ফলের নাম রাম্বুটান

2536

Rambutan

রাম্বুটান। ইংরেজিতে Rambutan আর এর বৈজ্ঞানিক নাম Nephelium lappaceum. এটি প্রধানত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ফল। এটি আমাদের দেশের লিচুর মতো সুস্বাদু , সুমিষ্ট, সুগন্ধযুক্ত, রসালো এবং লোভনীয় একটি ফল। মালয়-ইন্দোনেশিয়া এর আদি জন্মস্থান। ২২-৩০° সে. তাপমাত্রা রাম্বুটানের জন্য অধিক উপযোগী।

ফলটি দেখতে অনেকটা ভেরেন্ডা ফলের মতো। গাঢ় সবুজ রঙের ভেরেন্ডা বীজের বহিরাবরণে থাকে নরম কাঁটা। ভেরেন্ডার বীজ থেকে ক্যাস্টর ওয়েল প্রস্তুত করা হয় যা গ্রিজ তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সবুজ খোসাযুক্ত এই ভেরেন্ডা বীজের সাথে রাম্বুটানের কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ইন্দোনেশিয় ভাষায় rambut শব্দের অর্থ hair বা চুল। ফলের খোসায় চুলের ন্যায় বস্তু থাকায় ফলটির এমন নামকরণ করা হয়েছে।

অত্যন্ত সুস্বাদু ও সুমিষ্ট এ ফলটি পাকলে সবুজাভ হলদে রঙ ধারণ করে। প্রজাতিভেদে হালকা লাল, বাদামী এমনকি কালচে রঙের রাম্বুটানও দেখা যায়। ফলের খোসায় নরম কাঁটার মতো লোম/চুল থাকায় আমাদের দেশে অনেকে একে ‘দাঁড়িওয়ালা লিচু’ নামকরণ করেছে।

রাম্বুটান একটি চির সবুজ গাছ। প্রজাতিভেদে এ গাছের উচ্চতা ১০ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত হয়। পাতার দৈর্ঘ ১০-৩০ সে.মি। ফলের দৈর্ঘ্য হয় ৩ থেকে ৬ সেমি. আর ফলের বেড় হয় ৩ থেকে ৪ সেমি. পর্যন্ত। ফুল খুবই ছোট ২.৫ থেকে ৫ মিলি মিটার হয়ে থাকে। বীজের সাইজ হয় ১ থেকে ১.৩ সে. মিটার। প্রতি থোকায়১০ থেকে ২০ টি পর্যন্ত ফল ধরে।

পুরুষ ফুল এবং স্ত্রী ফুল আলাদা আলাদা গাছে হয়। আবার কিছু গাছ আছে যাতে একই সাথে পুরুষ ও স্ত্রী ফুল ফোটে। রাম্বুটানের ফুলে প্রচুর পরিমাণে নেকটার বা পুষ্পরস থাকে। আর পুষ্পরস আহরণের জন্য প্রচুর মৌমাছি আসে। মৌমাছি এবং অন্যান্য কীট পতঙ্গের মাধ্যমে প্রধানত রাম্বুটান ফলের পরাগায়ণ সংঘটিত হয়। এ ফুলের মধু খুবই উন্নত মানের।

প্রাপ্ত বয়ষ্ক প্রতিটি গাছে বছরে ৫০০০ হতে ৬০০০ ফল আসে। যার ওজন হয় ৬০ থেকে ৭০ কেজি। হেক্টর প্রতি ফলন ২০ টন। ফল পাকার পর গাছ থেকে সংগ্রহ করতে হয়, তা না হলে ফলের মিষ্টতা কমে যায়। ফুল আসার পর থেকে ফল সংগ্রহ পর্যন্ত সময় লাগে ১৫ থেকে ১৮ সপ্তাহ।

রাম্বুটান ফল গোলাকার ও ডিম্বাকৃতির হয়ে থাকে। খোসা ছাড়ানোর পর যে শাঁষ পাওয়া যায় তার রঙ সাদা। শাঁস খাওয়ার পর যে বীজটা থাকে তা ফেলে না দিয়ে বাদামের ন্যায় ভেজে খাওয়া হয়। ভাজা বীজও বেশ সুস্বাদু। রাম্বুটান গাছে সাধারণত বছরে দুইবার ফল আসে। প্রথমবার ফল পাকে জুন-জুলাই মাসে আর দ্বিতীয়বার ডিসেম্বর মাসে।

