পোল্ট্রি, মৎস্য ও ডেইরি ফিডের কাঁচামাল আমদানিতে আগাম কর প্রত্যাহারের দাবি সাশ্রয়ী মূল্যে ডিম, দুধ, মাছ ও মাংসের উৎপাদন ও সরবরাহ নিরবচ্ছিন রাখতে মাছ, মুরগি ও পশুখাদ্য তৈরিতে ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানিতে আরোপিত আগাম কর (AT) প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে ফিড ইন্ডাষ্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ফিআব) সহ পোল্ট্রি শিল্প সংশ্লিষ্ট তিনটি সংগঠন।
তাঁরা বলেছেন, আগাম কর আরোপের ফলে পোল্ট্রিসহ প্রাণিসম্পদ খাতে অত্যাবশ্যকীয় কাঁচামাল আমদানিতে নতুন করে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে এবং পুঁজির সংকট তীব্রতর হয়েছে। তাই অবিলম্বে তা প্রত্যাহার করে একটি সংশোধিত প্রজ্ঞাপন জারির দাবি তাঁদের।
গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ফিড ইন্ডাষ্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন (ফিআব) সভাপতি এহতেশাম বি. শাহজাহান বলেন, সরকার কর্তৃক জারিকৃত এসআরও নম্বর ১৩০-আইন/২০১৭/১৬/কাস্টমস, তারিখ ০১ জুন ২০১৭, মূলে পোল্ট্রি ও মৎস্য খাত- আমদানি ও উৎপাদন উভয় পর্যায়ে- এটিভি (ATV) সহ সমুদয় মূলসংযোজন করের আওতামুক্ত। এ বিষয়টি প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিকট যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করা হলে আগাম কর (AT) প্রত্যাহারের আশ্বাস দেয়া হয়।
গত ১৩ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে, ৩১৯-আইন/২০১৯/৮১-মূসক মূলে একটি প্রজ্ঞাপনও জারি হয়েছে কিন্তু প্রজ্ঞাপনের “প” অনুচ্ছেদে উল্লিখিতি সংশোধনীতে ভুল বশত:একটি এইচএস কোড যুক্ত করার কারণে পুরো সংশোধনীটি অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
উদ্ভুত সমস্যা উত্তোরণে দু’টি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে ফিআব- (১) পূর্বের ন্যায় মূসক-৭ এর মতো একটি সার্টিফিকেট নিবন্ধিত পোল্ট্রি, মৎস্য ও ডেইরি ফিড প্রস্তুতকারকদের প্রদান করা, যার মাধ্যমে তাঁরা সব ধরনের কাঁচামাল আমদানিতে আগাম কর (AT) থেকে অব্যাহতি পাবেন; অথবা (২) “প” অনুচ্ছেদে উল্লিখিত এইচএস কোডটি সরিয়ে দিয়ে “এসআরও নং ২১৪-আইন/২০১৭/৫২/কাস্টমস, তারিখ: ০১ জুলাই ২০১৭ তে অন্তর্ভূক্ত সকল পণ্য এবং সয়াবিন এক্সট্রাকশন (এইচএস কোড ২৩০৪.০০.০০), ডিডিজিএস (এইচএস কোড ২৩০৩.৩০.০০), কর্ন গ্লুটিন মিল (এইচএস কোড ২৩০৩.১০.০০), রেপসীড এক্সট্রাকশন (এইচএস কোড ২৩০৬.৪৯.০০) সহ মৎস্য ও পশু খাদ্য উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত অন্যান্য সকল আমদানিকৃত খাদ্য উপকরণ বা কাঁচামাল এবং একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা”-এই সংশোধনীটি যুক্ত করে তা প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করা।
ফিআব সভাপতি জানান, গত ১৭ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে তাঁরা এ মর্মে একটি আবেদন এনবিআর -এর কাছে জমা দিয়েছেন। তাছাড়া আগাম কর প্রত্যাহারের জন্য বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) -এর পক্ষ থেকে গত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে অপর একটি চিঠি জমা দেয়া হয়েছে; এবং তাঁরা আশা করছেন সরকার তাঁদের যৌক্তিক দাবি পূরণে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
ফিআব সাধারন সম্পাদক মো. আহসানুজ্জামান বলেন- চলতি অর্থবছরের বাজেটে অন্তর্ভূক্তির লক্ষ্যে তাঁরা অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে এ বছর ৩টি দাবি পেশ করেছিলেন যার একটিও পূরণ হয়নি। তিনি বলেন- বাজেটে ফিডের উপকরণ হিসেবে যে ৩টি উপকরণে কর ও শুল্ক ছাড়ের ঘোষণা দেয়া হয়েছে তার সাথে ফিড ইন্ডাষ্ট্রি’র কোন সম্পর্ক নেই।
