প্রাকৃতিক মধু সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করছে হবিগঞ্জের অনেক মানুষ

1860

মধু

হবিগঞ্জ: জেলার হাওর এলাকায় বসবাসকারী জনগণ বছরের অধিকাংশ সময়ই থাকে বেকার। একটি মাত্র ফসল বোরো ধান লাগানো এবং উঠানোর সময় তাদের কাজ থাকে। অন্য সময় তেমন একটা কাজ থাকে না। তবে বর্তমানে অনেকেই হাঁসের খামার, গরু পালনসহ বিভিন্ন উৎপাদনমুখী কাজে জড়িত হচ্ছেন। আবার অনেকেই চলে যাচ্ছেন শহরে বন্দরে বিভিন্ন কাজের সন্ধানে। তবে প্রাকৃতিক মধু আহরনের মাধ্যমে ব্যতিক্রম বিকল্প কর্মসংস্থান করেছেন জমির আলী ও মোশারফ নামে দুই যুবক।

হবিগঞ্জের হাওর এলাকা বানিয়াচং উপজেলার সাঙ্গর গ্রামের শেখ সুন্দর আলীর ছেলে জমির আলী এবং চনু মিয়ার ছেলে মোশারফ হোসেন খুব একটা লেখাপড়া করতে পারেননি। কৃষিকাজই তাদের পেশা। আবার খুব একটা জমিও নেই তাদের। তাদের বয়স যখন ২০/২২ বছর তখন গ্রামে এক লোক এসে মধুর চাক ভেঙ্গে সংগ্রহ করে মধু। এই মধু সংগ্রহ পদ্ধতি দেখে তারাও দুইজন মিলে সিদ্ধান্ত নেয় গ্রামে গ্রামে গিয়ে মধু সংগ্রহ করবে তারা। মধু সংগ্রহের পাত্র এবং ধোঁয়া দেয়ার উপকরণ সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে তারা। শুরুতে খুব একটা সফল না হলেও এখন তারা প্রাকৃতিক মধু সংগ্রহকারী হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। লোকজন চাক দেখলেই তাদেরকে মোবাইলে খবর দেয়। আবার মধুর ক্রেতারা যোগাযোগ রাখেন কখন চাক ভাংতে যাবে তারা। সাথে গিয়ে ক্রেতারা খাঁটি মধু সংগ্রহ করেন তাদের কাছ থেকে।

কয়েকদিন হবিগঞ্জ শহরের পাশেই শচীন্দ্র ডিগ্রি কলেজের ৫টি চাক ভাঙে তারা। সেখানে ভালই মধু মিলে তাদের। এ সময় কথা হয় তাদের সাথে।

জমির আলী জানায়, ছোটবেলায় দেখে দেখে তারা এই কাজ শিখেছে। তাদের গ্রামের দুইজন এবং ইকরাম গ্রামের দুইজন এই পেশায় নিয়োজিত আছে। যখন খবর পান মধুর চাক আছে তখন তারা সেখানে গিয়ে ধোঁয়া দিয়ে মৌমাছিকে তাড়িয়ে দিয়ে মধু সংগ্রহ করেন। অনেক সময় মৌমাছি তাদেরকে হুল ফোটায়। তখন মধু খেয়ে ফেললে খুব একটা প্রভাব আর থাকে না। মধু নামানোর পর দুইভাগ করে একভাগ দেয়া হয় মালিককে এবং একভাগ তারা নিজেরা এনে বিক্রি করে। অনেক সময় একটি চাকে ২/১ কেজি মধু হয়। আবার ৩০ কেজি পর্যন্ত মধু পাওয়া গেছে একটি চাক থেকে। ৬শ টাকা দরে তারা এই মধু বিক্রি করে থাকে।
মোশারফ হোসেন জানায়, সারা বছর মধু পাওয়া যায় না। বড়ই ফুলের মধু, লিচু ফুলের মধু এবং সরিষা ফুলের মধু তারা সংগ্রহ করে। মধুর পাশাপাশি উপজাত হিসেবে মোমও সংগ্রহ করে তারা। এই মোম ২শ টাকা কেজি হিসেবে ফার্নিচার এবং স্বর্ণকারের দোকানে বিক্রি করে তারা।

সে আরও জানায়, ৫ বছর যাবৎ তারা এই কাজে জড়িত। বছরে জনপ্রতি ৭০/৮০ হাজার টাকা আয় হয় তাদের। এই পর্যন্ত হাজারের অধিক চাক থেকে মধু সংগ্রহ করেছে তারা। হবিগঞ্জের সকল গ্রামেই মধুর চাক পাওয়া যায়। জেলার সকল উপজেলা এমনকি পার্শ্ববর্তী মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলায়ও যান তারা মধু সংগ্রহ করতে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা হবিগঞ্জ জেলার সাধার সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল জানান, হবিগঞ্জের হাওর ও পাহাড়ী এলাকায় বনাঞ্চলে এক সময় প্রচুর মধু পাওয়া যেত। অপরিকল্পিতভাবে বনাঞ্চল উজারের ফলে প্রাকৃতিক এই মধু কমে যাচ্ছে। এখন অনেকেই বাণিজ্যিকভাবে মধু উৎপাদন করছেন। পরিকল্পনা গ্রহণ করলে যেমন মধু উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে তেমনিভাবে কর্মসংস্থান হবে অনেক লোকের।

সরকারি বৃন্দাবন কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. সুভাষ চন্দ্র দেব জানান, মধু একটি সর্বোৎকৃষ্ট ঔষধী ও পুষ্টিকর খাবার। প্রকৃতি ধ্বংস না করলে মধু উৎপাদন বাড়বে। পাশাপাশি মধু সংগ্রহকালে মৌমাছির মাধ্যমে পরাগায়নের ফলে উদ্ভিদজাত ফসলেও উৎপাদন বাড়বে।

হবিগঞ্জ কৃষি সম্প্রসার অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা তোফায়েল খান জানান, এই মৌসুমে হবিগঞ্জের হাওর এলাকায় ব্যাপকভাবে সরিষা আবাদ হচ্ছে। বিশেষ করে লাখাই উপজেলায় সরিষার আবাদ বেশী হয়। সেখানে অনেকেই মৌমাছির বাক্স নিয়ে যান এবং মধু উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন