প্রান্তিক খামারি ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে কোম্পানি!

196

কোন পূর্বাভাস না দিয়েই হটাৎ খাদ্যের দাম দফায় দফায় বাড়ানোর কিছু কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে এগ্রিকেয়ারের অনুসন্ধানে। খাদ্যের দাম যেন পোল্ট্রি খামারিদের ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়া’। ৫০ কেজি ওজনের প্রতিবস্তা খাদ্যে দাম গত সপ্তাহে বেড়েছে ১০০ টাকা। কোন কোন কোম্পানি আড়াই টাকা বাড়িয়েছে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রান্তিক খামারিদের এই সেক্টর থেকে উৎখাত করে কিছু কোম্পানির কাছে একক কেন্দ্রীভূত করাই সিন্ডিকেটের মূল লক্ষ্য।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, নারিশ ফিড, সিপি বাংলাদেশ, প্যারাগন ফিড, আমান ফিড, নিউ হোপ, এজি এগ্রো, নাহার, এলিয়া ফিড, কেএনবি, ফ্রিডম এগ্রো, সানরাইজ পোল্ট্রি ফিড, বুস্টার ফিডসহ অন্যান্য পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্টানগুলোর প্রতিকেজি খাদ্যে বেড়েছে ২ টাকা। যা হিসেব করলে বস্তাপ্রতি বেড়েছে ১০০ টাকা। খামারিরা বলছেন, করোনাকালের শুরু থেকে প্রতিবস্তা পোল্ট্রি খাদ্যে ৭০০ থেকে ৮৫০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ২১’শ টাকার খাদ্যের বস্তা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ২৮’শ ৫০ টাকায়।

জানতে চাইলে নারিশ কোম্পানির ডেপুটি ম্যানেজার ডা. আব্দুর রহমান বলেন, “ খাদ্যের দাম বাড়তেই আছে। বর্তমানে নারিশের একবস্তা খাদ্যের দাম ৩১’শ৬৭ টাকা। প্রতিকেজি খাদ্যের দাম পড়ে ৬৩ টাকা ৩৪ পয়সা। গত কয়েক মাসে ৭-৮ বার বেড়েছে খাদ্যের দাম। কমবে বলে মনে হয়না। খাদ্যের কাঁচামাল বাইরে থেকে আমদানি করতে হয় ফলে খরচ বেড়ে যাওয়ায় দাম বাড়ছে। আমাদের কিছু করার নাই।”

ফের খাদ্যের দাম বাড়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন পোল্ট্রি খামারিরা। সেইসাথে পোল্ট্রি খাত হুমকির মুখে পড়বে বলেও মনে করছেন উদ্যোক্তা ও শিল্প সংশ্লিষ্টরা। বন্ধ হয়ে যেতে পারে হাজার হাজার পোল্ট্রি খামার, অস্বাভাবিক বাড়তে পারে পোল্ট্রি পণ্যের দাম। বাড়তি দামে খাদ্য, ভ্যাকসিন, খামারের কর্মচারীর বেতন, সেই অনুযায়ী ডিম ও মাংসের দাম না থাকায় সবমিলিয়ে নাজেহাল খামারিরা। বর্তমানে খুচরা বাজারে প্রতিপিস লাল ডিম ১০ টাকা বিক্রি হলেও খামারিদের পকেটে ঢুকছে মাত্র ১ টাকা। খামারি পর্যায়ে ৮ টাকার বেশি দাম পান না তারা। প্রতি ডিমে উৎপাদন খরচ হয় ৭ টাকা। ফলে “লাভের ভাগ টিয়াতে খায়” বলেই মন্তব্য তাদের। লাভের ভাগ যায় ফড়িয়া আর ডিলারের পকেটে!

খাদ্যের দাম বাড়ানো বিষয়ে প্রতিষ্টানগুলো বলছে, খাদ্য তৈরির কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় মূলত বেড়েছে খাদ্যের দাম। আমদানি করা সয়াবিন তেল, ভুট্টা, রাইস পলিসের দাম বেড়েছে। খাদ্য উৎপাদনে বাড়তি খরচ হলে খাদ্যের দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক বলে মন্তব্য করছেন তারা। আসলেই কি খাদ্যের দাম এতটা বৃদ্ধির কারণ আছে কিনা অনুসন্ধান করে এগ্রিকেয়ার।

অনুসন্ধানে জানা যায়, একটা সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে পোল্ট্রি খাত ধ্বংসের মুখে পৌঁছে গেছে। সরকারি ভাবে কোন সিন্ডিকেট রোধে পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি ৩ থেকে ৫ লাখ করে মুরগি পালন করছে। তাদের নিজস্ব বাচ্চা, খাদ্য, আধুনিক পরিচর্যা সবমিলিয়ে উৎপাদন খরচ পড়ছে কম। কিন্তু তারা ব্যবসায় লাভবান হচ্ছে ঠিকই অন্যদিকে খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় খামার বন্ধ করে দিচ্ছেন প্রান্তিক খামারিরা। আবার, যেসব খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ঋণের দায়ে সেসব খামারকে দাদন দিয়ে কন্টাক্ট করে নিচ্ছে কিছু সিন্ডিকেট। যারা খামারের মালিককে শ্রমিক বানিয়ে ছাড়ছে।

ঘটনার সতত্য স্বীকার করেছেন এক খামারি। রাজশাহী বিভাগের ডিমের দাম নির্ধারণ করেন জয়নাল আবেদীন। যিনি প্রতিদিনের ডিমের দাম নির্ধারণ করে দেন। জয়নাল আবেদীন বলেন,“ বড় বড় কোম্পানি ছোট ছোট প্রান্তিক খামার বন্ধের জন্য দায়ী। একসময় মার্কেটে বিক্রি হবে ডিম-মুরগি। তখন তারা ইচ্ছামতো দাম বাড়াবে। এটাই তারা চায়। তখন একটা ডিম ১৫ টাকা ২০ টাকা হলেও খেতে বাধ্য হবে মানুষ।”

পোল্ট্রি সেক্টরের সাথে জড়িতদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে একটি ডিমের উৎপাদন ও তা’ পাইকারী পর্যায়ে বিক্রি পর্যন্ত খামারীদের খরচ পড়ে ৭ টাকার বেশি। সেইসাথে আশানুরুপ দাম না পাওয়ায় লোকসান না হলেও এভাবে চলতে থাকলে খামারে কর্মরত শ্রমিক, মুরগির ভ্যাকসিন, খাদ্যেও দাম বৃদ্ধি সব মিলিয়ে ব্যবসা পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়বে। কয়েকমাসে তা মূলধনে আঘাত করবে। ইতোমধ্যে কিছু প্রান্তিক খামরি ব্যবসা ধরে রাখতে ব্যাংক ঋণ, এনজিও, ধার-দেনা ছাড়াও জমি বিক্রি করেছেন বলে জানা গেছে।

বস্তাপ্রতি খাদ্যের দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে সিপি লিমিটেডের সিনিয়র কাস্টমার অফিসার হালিমা খাতুন বলেন,“আমি এ বিষয়ে কথা বলবনা। আমার ম্যানেজার স্যারের সাথে কথা বলুন।”

কথা হয় ম্যানেজারের সাথে। তিনি বলেন, “সবকিছুর দাম বেশি তাই খাদ্যের দাম বাড়ছে। আপনারা আমাদের কাছে খোঁজ নিচ্ছেন কেন? সব কোম্পানির কাছে খোঁজ নেন। সবাই দাম বাড়িয়েছে-আমরা একাই না। আর এ বিষয়ে কথা বলবনা। আগামী শনিবার কল দিয়েন।”

বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মোহসিন বলেন, পোল্ট্রি খাদ্য তৈরির কাঁচামাল সয়াবিন, ভুট্টাসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে। সেক্ষেত্রে প্রডাকশন কমে যাওয়ায় প্রভাব পড়েছে আমাদের ওপর। খাদ্যের মানও আগের মতো নেই। ইউরোপ ও চীন থেকে মূলত এসব পণ্য আমদানি করতে হয়। সেখানেই দাম বেড়েছে তাই খাদ্যের দামও বেড়েছে।

হটাৎ খাদ্যের দাম বাড়ার ফলে খামারিদের সমস্যা ও সরকারের ভূমিকা বিষয়ে এই নেতা এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, সরকারের উচিত পোল্ট্রি সেক্টরকে তদারকি করা। এদিকে নজর দেওয়া এখন সময়ের দাবি। যদি এখন এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তাহলে পোল্ট্রি খামারিরা নিঃস হয়ে পড়বে। লোকসানে জীবনের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে যাবে। কোম্পানির কাছে জিম্মি হয়ে যাবে কোটি জনগণ। তখন তাদের বেঁধে দেওয়া দামেই ডিম-মুরগি কিনতে হবে। সূত্র: এগ্রিকেয়ার।

ফার্মসএন্ডফার্মার/২৭মে ২০২২