ফলদ বৃক্ষের চারা রোপণ কৌশল ও ব্যবস্থাপনা

1399

004

পুষ্টি চাহিদা পূরণ, মেধার বিকাশ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। ফল আমাদের ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। গবেষকদের মতে জনপ্রতি প্রতিদিন ১১৫ থেকে ১২৫ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন, কিন্তু আমরা খেতে পাচ্ছি মাত্র ৩৫ থেকে ৪৫ গ্রাম। এর মূল কারণ চাহিদার তুলনায় যোগানের সীমাবদ্ধতা। তাই বৈজ্ঞানিক উপায়ে ফলের বাগান সৃজন করে সারা বছর ফল খাওয়ার সুযোগ তৈরিতে ফলদ বৃক্ষরোপণ অত্যাবশ্যক। ফলদ গাছ রোপণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হয়। ফলদ গাছের চারা রোপণের নানাবিধ কৌশল নিয়ে নিচে আলোচনা করা হয়েছে।

আদর্শ চারার বৈশিষ্ট:

চারা নির্বাচনের সময় কতকগুলো বিষয় খুবই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা দরকার। সে বিষয়গুলো হলো ভাল এবং কাঙ্ক্ষিত জাতের চারা; কলমের চারা হলে মাতৃ গুণাগুণ সঠিক, অল্প সময়ে ফলন দেয় এমন চারা; বিশ্বস্ত সরকারি কিংবা বেসরকারি নার্সারি থেকে চারা সংগ্রহ; রোগমুক্ত ও সুস্থ সবল চারা; সঠিক বয়সের চারা অর্থ্যাৎ চারার বয়স ০১ হতে ০২ বছর হলে খুবই ভালো; চারার কান্ড মোটা, খাটো ও মূলের বৃদ্ধি সুষম; কাণ্ড ও শিকড়ের অনুপাত ৪ঃ ১ হলে ভালো; চারার মূল শিকড় অবশ্যই অক্ষত ও ভাল; চারার কাণ্ডটি ২ থেকে ৩টি শাখা প্রশাখা বিশিষ্ট হলে ভাল এবং চারা অবশ্যই খাড়া; শক্ত ও মজবুত জোড়া বিশিষ্ট চারা কলম; তাছাড়া চারা গাছে ফুল, ফল না থাকাই উত্তম। ফলের চারা সংগ্রহের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে।

চারা রোপণের সময়:

চারা রোপণের সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে সাধারণত সারাবছরই ফলের চারা লাগানো যায়। তবে বর্ষার আগে অর্থ্যাৎ বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাস এবং বর্ষার পরে সাধারণত ভাদ্র-আশ্বিন মাসে চারা রোপণের উৎকৃষ্ট সময়। যে কোন গাছের চারা রোপণ করার সর্বোত্তম সময় দিনের শেষভাগে অর্থ্যাৎ পড়ন্ত বিকেল বেলায়। বর্ষার শুরুতে বা প্রথম বৃষ্টির পরপরই চারা লাগানো উচিত হবে না। কারণ প্রথম কয়েকদিন বৃষ্টির পরপরই মাটি থেকে গরম গ্যাসীয় পদার্থ বের হয় যা চারা গাছের জন্য খুবই ক্ষতিকর এমনকি চারা মারা যেতে পারে।

চারা বা কলম রোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণ কৌশল:

চারা রোপণের জন্য শুরুতেই সঠিক জায়গা নির্বাচন করা উচিত। যেখানে সরাসরি সূর্যের আলো পড়ে, বন্যামুক্ত উঁচু জায়গা নির্বাচন করে জায়গাটি ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। ফলদ গাছের ধরন ও জাতভেদে নির্দিষ্ট দূরত্বে চারা রোপণ করতে হবে। পরবর্তীতে চারা রোপণের জন্য বড়সড় আয়তনের একটি গর্ত খনন করতে হবে। বড় আকারের গর্তের আয়তন লম্বায় ৯০ সেমি, প্রস্থে ৯০ সেমি এবং গভীরতায় ৯০ সেমি হবে। বড় আকৃতি গর্তে সাধারণত আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, নারিকেল এসব গাছের লাগানো হয়। মাঝারি আকৃতির গর্ত লম্বায় ৭৫ সেমি, প্রস্থে ৭৫সেমি এবং গভীরতায় ৭৫ সেমি হবে। ছোট আকৃতির গর্ত লম্বায় ৪৫ সেমি, প্রস্থে ৪৫ সেমি এবং গভীরতায় ৪৫ সেমি হবে।

