বকুল হাসান খাঁন, আইপিএম
ফাল্গুন মাসে বসন্তের শুরু। ঘন শীতকে বিদায় জানিয়ে বসন্ত শুরু হয় নতুন সাজে। ফাল্গুনের প্রকৃতি সত্যিই অতুলনীয়। গাছে গাছে নব পল্লবের সবুজ আভা, বনে বনে ফুলের সমাহার, কোকিলের মিষ্টি সুর, নির্মল বাতাস সবই ফাল্গুনের অপরূপ শোভা। ফাল্গুনে তাই সবার মনে বৈচিত্র্যময় আনন্দের দোলা। সুপ্রিয় পাঠক, ফাল্গুনের কৃষিতে করণীয় কাজ সম্পর্কে প্রথমেই ধান।
ধান
এখন বোরো ধানের বাড়ন্ত অবস্থা। ধঅনের চারার বয়স ৫০-৫৫ দিন হলে ইউরিয়া সার শেষ কিস্তি উপরি প্রয়োগ করুন। তবে সার দেয়ার আগে জমির আগাছা পরিষ্কার করুন এবং জমির পানি সরিয়ে নিন। অবশ্য আপনার ক্ষেতে গুটি ইউরিয়া দিয়ে থাকলে ইউরিয়ার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে না। মনে রাখবেন, ধানের কাইচ থোড় আসা থেকে শুরু করে ধানের দুধ আসা পর্যন্ত ক্ষেতে ৩/৪ ইঞ্চি পানি ধরে রাখা প্রয়োজন। এ সময় বোরো ক্ষেতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ হয়ে থাকে। রোগবালাই নিয়ন্ত্রণে রাখতে আইপিএম পদ্ধতি অবলম্বন করুন। আলোর ফাঁদ পেতে, পোকা ধরার জাল ব্যবহার করে, ক্ষতিকর, পোকার ডিমের গাদা নষ্ট করে, ক্ষেতে ডাল পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করে পোকা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এসব পদ্ধতিতে পোকা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না হলে কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সঠিক বালাইনাশক সঠিক পদ্ধতিতে সঠিক মাত্রায় সঠিক সময়ে প্রয়োগ করে পোকা নিয়ন্ত্রণ করুন। মনে রাখবেন, বালাইনাশক প্রয়োগ করে পোকা নিয়ন্ত্রণ হলো সর্বশেষ পন্থা। এ সময় বৃষ্টিনির্ভর উফশী আউশ হিসেবে বিআর ২০, বিআর ২১ এবং বিআর ২৪ জাতের চাষ করতে পারেন। এ জাতগুলো স্বল্প মেয়াদী এবং ফলনের দিক থেকে দেশী আউশের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। ছিটিয়ে বা সারিতে এগুলো বপন করা যায়। ছিটিয়ে বুনলে হেক্টরপ্রতি ৭০ কেজি এবং সারিতে বুনলে হেক্টরপ্রতি ৪৫ কেজি বীজ প্রয়োজন। এসব ধানের জন্য সারের মাত্রা হলো প্রতি হেক্টরে ইউরিয়া ১৩০ কেজি, টিএসপি ৯০ কেজি, এমপি ৭০ কেজি ও ৬০ কেজি জিপসাম এবং ১০ কেজি দস্তা সার। শেষ চাষের সময় ইউরিয়া তিন ভাগের একভাগ এবং অন্যান্য সার সবটুকু জমিতে দিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া পরবর্তীতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। চারার বয়স ৪০-৪৫ দিন হওয়া পর্যন্ত জমিতে যেন আগাছা না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখুন।
গম
ফাল্গুন মাসের দ্বিতীয় পক্ষ থেকে গম পাকা শুরু হয়। পাকা গম গাছ এ সময় খড়ের মতো রঙ ধারণ করে এবং বাতাসে এক রকম ঝনঝন আওয়াজ হয়। তবে গম ফসল কাটার আগে মাঠে যে জাতের চাষ করা হয়েছে সে জাত ছাড়া অন্য জাতের গাছ সতর্কতার সাথে তুলে ফেলতে হবে। নয়তো ফসল কাটার পর বিজাতের মিশ্রণ হতে পারে। বীজ ফসলের জন্য বিজাত বাছাই করা খুবই জরুরি। সকালে অথবা পড়ন্ত বিকেলে ফসল খুবই তাড়াতাড়ি মাড়াই-ঝাড়াই করে ফেলতে হবে। দেরি হলে বীজের আর্দ্রতা বেড়ে যেতে পারে। এতে রোগ-পোকার আক্রমণ বেশি হয়। সংগ্রহ করা গম বীজ ভালো করে শুকানোর পর ঠাণ্ডা করে সংরক্ষণ করুন।
ভুট্টা
জমিতে ৭০৮০% গাছের মোচা খড়ের রঙ ধারণ করলে এবং পাতার রঙ কিছুটা হলদে হলে মোচা সংগ্রহ করা যায়। বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে শুকনো আবহাওয়ায় মোচা সংগ্রহ করতে পারলে ভালো। সংগ্রহ করা মোচা ভালোভাবে শুকিয়ে নিন। ভুট্টার দানা মোচা থেকে ছাড়ানো বেশ কষ্টকর। অনেকে এ কাজটি হাত দিয়ে করে থাকেন। অবশ্য হস্তচালিত ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র কিনে অতি সহজে ভুট্টা ছাড়ানো যায়। যন্ত্রটির দামও খুব বেশি নয়। ভুট্টা গাছ জ্বালানি ও পশু খাদ্য উভয় ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ। তাই সতর্কতার সাথে গাছ তুলে শুকিয়ে সংরক্ষণ করুন ।খরিপ মৌসুমে ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এখনই ভুট্টার বীজ বপন করুন ও প্রয়োজনীয় যত্ন নিন।
