পৃথিবীর ইতিহাস উত্থান আর পতনের। ইতিহাসের পাতা উল্টালেই অসংখ্য সভ্যতার আবির্ভাব ও সময়ের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়ার, পরাক্রমশালী ও মহাপরাক্রমশালীদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব সংঘাত আর যুদ্ধ বিগ্রহের গল্প। বুদ্ধি আর পেশি শক্তির জোরে কোনো জাতি দুনিয়া শাসন করেছে, বিস্তার ঘটিয়েছে সাম্র্যজবাদদের; আবার টিকে থাকতে না পেরে অসংখ্য ক্ষুদ্র রাজ্য ও রাজত্ব- সাম্র্যজবাদি শক্তির দাসত্ব গ্রহণে বাধ্য হয়েছে। কখনও আবার এক সাম্র্যজবাদি শক্তি তারচেয়েও অধিক শক্তিশালী ও কৌশলী সাম্র্যজবাদি শক্তির দাপটে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে।
এই যে শক্তি ও বুদ্ধির প্রতিযোগিতা- সেখানে প্রোটিনের কি কোনো ভূমিকা ছিল? শৌর্য-বীর্য্য ও তীক্ষ্ম মেধার অধিকারি রাজ-রাজারা এমন কি খেতেন যা তাঁদেরকে অন্যদের উপর প্রভুত্ব করার সামর্থ্য যোগাতো? রাজ্য দখলের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা রাজারা যুদ্ধের খরচ মেটাতে গিয়ে রাজ্যের ভেতরকার অসন্তোষ ও মন্দা মোকাবেলায় যে বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশলের পরিকল্পনা বা প্রয়োগ করতেন সেখানেও কি প্রোটিনের কোন অবদান ছিল? এ প্রশ্নগুলোই আমার চিন্তায় বারবার ঘুরে ফিরে আসছিল, যখন প্রোটিন নিয়ে একটি আর্টিকেল লেখার কথা ভাবছিলাম।
সময়ের ঘড়ি এগিয়েছে তবে যুদ্ধ এখনও থামেনি। চলছে অস্ত্রের প্রতিযোগিতাও। তবে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের চেয়ে এখন অর্থনৈতিক যুদ্ধ ও প্রতিযোগিতাই প্রধান- যেখানে বুদ্ধি ও কৌশলেইর জয় জয়কার।
বর্তমান সময়ে প্রোটিনের কথা এলেই জীম, বডি বিল্ডিং, স্পোটর্স এর কথা চলে আসে। ভারতীয় চলচিত্রের হার্টথ্রব নায়ক সালমান খান তাঁর ফিজিক দেখিয়ে দর্শক মাতিয়েছেন। শুধু তাই নয়, শাহরুখ খান কিংবা আমির খানের মত সাধারণ দৈহিক গঠনের অধিকারি নায়কদেরও সিক্সপ্যাক বানানোর প্রতিযোগিতায় নামতে দেখা গেছে। প্রাচীনকালের ভাস্কর্যগুলোর দিকে তাকালেও পেশি শক্তির অধিকারি রাজা ও সেনা প্রধানদের বিশাল বিশাল মূর্তি যেমন চোখে পড়ে; তেমনি সাধারণ মানুষের নিছক বেঁচে থাকার গল্পগুলোও প্রতিভাত হয়ে উঠে বিভিন্ন শিলাচিত্রে। উভয়ক্ষেত্রেই প্রোটিনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রোটিনের অপ্রতুলতা ও মূল্য:
প্রাগৈতিহাসিক কালের কথা যদি বলি তবে সে সময় প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্য তেমন একটা সহজলভ্য ছিলনা। প্রোটিনের সন্ধানে মানুষকে শিকারে যেতে হতো। কাজটা ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ। মানুষ তখনও পশুপালন কিংবা চাষাবাদ শুরু করেনি। গৃহপালিত পশুর অপ্রতুলতা থাকলেও বন-জঙ্গল থেকে উদ্ভিজ্জ প্রোটিন তাঁরা সহজেই সংগ্রহ করতে পারতো। বলা চলে সে সময়- প্রাণিজ প্রোটিনের অপ্রতুলতাই একে মূল্যবান খাদ্য হিসেবে কদর দিয়েছিল।
বেঁচে থাকার লড়াইয়ে প্রোটিন: শিকার করা, শিকারের সাথে লড়াই করা কিংবা সেগুলো সংগ্রহ ও বহন করে নিয়ে আসার জন্য শক্তির প্রয়োজন হতো- দরকার হতো প্রোটিনের। পেশির গঠন ও হিং¯্র পশু দ্বারা আক্রান্ত কিংবা রোগাক্রান্ত শরীর পুণর্গঠন, প্রতিদিনের কাজগুলো সম্পন্ন করা, সর্বোপরি বিরূপ প্রকৃতির সাথে লড়াই করে টিকে থাকার সংগ্রামে প্রোটিনের প্রয়োজন ছিল অবশ্যম্ভাবী।
রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রোটিন: প্রাগৈতিহাসিক কালের মানুষেরা প্রায়শই নানাবিধ সংক্রামক রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হতো। মানুষের হাতে তেমন কেনো জীবন রক্ষাকারি ওষুধ ছিলনা। তাই রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়িয়ে কিভাবে জীবানুর বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করা যায় সে চিন্তা করতে হতো তাঁদের। সে সময়ের বাস্তবতাই মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছিল- এক্ষেত্রে প্রাণিজ আমিষ কতটা জরুরি।
প্রজনন সক্ষমতায় সহায়ক প্রোটিন: বন-বাদাঁড় থেকে খাদ্য সংগ্রহ যখন কঠিন হয়ে পড়তো কিংবা খাদ্যের অপ্রতুলতা তৈরি হতো তখন, বিশেষ করে গর্ভবতী মা ও ভবিষ্যত শিশুর চিন্তায় বিচলিত হয়ে পড়তো প্রাগৈতিহাসিক মানুষেরা। ভ্রুণের পরিস্ফুটন, মায়ের বুকে দুধ উৎপাদন ও নবজাতক শিশুকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে তখন তাঁরা প্রাণিজ প্রোটিন সংগ্রহকে অধিকতর গুরুত্ব দিতো।
প্রোটিনের বিভিন্ন উৎস: প্রোটিন বলতে মূলত: মাংসের কথা মাথায় এলেও প্রাগৈতিহাসিক মানুষেরা তাদের প্রকৃতি ও পরিবেশ এবং সহজলভ্যতা বিবেচনায় বিভিন্ন উৎস থেকে প্রোটিন জাতীয় খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টা করতো।
পশু ও মৎস্য শিকার: পশু শিকার থেকে মানুষ উচ্চমানসম্পন্ন প্রোটিন জাতীয় খাদ্য- মাংস সংগ্রহ করতো। তবে নদী বা সমুদ্রের কাছাকাছি বসবাসকারি মানুষেরা মাছ শিকার করেই সে চাহিদা পূরণ করতো।
পশুপালন: মানুষ যখন সংঘবদ্ধভাবে বসবাস শুরু করলো তখন গরু-ছাগল, ভেড়া, শূকর ইত্যাদি পশু পালন আরম্ভ করলো। এর মধ্য দিয়ে প্রাণিজ প্রোটিন তাঁদের হাতের নাগালে এলো। অবশ্য শুরুর দিকে এ ধরনের খাদ্য কেবলমাত্র অভিজাত ব্যক্তি কিংবা বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্যই সংরক্ষিত থাকতো।
উদ্ভিজ্জ প্রোটিন: বিচি জাতীয় খাদ্য যেমন- শিম, ডাল, ছোলা ইত্যাদিও ছিল প্রোটিনের ভাল উৎস- বিশেষ করে ভেজিটেরিয়ান বা শাকাহারি সমাজের সদস্যদের কাছে। বাদাম, বীজ বা দানাদার খাদ্য এমনকি বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গও বিভিন্ন সমাজ বা জাতিগোষ্ঠীর কাছে প্রোটিনের উত্তম উৎস হিসেবে পরিচিত ছিল।
বিঅন্ড সারভাইভাল: প্রোটিনকে কেবলমাত্র পুষ্টি উপকরণই নয় বরং উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্যকে- শৌর্য্য বা পেশি শক্তি, প্রজননক্ষমতা বা বংশবৃদ্ধি এমনকি সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হিসেবেও বিবেচনা করা হতো। দেবতাকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে রক্ত ও মাংস উৎসর্গ করা কিংবা যোদ্ধা ও অভিজাতদের জন্য তা সংরক্ষণ করা ছিল সে সময়ের এক ধরনের রীতি।