ছোট আকৃতির গর্তে সাধারণত কলা, পেঁপে, কমলা, মাল্টা এসব গাছ লাগানো হয়ে থাকে। গর্ত খনন করার সময় নিচের মাটি একদিকে এবং উপরের মাটি অন্যদিকে রাখতে হবে। গর্তের উপরের মাটির সাথে চারা গাছের প্রকার ও জাতভেদে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সার যথা ইউরিয়া সার (৩০০-৫০০ গ্রাম), টিএসপি সার (২৫০-৪০০ গ্রাম), এমওপি সার (২০০-২৫০ গ্রাম), জিংক সার (৫০-১০০ গ্রাম) ও বোরণ সার (১০-২০ গ্রাম) ব্যবহার করতে হবে। তবে অবশ্যই পঁচা গোবর (১৫-২০ কেজি) বা কম্পোস্ট মাটির সাথে খুব ভালোভাবে মিশিয়ে ব্যবহার করতেই হবে। সার মিশানোর পরে ১০-১৫ দিন পর চারা রোপণ করতে হয়। মাটি শুকনো হলে পানি দিয়ে হালকা ভিজিয়ে নিলে ভালো হবে। গর্তে মাটি ভালোভাবে বসিয়ে মাঝখানে কিছু উঁচু করে নিতে হবে।

নার্সারি থেকে চারা সংগ্রহের পরপরই চারাগুলোকে ছায়াযুক্ত জায়গায় কয়েকদিন শুয়ে রাখতে হবে। এই অবস্থাকে চারা গাছের হার্ডেনিং বা সহিষ্ণুকরণ/শক্তকরণ বলা হয়। হার্ডেনিং এর ফলে চারা গাছের মরে যাওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে যায়। এ অবস্থায় মাঝে মাঝে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, চারার গোড়ায় লাগানো মাটির চাকাটি যেন কোনভাবেই ভেঙ্গে না যায়। চারা লাগানোর আগে রোগাক্রান্ত, জীর্ণ পাতা ও লিকলিকে ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে। তারপর সতেজ, সবল, রোগমুক্ত, সোজা এবং কম শাখা প্রশাখা বিশিষ্ট চারা অর্থ্যাৎ আদর্শ চারা নির্বাচন করতে হবে চারায় সংযুক্ত পলিব্যাগ এমনভাবে অপসারণ করতে হবে যাতে চারার গোড়ার মাটির চাকা ভেঙে গুড়িগুড়ি না হয়ে যায়।

তারপর চারার গোড়ার মাটির চাকাসহ চারাটি গর্তে আস্তে আস্তে আলতো করে অত্যন্ত যতœ সহকারে বসিয়ে দিতে হবে। চারার গোড়ার চারপাশে কোঁকড়ানো বা আঁকাবাঁকা শিকড় কেটে দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, বীজতলায় চারাটির যতটুকু অংশ মাটির নিচে ছিল রোপণের সময় ঠিক ততটুকু অংশ মাটির নিচে রাখতে হবে। তারপর চারার চারপাশে ফাঁকা জায়গায় প্রথমে উপরের উর্বর মাটি এবং পরে নিচের মাটি দিয়ে ভালোভাবে পূরণ করে দিতে হবে। চারপাশের মাটি ভালোভাবে চেপে ঠেসে দিতে হবে যাতে কোনো ফাঁকা জায়গা না থাকে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো সদ্য লাগানো চারায় খুঁিট দেওয়া। চারা যেন হেলে না পড়ে সে জন্য শক্ত খুঁটি মাটিতে পুঁতে চারার সাথে এমনভাবে বেঁধে দিতে হবে যেন চারা খুঁটির সাথে লেপ্টে লেগে না থাকে। চারা রোপণের পরপরই চারার গোড়ায় ও পাতায় পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। গবাদি পশু যথা ছাগল, গরু, ভেড়া এসবের হাত থেকে চারাকে রক্ষা করার জন্য খাঁচা দিতে হবে। মনে রাখা জরুরী, কথায় আছে ছাগলের দাতে নাকি বিষ থাকে অর্থ্যাৎ ছাগল যদি চারা গাছ খেয়ে ফেলে তাহলে তা আর মাথা উঁচু করে সোজা হয়ে দাড়াতেই পারে না। নতুন কুঁড়ি বা পাতা বের না হওয়া পর্যন্ত সার প্রয়োগ করা ঠিক হবে না। গাছের বৃদ্ধি আশানুরুপ না হওয়া পর্যন্ত ফুল ফল ভেঙ্গে দিতে হবে।