তিনি বলেন- পোল্ট্রি ও ফিস ফিড তৈরির কাঁচামালগুলো এখনও মূলতই আমদানি নির্ভর। মোট চাহিদার মাত্র ৫০ ভাগ ভূট্টা দেশে উৎপাদিত হয়, সয়াবিন উৎপাদিত হয়না বললেই চলে; তারপরও সয়াবিন তৈল উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রায় ৫০ ভাগ সয়াবিন মিলের চাহিদা মেটে।
অবশিষ্ট উপকরণগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। তিনি বলেন- বিশ্বের বড় বড় দেশগুলো যেখানে পোল্ট্রি ও ফিস ফিড তৈরির অত্যাবশ্যকীয় কাঁচামাল নিজ দেশে উৎপাদিত হওয়ার পরও খামারিদের ভর্তুকী দিচ্ছে; সেখানে আমাদের দেশে ভূট্টা, সয়াবিন মিল, ঔষধসহ পোল্ট্রি, মৎস্য ও ডেইরি ফিড তৈরির বেশিরভাগ কাঁচামাল আমদানি-নির্ভর হওয়া সত্ত্বেও এ খাতের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আরোপ করা হয়েছে- যা একেবারেই যুক্তিসঙ্গত নয়।
তিনি আরও বলেন- মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে যখন আমাদেরকে ভূট্টা আমদানি করতে হচ্ছে তখন দেশ থেকে ভূট্টা রপ্তানীর অনুমতি দেয়া হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত রহিত করার দাবি জানান জনাব আহসানুজ্জামান। এর পাশাপাশি দেশের বাজার থেকে কাঁচামাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে ২-৫ শতাংশ হারে আরোপিত উৎস কর প্রত্যাহারেরও দাবি জানান তিনি।
আহসানুজ্জামানের মতে- কাঁচামাল আমদানিতে আরোপিত কর ও শুল্ক এবং পণ্য ছাড়করণে দীর্ঘসূত্রীতার কারণে কেজি প্রতি ফিডের উৎপাদন খরচ ৩-৪ টাকা; ব্রয়লার মুরগির ৮-১০ টাকা, মাছের ৭-৮ টাকা এবং ডিমের উৎপাদন খরচ ১ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সাশ্রয়ী মূল্যের ডিম ও মুরগির মাংস সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে, রপ্তানি সম্ভাবনা বিনষ্ট হবে, দেশীয় পোল্ট্রি শিল্পের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়বে, এসডিজি বাস্তবায়ন বিঘিœত হবে এবং গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খামারিরা খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন।
ওয়ার্ল্ডস পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখার (ওয়াপসা-বিবি) সাবেক সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ অঞ্জন বলেন- শীতকাল আসন্ন। তাই এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড-ফ্লু জীবানু সংক্রমণের আশংকায় চিন্তিত পোল্ট্রি সেক্টর; কারণ বিগত দু’বছর যাবৎ ঐ৯ঘ২ ভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা আমদানির অবেদন করা হলেও আজও তার অনুমতি মেলেনি।
তিনি বলেন- ২০০৭, ২০০৯ কিংবা ২০১১ সালের তুলনায় বর্তমানে পোল্ট্রি বার্ডের সংখ্যা প্রায় ২ কোটিরও অধিক বৃদ্ধি পেয়েছে; তাছাড়া সোনালী মুরগির সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে রোগ-জীবানুর প্রকোপ আগের চেয়ে বেড়েছে। তাই পোল্ট্রি শিল্পকে রক্ষার স্বার্থে ‘বিশেষ বিবেচনায়’ দ্রুততার সাথে আমদানি অনুমতি দেয়া দরকার।
বিপিআইসিসি’র সভাপতি মসিউর রহমান বলেন- বন্দরে যে পণ্য খালাস করতে ৭ কর্ম দিবসের অধিক সময় লাগা উচিত নয় ল্যাব টেস্টের জটিলতায় তা খালাস করতে ২০ থেকে ৪২ দিন পর্যন্ত সময় লাগছে। এতে বিশাল অঙ্কের বিলম্ব মাশুল গুনতে হচ্ছে।
তিনি বলেন- সিঙ্গেল ডিজিট লোন সুবিধা পাচ্ছেন না প্রান্তিক খামারিরা। তাছাড়া বিদ্যুৎ বিলের ওপর আগে যে ২০ শতাংশ হারে রেয়াত পাওয়া যেত সাম্প্রতিক সময়ে সে সুবিধা দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড।
জনাব মসিউর বলেন- দেশের লাখো খামারি ও শিল্প উদ্যোক্তা আজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে পুনরায় জীবন ফিরে পাবে দেশের পোল্ট্রি ও প্রাণিসম্পদ খাত।
ফার্মসএন্ডফার্মার২৪/জেডএইচ