কীট পতঙ্গের মাধ্যমে এ ভাইরাসের সংক্রমণ হতে পারে।

এপিডিমিওলজি:

পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই উন্নত জাতের মুরগিতে এ রোগ পাওয়া যায়। আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রতি বৎসর বহু মুরগি এ রোগে মারা যায় এবং কোটি কোটি টাকার ক্ষতি সাধিত হয়। প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসারে মুরগিতেই এ রোগ বেশি হয়। তবে হাঁস, কবুতর, কেনারী ও কোয়েল পাখিতে এ রোগ হতে দেখা গেছে। প্রকৃতিতে মুরগি প্রায় ৩ সপ্তাহ বয়সের সময় ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং ২-৫ মাসের মধ্যে তাদের দেহে রোগ লক্ষণ প্রকাশ পায়।

রোগের সঙ্গে বিভিন্ন উৎপাদকসমূহের সম্পর্ক:

(ক) ভাইরাসের মাত্রার প্রভাব:
যদি অধিক মাত্রায় ভাইরাস দেহে প্রবেশ করে তাহলে রোগ হবার সম্ভবনা ও অধিক দেখা দেয়।
(খ) দেহে অনুপ্রবেশ পথ:
ভাইরাস যদি নাক দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে তাহলে রোগ হবার সম্ভবনা অধিক।
(গ) লিঙ্গের প্রভাব:
এ রোগ প্রধানত: মোরগের চেয়ে মুরগিতেই অধিক হয়।
(ঘ) বংশের প্রভাব:
কোনো কোনো বংশের মুরগির দেহে এমন কিছু জিন রয়েছে যা মুরগির দেহে ভাইরাস দ্বারা রোগ সৃষ্টি হওয়া প্রতিহত করে। সাধারণতঃ দেশি জাতের মুরগিতে এ ধরনের অনাক্রম্যতা দেখা যায়। আমাদের দেশীয় মুরগিতে এ রোগ এ কারণে এখনো হতে দেখা যায় না। উন্নত জাতের মুরগি এ রোগের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল।
(ঙ) বয়সের প্রভাব:
অল্প বয়স্ক মুরগি রোগের প্রতি অধিক সংবেদনশীল। বয়সের সাথে ক্ষতের সম্পর্ক অত্যন্ত সুষ্পষ্ট। অল্প বয়স্ক মুরগিতে নার্ভ অধিক আক্রান্ত হয় আর বয়স্ক মুরগিতে ভিসেরাল অধিক আক্রান্ত হয়।

রোগের লক্ষণ:

আক্রান্ত মুরগির জাত, বয়স ও ভাইরাসের স্ট্রেইনের ওপর এ রোগের লক্ষণ নির্ভর করে। ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার পর আক্রান্ত বাচ্চার রোগ লক্ষণ প্রকাশ পেতে প্রায় ৩ সপ্তাহ লাগে। স্নায়ু বা নার্ভ প্রকৃতির রোগে দেহের বহিরাভাগের নার্ভগুলো বিশেষ করে ব্রেকিয়াল (Brachial) এবং লামবো সেকরাল প্লেকসাসের (lumbo-sacral plexus) নার্ভগুলোই অধিক আক্রান্ত হয়। তবে মস্তিস্ক এবং দেহের অন্যান্য নার্ভগুলোও আক্রান্ত হতে পারে।

কোন ফার্মে যখন এ রোগের প্রার্দুভাব ঘটে তখন অনেকগুলো মোরগ মুরগিতে প্রায় একসঙ্গে লক্ষণ প্রকাশ পায়। মুরগিগুলোকে দুর্বল দেখা যায়। এর পর পায়ে ও পাখায় পক্ষাঘাত দেখা দেয়। কিছু মুরগিতে লক্ষণ প্রকাশ পাবার পূবেই মৃত্যু ঘটে। যখন এক পায়ে পক্ষাঘাত দেখা দেয় তখন তারা কোন প্রকার খুড়িয়ে হাঁটতে থাকে। যখন দুপায়ে পক্ষাঘাত হয় তখন চলার শত্তি হারিয়ে তারা শুয়ে থাকে। যখন পাখাতে পক্ষাঘাত হয় তখন সেটা ঝুলে পড়ে। ঘাড় অবস হলে মাথা একদিকে বাঁকা হয়ে যায়। মস্তিস্ক আক্রান্ত হলে দেহে খিচুনী দেখা দেয়। চক্ষু প্রকৃতির রোগে চোখের আইরিস, পিউপিল, সিলিয়া আক্রান্ত হয়। এ রোগে আইরিসের রং উঠে যায় এবং বর্ডার ভাঁজ ভাঁজ দেখায়।

পরিশেষে মুরগির অন্ধত্ব দেখা দেয়। দীর্ঘস্থায়ী রোগের ক্ষেত্রে মুরগির দৈহিক ওজন হ্রাস পায়, আক্রান্ত মুরগি ফ্যাকাশে হয়ে যায় ও ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়। এর সাথে ডায়রিয়াও দেখা যেতে পারে। এসব কারণে আক্রান্ত মুরগি অনাহার ও পানিশূন্যতায় মারা যায়।

এ রোগটি নির্ণয় করা বেশ জটিল বিধায় খামারিদের অভিজ্ঞ ভেটেরিনারিয়ানের পরামর্শ নেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।

প্রতিরোধ ব্যবস্থা:
খামারের পরিবেশ সবসময় স্বাস্থ্যসম্মত রাখতে হবে। আক্রান্ত মুরগিকে সুস্থদের থেকে অতি দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে। বয়স্ক মুরগি থেকে ছোট বাচ্চাকে স্বতন্ত্রভাবে লালন-পালন করতে হবে। খামারের জৈবনিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর করতে হবে। বহিরাগত কোন ব্যক্তিকে খামারে প্রবেশ করতে দেয়া যাবে না। খামারে ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি ও মুরগির পালকের সাহায্যে ভাইরাস এক শেড থেকে অন্য শেডে, এমনকি এক খামার থেকে অন্য খামারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ ব্যবস্থা প্রতিরোধকল্পে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

ভ্যাকসিন প্রয়োগ:
মারেক্স রোগ প্রতিরোধের জন্য ভ্যাকসিন প্রদানই একমাত্র সর্বাপেক্ষা কার্যকর ব্যবস্থা।

তথ্যসূত্র: the poultry site and Mareks disease by OIE, 2010

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন