প্রতিকূল আবহাওয়ায় বিল অঞ্চলে কমছে বোনা আমনের চাষ

92

 

চলতি মৌসুমে পাবনায় বোনা আমন ধান কাটা-মাড়াই পুরোদমে চলছে। এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে ধান কাটার কাজ। ফলন কম হওয়া এবং প্রতিকূল আবহাওয়ায় কারণে পাবনার বিল অঞ্চলে কমছে বোনা আমনের চাষ। উফশী জাত না থাকায় চাষিরা এ ধান চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। বিগত চার দশকে এ জেলা থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় অর্ধশত বাহারি বোনা আমনের জাত। কৃষকের হাতে উফশী জাত থাকলে বিল অধ্যুষিত পাবনা জেলায় বোনা আমন চাষে বিপ্লব ঘটত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদুপর, সুজানগর উপজেলায় বেশি পরিমাণ বোনা আমন ধান চাষ হয়ে থাকে। কারণ এসব উপজেলায় বিলের পরিমাণ বেশি।

চলতি বছর জেলায় ৩৪ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে বোনা আমন চাষ হয়েছে। তিন বছর আগে চাষ হয়েছে ৩৯ হাজার হেক্টর জমিতে, পাঁচ বছর আগে চাষ হতো ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে। ১০ বছর আগে চাষ হতো ৪৩ হাজার হেক্টর জমিতে।

কৃষি বিভাগের হিসাবে দেখা যায়, ১০ বছরের মধ্যে ৯ হাজার হেক্টর জমিতে কমেছে বোনা আমনের চাষ। বোনা আমনের ক্ষেতগুলোতে এখন অন্য জাতের ধান চাষ হচ্ছে।

প্রবীণ চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আমন ধানের বীজ ছিটিয়ে বোনা হয়। বোরো ধান কাটার পর বৈশাখ মাসের দিকে একটা চাষ দিয়ে এ ধানের বীজ ছিটিয়ে দিতে হয়। মই দেওয়ারও দরকার পড়ে না। আর জমি নরম থাকলে চাষেরও দরকার হয় না। শুধু ছিটিয়ে দিলেই হয়। এমনকি কোনো সার–কীটনাশকও লাগে না।

বোনা আমন ধানে প্রচুর পরিমাণ নাড়া বা জ্বালানি পাওয়া যায়। এ নাড়া বিভিন্ন ফসলের ক্ষেতেও বিছিয়ে দেওয়া হয়। আবার নাড়ার অংশ বিশেষ ক্ষেতে থেকে যায় যা জৈব সারের কাজ করে। এ ধান ক্ষেতে আপনা–আপনি বেড়ে ওঠে। বিলে আট- দশ ফুটের মতো পানি হয়। এ জাতের ধানগাছ তার চেয়েও বড় হয়। বানের পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে ওঠে বোনা আমন ধান। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে পাকা ধান কাটা হয়। একে বাওয়া আমন, আছরা আমন, গভীর জলের আমন ধানও বলা হয়।

পাবনার বিল এলাকার মাঠে বহু আগে থেকেই বোনা আমন চাষ হয়ে আসছে। তবে হঠাৎ বন্যা, ঠিক সময় বর্ষার পানি না আসায় এবং বিঘা প্রতি ফলন কম হওয়ায় এলাকায় এর চাষ কমে আসছে। এ বছর অবশ্য বর্ষা মৌসুম শেষের দিকে বৃষ্টি বেশি হওয়ায় বোনা আমনের ফলন মোটামুটি ভালো হয়েছে। কিন্তু বিগত কয়েক বছর বর্ষায় বিলে পানি কম থাকায় বোনা আমনের ক্ষেতই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

স্থানীয় চাষিরা জানান, দূর অতীতে বিল এলাকায় বোনা আমন ধানই ছিল চাষির প্রধান ফসল। তারা আমন ধানকে বলতেন ‘আমান’ বা আমানত । অর্থাৎ আমন তাদের কাছে একটি নিশ্চিত ফসল বা আমানত হিসেবে পরিচিত ছিল। এ ধানেই কৃষকের গোলা ভরে যেত। পরিবারের ভরণপোষণ, পিঠাপুলি, অতিথি আপ্যায়নসহ সংসারের অন্য খরচ মেটাতেন তারা। তবে উফশী জাতের ধানের জাত সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে বোনা আমন চাষ কমে যেতে থাকে।

এখন দিঘা, ভাওয়ালে, পুঁয়েমুরি, বরন, মধুশাইল জাতের ধান আবাদ হয়। বিগত চার দশকে প্রায় অর্ধশত বাহারি জাত হারিয়ে গেছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।

এক সময় লক্ষীদিঘা, মানিক দিঘা, হিজল দিঘা, ধলধিঘা, সর্ষরি, হারিকাচি, রাজাশাইল, মধুমালতী জলকুমারী, লেবুশাইল, ফুলমুক্তা, কালামানিক, সোনামুখী, দাদখানি রাধুঁনীপাগল, ফুলমালা হরিলী, দুলাভোগ, পোড়াবিন্নি ঝিংগাশাইল, খেজুরঝুপি, কলসকাটি, ব্যাতো, চামারাদিঘা, হরিঙ্গাদিঘা, বাওইঝাক, মরিচফুল, মধুশাইল, বাঁশিরাজ, ঝুলদিঘা, সোনাদিঘা, মালভোগ, বকঝুল, কালোবাজাল, সোনাজলি, জলঢেপা, দুধবাজাল, ঢেপাশাইল, পানিশাইল, সোনাআঞ্জল, কালো ঢেপা, লক্ষী দিঘা, দুধ শাইল, দুধ রাজ, বাঁশ মালতি, ওমর চামারা, লাল ঢেপা, আড়াইরাল, কাজল, কার্তিকঝুল, বিলডুবি, মালিকাশাইল, কাজলগিরি, ডুমরাজ, জলডুবি, পঙ্খীরাজ জাতের বোনা আমন ধানের চাষ হতো। পাবনার বিল অঞ্চলে এখন সেসব জাত আর চোখে পড়ে না।

কৃষি কর্মকর্তারা জানান, দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে এবং এ কারণে খাদ্য চাহিদাও বাড়ছে। অন্যদিকে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ আশঙ্কাজনক কমার কারণে অল্প জমিতে ধানের উৎপাদন বাড়াতে হচ্ছে। কিন্তু বোনা আমন ধানের ফলন কম। এ কারণেই মূলত বোনা আমনের চাষ কমছে। আর প্রতিকূল আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও আবাদ কমেছে।

চাটমোহর উপজেলার চলনবিল, সাঁথিয়ার বিল গ্যারকা ও সুজানগর উপজেলার গাজনা বিলপাড়ের বেশ কিছু চাষি জানান, জমিগুলো এখন রাসায়নিক সারে নষ্ট হচ্ছে। তাই জমির প্রাণ বাঁচাতে বোনা আমন জাতের ধান চাষ জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ বোনা আমন চাষে সার-বিষ লাগে না উপরন্তু নাড়া পচলে তা থেকে থেকে জৈব সার তৈরি হয়। এতে জমিগুলোর জৈব উপাদান বৃদ্ধি পায়।

বিল গ্যারকা এলাকার প্রবীণ চাষি জানে আলম বলেন, এক সময় প্রতিটি গ্রামেই গভীর পানিতে এ ধান চাষ হতো। তবে হঠাৎ বন্যা, ঠিক সময়ে বর্ষার পানি না আসা ও ফলন কম হওয়ায় আমনের চাষ কমে আসছে।

চলনবিল এলাকার কাটেঙ্গা গ্রামের চাষি হায়দার আলী বলেন, বোনা আমন বিঘা প্রতি ৭-৮ মণ করে ফলন হয়। খুব ভালো হলে তা ১০ মণ হয়। কিন্তু এ ফলনে চাষির পোষায় না।

একই গ্রামের কৃষক রবিউল বলেন, বোনা আমনের ফলন কম। বর্ষা মৌসুমে চাষ করতে হয় তাই তারা বাধ্য হয়ে এ ধানের চাষ করেন। বেশি ফলনের বোনা আমন ধানের জাত উদ্ভাবিত হলে লাভবান হতে পারতাম।

পাবনার বিশিষ্ট চাষি সংগঠক শাহজাহান আলী বলেন, সাধারণ হিসাবে দেখা যায় গত চার দশকে ধানের ফলন ও উৎপাদন বেড়েছে। তবে এ বৃদ্ধির পেছনের খরচের হিসাব থেকে দেখা যায় যে পানি সেচ, সার, বালাইনাশক, আগাছানাশক ইত্যাদির ব্যবহারও বেড়েছে বহুগুণ। মূলধন নির্ভর হয়ে পড়েছে আধুনিক প্রযুক্তি। চাষিকে বহু বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। তাদের ঋণের বোঝাও বাড়ছে, জনসাধারণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে, জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত হচ্ছে, পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। তিনি জানান, বোনা আমন ধান চাষ সব দিক থেকে লাভজনক হবে যদি শুধুমাত্র ফলন বাড়ে।

কৃষি তথ্য সার্ভিস, পাবনা আঞ্চলিক অফিসের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত ১০২টি উচ্চ ফলনশীল আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এগুলোর মধ্যে একটি জাত বোনা আমন মৌসুম উপযোগী। ব্রি ধান ৯১ জলি আমন ধানের জাত ও অগভীর পানিতে চাষের উপযোগী। তবে এ জাতটি কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি বলে চাষিরা জানিয়েছেন।

কৃষক উন্নয়ন সোসাইটি পাবনার সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান কুল ময়েজ বলেন, সময়ের প্রয়োজনে বোনা আমন ধান নিয়ে গবেষণা ও উন্নত জাত উদ্ভাবন জরুরি। এক্ষেত্রে আগের জাতের চেয়ে ফলন বেশি হতে হবে। কম সময়ে বেশি ফলনের জাত হতে হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পাবনার উপ-পরিচালক ড. জামাল উদ্দিন বলেন, বোনা আমন ধানের উন্নত জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ হলে দেশে ধানের উৎপাদন আরও বাড়বে। এতে উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় চাষিরাও লাভবান হবেন।