সমগ্র পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ মে.টন রাম্বুটান উৎপাদিত হয় তন্মধ্যে থাইল্যান্ড একাই করে ৫৫% বা ৫.৮৮ লক্ষ মে.টন। এরপর ইন্দোনেশিয়া ৩.২০ লাখ মে. টন, মালয়েশিয়ায় ১ লাখ ২৬ হাজার মে.টন রাম্বুটান উৎপাদিত হয়।

এছাড়া কোস্টারিকা, ফিলিপাইন, মিয়ানমার, ভারত, শ্রীলংকা, হন্ডুরাস, ক্যারাবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশে রাম্বুটান উৎপাদিত হয়।

সাধারণত পাকা ফলের খোসা ছাড়িয়ে নিয়ে ভেতরের শাঁস সরাসরি খাওয়া হয়। ফলের রস অত্যন্ত সুস্বাদু যা বোতলজাত বা টিনজাত করেও বাজারে বিক্রয় হয়। বিভিন্ন ধরনের খাবার যেমন টফি, চকোলেট, জ্যাম জেলি এর রস থেকে তৈরি করা হয়।

রাম্বুটান উচ্চ পুষ্টিমান সমৃদ্ধ একটি ফল। প্রজাতিভেদে শর্করার পরিমাণ থাকে ২০-২৫%, হজমযোগ্য আঁশ থাকে ১% এছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ বিদ্যমান থাকায় এটি অনেক ধরনের রোগ প্রতিরোধ এবং নিরাময়ে সহায়তা করে।
শরীরের ক্ষতস্থান পূরণ, জ্বর কমানো আমাশয়রোগ প্রতিরোধে রাম্বুটান ফল খাওয়া হয়। এ ফল ডায়রিয়া ও আমাশয় প্রতিরোধক ও কৃমি নাশক হিসেবে কাজ করে। কাশি, পেটব্যথা, টিউমার এবং গ্লান্ডের বৃদ্ধি দমনের ক্ষেত্রেও রাম্বুটান কার্যকর। গাছের শিকড়, বাকল ও ফুল পানিতে সেদ্ধ করে গড়গড়া করলে মুখের ও গলার ঘা সারে।

রাম্বুটানের উন্নত জাতগুলো হলো- Binjai, Labak bulus, Rapiah, Cimacan, Sinyonya (ইন্দোনেশিয়া), Choai Ang, Ya tow, Azimat, Ayer Mas (মালয়েশিয়া) পি-১, পি-৬, পি-২২ ইত্যাদি। Maharlika জাতের রাম্বুটানের আকার সবচেয়ে বড় এবং স্বাদে অনন্য, এর দামও তুলনামূলকভাব অনেক বেশি।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম সেন্টারে এ ফলের পরীক্ষামূলক উৎপাদন সফল হয়েছে। এছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে এবং দেশের বড় বড় নার্সারিগুলোতে এর চাষাবাদ শুরু হয়েছে। তারা এখন এর চারা বিক্রি করছেন। বীজ থেকে উৎপাদিত গাছে ফল আসতে ৫/৬ বছর সময় লাগে। কলমকৃত চারা থেকে উৎপাদিত গাছে ২/৩ বছরে ফল পাওয়া যায়।

১৯২৬ সালে থাইল্যান্ডের Surat Thani তে প্রথম রাম্বুটান গাছ লাগানো হয়। অথচ বর্তমানে থাইল্যান্ডই পৃথিবীর মোট উৎপাদনের ৫৫% উৎপাদনকারি দেশ। যেহেতু আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে এ ফলের চাষ হয় সেজন্য প্রায় একই ধরনের আবহায়ায় আমাদের দেশেও এ ফল উৎপাদনের উজ্জল সম্ভাবনা রয়েছে। প্রয়োজন শুধু যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা।

আরো পড়ুন: 

লেখক: আলী আশরাফ খান

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪.কম/এম