পাট
ফাল্গুনের মাঝামাঝি থেকেই চৈত্রের শেষ পর্যন্ত পাটের বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। পাট চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করে আড়াআড়ি ৫-৬টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করে নিন। পাটের চাষ করতে চাইলে ভালো জাত নির্বাচন করুন। পাটের ভালো জাতগুলো হলো ও-৯৮৯৭,ওএম-১, সিসি-৪৫, বিজেসি-৭৩৭০, সিবিই-৩, বিজেসি-৮৩, সিভিএল-১, এইচসি-২, এইচসি-৯৫ এবং এইচ এস-২৪ স্থানীয় বীজ ডিলার/ব্যবসায়ীর সাথে যোগাযোগ করে জাতগুলো সংগ্রহ করতে পারেন। সারিতে বুনলে প্রতি হেক্টর জমিতে ৪-৫ কেজি বীজ লাগে। তবে ছিটিয়ে বুনলে প্রতি হেক্টরে সাড়ে ছয় থেকে সাড়ে সাত কেজি বীজ দরকার হয়। পাটের জমিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেমি. রাখতে হবে। পাট চাষের জন্য সারের মাত্রা হলো ইউরিয়া ১৬৬ কেজি (দুই কিস্তিতে), টিএসপি ২৫ কেজি, এমপি ৩০ কেজি, জিপসাম ৪৫ কেজি এবং দস্তা ১০ কেজি। ইউরিয়া সারের অর্ধেক এবং অন্যান্য সব সার শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে। আর বাকি অর্ধেক ইউরিয়া পরবর্তীতে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
শাকসবজি
এ সময় বসতবাড়ির বাগানে জমি তৈরি করে ডাঁটা, কলমিশাক, পুঁইশাক, করলা, ঢেঁড়স, বেগুন, পটল চাষের উদ্যোগ নিতে পারেন। তাছাড়া মাদা তৈরি করে চিচিঙা, বিঙা, ধুন্দুল, শসা, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়ার বীজ বুনে দিন। সবজি চাষের জন্য পর্যাপ্ত জৈবসার ব্যবহার করুন। অন্যান্য ফসল ঝড়-বৃষ্টিতে ফসলের ক্ষতি হওয়ার আগেই পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, তেল ও ডাল ফসল ক্ষেত থেকে সংগ্রহ করে শুকিয়ে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। চিনা, কাউনের শীষ বের হওয়ার সময় মাটিতে রসের পরিমাণ কমে গেলে সেচের ব্যবস্থা করুন। এ সময় জমিতে সবুজ সার ফসল বিশেষ করে ধৈঞ্চা চাষের উদ্যোগ নিতে পারেন।
গাছপালা
এ মাসে আমের মুকুল আসে। এজন্য আমের বোঁটায় রোগ/পোকার আক্রমণ থেকে সতর্ক থাকা উচিত। কাঁঠালের ফল পচা ও মুচি ঝরা সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই প্রয়োজনে রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। এ সময় বাডিং পদ্ধতিতে বরই গাছের কলম করা যায়। এজন্য প্রথমে বরই গাছ ছাঁটাই করতে হয় এবং পরে উন্নত বরই গাছের মুকুল ছাঁটাই করে দেশী জাতের গাছে সংযোজন করতে হয়।
মাছ
মাছ চাষের জন্য পুকুর তৈরি ও সংস্কার করার উপযুক্ত সময় এখন। শীতের পরে এ সময় মাছের বাড়বাড়তি দ্রুত হয়। তাই পুকুরে প্রয়োজনীয় খাবার দিন এবং জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন। মাছ চাষের ক্ষেত্রে স্থানীয় মৎস্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করুন।
পশুপাখি
গবাদিপশুর জন্য প্রয়োজনীয় ভ্যাক্সিন দিন এবং কৃমিনাশক খাওয়ান। গবাদিপশুকে উন্নত খাবার খেতে দিন, যেমন- সবুজ ঘাস, ইউরিয়া মোলাসেম স্ট্র, ইউরিয়া মোলাসেম ব্লক, সংরক্ষণ করা ভুট্টা গাছ এসব। হাঁস-মুরগির প্রয়োজনীয় ভ্যাক্সিন দিয়ে নিন এবং পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করুন। প্রিয় পাঠক, কৃষি একটি জটিল প্রক্রিয়া। তাই এক্ষেত্রে সবসময় সতর্ক থাকতে হয়। আপনার যে কোন সমস্যায় স্থানীয় কৃষিকর্মীর সাহায্য নিন। স্বনির্ভর দেশ গড়তে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করুন। আবার কথা হবে আগামী মাসে চৈত্রের নিয়ে। সবার সুন্দর জীবন কামনা করি। ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন। আল্লাহ হাফেজ
ফার্মসএন্ডফার্মার/২২ফেব্রু২০২০