চারা গাছ লাগানোর পর কোনো কারণে মারা গেলে দ্রুত নতুন চারা ঐ গর্তে রোপণ করতে হবে। রোপণকৃত চারায় পোকা বা রোগে আক্রান্ত হলে সাথে সাথে বালাই দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে। গাছের আকার আকৃতি সুন্দর ও ফলন বৃদ্ধি করার জন্য অঙ্গছাঁটাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সিকেচার দিয়ে নিয়মিতভাবে রোপণের দুবছরের মধ্যে পার্শ্ব শাখা, চিকন, নরম ও রোগা শাখা কেটে দিতে হবে। সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে চারার বড় হওয়ার সাথে সাথে প্রতি বছর সারের পরিমাণ ১০ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে। ফলন্ত গাছে অন্তত বছরে দুইবার সার দিতে হয়। একবার বর্ষার আগে এবং আরেকবার বর্ষার পরে। সুষম সার অবশ্যই জৈব এবং রাসায়নিক সারের সমন্বেেয় দিতে হবে। বড় গাছের গোড়া থেকে কমপক্ষে ১-২ মিটার দূরত্ব (গোড়ার কাছাকাছি অংশ যেন অক্ষত থাকে) পর্যন্ত মাটি কোঁদাল দিয়ে ঝুরঝুরি করে সার ভালোভাবে মিশিয়ে দেওয়া উচিত। সার দেয়ার পর পানি ছিটিয়ে দিতে হবে।

ফলগাছে রোগবালাইয়ের দ্বারা গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত, ফুল ফল ধারণে ব্যাঘাত এবং ফলনে অনাকাঙ্খিত প্রভাব পরে। তাই পরিচ্ছন্ন ও পরিকল্পিত চাষাবাদ করতে হবে। তাছাড়া সুস্থ, সবল চারা রোপণ, সুষম সার ব্যবহার, আগাছা দমন, সেচ বা নিকাশ, শীতের পর বাগান চাষ দেয়া, অঁঙ্গছাটাই করা ও প্রয়োজন হলে অনুমোদিত বালাইনাশক সঠিক মাত্রায়, সঠিক নিয়মে ও সঠিক সময়ে ব্যবহার করতে হবে।

বাড়ির আঙ্গিনায় অন্তত ১২টি ফল গাছ লাগান, যেন সারা বছর ধরেই ফল খেতে পারেন। মাল্টা গাছ জানুয়ারি মাসে ফল পাকে, ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য কুল গাছ, মার্চ মাসে বেল পাকে, এপ্রিলের জন্য তরমুজ, কালোজাম কিন্তু মে মাসেই খাওয়া যায়, আম লিচুসহ নানাবিধ ফল জুন মাসে, জুলাই মাসের জন্য কাঁঠাল, পেয়ারা আগস্ট মাসে, সেপ্টেম্বর মাসে আমড়া, অক্টোবর মাসে জলপাই, নভেম্বর মাসে ডালিম এবং ডিসেম্বর মাসে কমলা পাওয়া যায়। তাই একটু পরিকল্পনা করে ফল গাছ রোপণ করুন।

বাড়ির আঙ্গিনা, পতিত জমি, টিলা, পাহাড়ী এলাকা খালি না রেখে আজই পরিকল্পিতভাবে ফলগাছের চারা রোপণ করুন। আপনি ভাল থাকুন, আপনার পরিবারকে সুস্থ রাখুন। দেশি ফলে পুষ্টি বেশি তাই বেশি বেশি দেশি ফলের গাছ লাগান।

লেখক: কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ, আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, সিলেট।

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪.কম/এম