ফুলকপির চাষাবাদ পদ্ধতি

825

ফুলকপি একটি পুষ্টিকর, সুস্বাদু ও আমাদের দেশে জনপ্রিয় সবজি। আমাদের দেশে চাষকৃত ফুলকপি অধিকাংশই সংকর জাতের এবং বিদেশ থেকে আমদানিকৃত যা স্থানীয় আবহাওয়ায় বীজ উৎপাদন করে না। ঠাণ্ডা ও আর্দ্রতা জলবায়ুতে ফুলকপির ভাল ফলন পাওয়া যায়। সেচ ও পানি নিষ্কাশনের সুবিধা আছে এমন ধরনের সব মাটিতে ফুলকপির চাষ ভাল হয়। আমাদের দেশে মাঘী, অগ্রহায়ণী, পৌষালী, বারি ফুলকপি-১, ২ ইত্যাদি বিভিন্ন জাতের ফুলকপি পাওয়া যায়। ফুলকপি বপনের উপযুক্ত সময় হল আগষ্ট ও সেপ্টেম্বর। প্রতি শতকে বীজের পরিমাণ দুই গ্রাম। বীজতলার জন্য ৩ ×১ মিটার মাপের ১৫ সে.মি. উঁচু বেড তৈরি করলে ভাল হয়। বীজতলার উপরের স্তরে ১:১ অনুপাতে পচা গোবর/আবর্জনা সার এবং দো-আঁশ মাটির মিশ্রণ ছড়িয়ে দিতে হবে। এরপর তিন-চার সপ্তাহ পলিথিন দিয়ে মাটি ঢেকে রেখে শোধনের পর পাঁচ সে. মি. দূরে দূরে লাইনে ছিটিয়ে ১০ গ্রাম বীজ বুনতে হবে। অতিবৃষ্টি ও রোদের ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য উপরে পলিথিন বা চাটাইয়ের আচ্ছাদন দিতে হবে। ১০ দিন পর দ্বিতীয় বীজতলায় পাঁচ সে.মি. পর পর সারি করে দুই সে.মি. দূরে দূরে শেষ বিকেলে স্থানানস্তর করতে হবে। দ্বিতীয় বীজতলায় চারা স্থানানস্তরের পাঁচ দিন পর বীজতলার চারায় প্রতি ১০ লিটার পানির সাথে ৩০ গ্রাম সোহাগা মিশিয়ে স্প্রে করা অত্যাবশ্যক।

জাত : এ দেশে এখন ফুলকপির পঞ্চাশটিরও বেশি জাত পাওয়া যাচ্ছে। শীতকালেই আগাম, মধ্যম ও নাবি মওসুমে বিভিন্ন জাতের ফুলকপি আবাদ করা যায়। আগাম চাষ করা যায় ফুলকপির এমন জাতগুলো হলো অগ্রহায়ণী, আর্লি পাটনা, আর্লি স্নোবল, সুপার স্নোবল, ট্রপিক্যাল স্নো ৫৫, সামার ডায়মন্ড এফ১, ম্যাজিক স্নো ৫০ দিন এফ১, হোয়াইট বিউটি, কেএস ৬০, আর্লি বোনাস, হিট মাস্টার, ক্যামেলিয়া, আর্লি মার্কেট এফ১, স্পেশাল ৪৫ এফ১, স্নো কুইন এফ১ ইত্যাদি। এসব জাতের বীজ শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে বপন করা যায়। মাঝ মওসুমের উপযুক্ত অনেক জাত আছে। এগুলো হলো বারি ফুলকপি ১ (রূপা), চম্পাবতী ৬০ দিন, চন্দ্রমুখী, পৌষালী, রাুসী, স্নোবল এক্স, স্নোবল ওয়াই, হোয়াইট টপ, স্নো ওয়েভ, মোনালিসা এফ১, ম্যাজিক ৭০ এফ১, বিগটপ, চন্দ্রিমা ৬০ এফ১, হোয়াইট ফ্যাশ, বিগশট, হোয়াইট কনটেসা ইত্যাদি। এসব জাতের বীজ ভাদ্র-আশ্বিন মাসে বপন করতে হয়। নাবি করে ফুলকপি চাষ করতে চাইলে মাঘী বেনারসি, ইউনিক স্নোবল, হোয়াইট মাউন্টেন, এরফার্ট ইত্যাদি জাত লাগানো যেতে পারে। এসব জাতের বীজ আশ্বিন-কার্তিক মাসে বপন করতে হয়।

চারা তৈরি : ফুলকপির চারা বীজতলায় উৎপাদন করে জমিতে লাগানো হয়। বীজতলার আকার এক মিটার পাশে ও লম্বায় তিন মিটার হওয়া উচিত। সমপরিমাণ বালু, মাটি ও জৈবসার মিশিয়ে ঝুরঝুরা করে বীজতলা তৈরি করতে হয়। দ্বিতীয় বীজতলায় চারা রোপণের আগে সাত থেকে আট দিন আগে প্রতি বীজতলায় ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১৫০ গ্রাম টিএসপি ও ১০০ গ্রাম এমওপি সার ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। পরে চারা ঠিকমতো না বাড়লে প্রতি বীজতলায় প্রায় ১০০ গ্রাম পরিমাণ ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দেয়া ভালো। প্রতি শতক জমিতে ফুলকপি চাষের জন্য এ রকম একখ বীজতলায় ২ থেকে ২.৫ গ্রাম বীজ বুনলেই চলবে।

চারা রোপণ : বীজ গজানোর ১০ থেকে ১২ দিন পর গজানো চারা দ্বিতীয় বীজতলায় স্থানান্তর করতে হয়। চারায় পাঁচ থেকে ছয়টি পাতা হলেই তা রোপণের উপযুক্ত হয়। সাধারণত ৩০ থেকে ৩৫ দিন বয়সের চারা রোপণ করা হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব দেয়া লাগে ৬০ সেন্টিমিটার বা দুই ফুট এবং প্রতি সারিতে চারা থেকে চারার দূরত্ব দিতে হবে ৪৫ সেন্টিমিটার বা দেড় ফুট। চারা রোপণের সময় সতর্ক থাকতে হবে যেন শিকড় মুচড়ে বা বেঁকে না যায়। এতে চারার মাটিতে লাগতে দেরি হয় ও বৃদ্ধি কমে যায়।

সার ব্যবহার: পচা গোবর জমি তৈরির সময় ৫০ কেজি দিতে হবে। প্রতি শতকে ইউরিয়া শেষ চাষের সময় ২৫০ গ্রাম, তার ২০ দিন পর ৫০০ গ্রাম এবং ৩৫ দিন পর ২৫০ গ্রাম। টিএসপি শেষ চাষের সময় ৭০০ গ্রাম দিতে হবে। এমপি শেষ চাষের সময় ২০০ গ্রাম, ২০ দিনপর ৩০০ গ্রাম এবং ৩৫ দিন পর ২০০ গ্রাম। জিপসাম জমি তৈরির সময় ৪০০ গ্রাম দিতে হবে। জিংক সালফেট শেষ চাষের পর ৪০ গ্রাম এবং সোহাগা শেষ চাষের সময় ৪০ গ্রাম।

২৫ থেকে ৩০ দিন বয়সের চারা সারি থেকে সারি ৫০ সে.মি. (২০ ইঞ্চি) এবং চারা থেকে চারা ৪০ সে.মি. (১৬ ইঞ্চি) দূরত্ব বজায় রেখে রোপণ করতে হবে। প্রথম ও দ্বিতীয়বার সার উপরি প্রয়োগের পর পরই সারির দু’পাশের মাটি আলগা করে গাছের গোড়ায় তুলে দিতে হবে। এতে সেচ ও নিষ্কাশন উভয় কাজে সুবিধা হবে। চারা রোপণের ৪৫ দিন পর কপি সংগ্রহ করতে হয়। শতকে ৬০-৮০ কেজি আর একরে ৬ থেকে ৮ টন ফুলকপি জন্মে।

সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনা : সার দেয়ার পরপরই সেচ দিতে হবে। এ ছাড়া জমি শুকিয়ে গেলে সেচ দিতে হবে। জমিতে পানি বেশি সময় ধরে যেন জমে না থাকে সেটাও খেয়াল করতে হবে। সার দেয়ার আগে মাটির আস্তর ভেঙে দিয়ে নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে।
বিশেষ পরিচর্যা : ফুলকপি গাছের সারি মাঝে সার দেয়ার পর সারির মাঝখানের মাটি তুলে দু’পাশ থেকে গাছের গোড়ায় টেনে দেয়া যায়। এতে সেচ ও নিকাশের সুবিধা হয়। তবে ফুলকপির ফুল সাদা রাখার জন্য কচি অবস্থায় চার দিক থেকে পাতা টেনে বেঁধে ফুল ঢেকে দিতে হবে। সূর্যের আলো সরাসরি ফুলে পড়লে ফুলের রঙ তথা ফুলকপির রঙ হলুদাভ হয়ে যাবে।

বালাই ব্যবস্থাপনা : এ দেশে ফুলকপির সবচেয়ে তিকর পোকা হলো মাথাখেকো লেদা পোকা। নাবি করে লাগালে সরুই পোকা বা ডায়মন্ড ব্যাক মথ বেশি তি করে। বীজ উৎপাদনের জন্য চাষ করলে পুষ্পমঞ্জরীকে জাব পোকার হাত থেকে রা করতে হবে। অন্যান্য পোকার মধ্যে ক্রসোডলমিয়া লেদা পোকা, কালো ও হলুদ বিছা পোকা, ঘোড়া পোকা ইত্যাদি মাঝে মাঝে তি করে থাকে। ফুলকপির পাতায় দাগ ও কালো পচা রোগ প্রধান সমস্যা। এ ছাড়া চারা ধসা বা ড্যাম্পিং অফ, কাব রুট বা গদাই মূল, মোজেইক, পাতার আগা পোড়া ইত্যাদি রোগও হয়ে থাকে। বোরন সারের অভাবে ফুলে বাদামি দাগ পড়ে ও কা ফাঁপা হয়ে যায়।

আবশ্যকীয় কার্যাবলী:
১. পানি নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত উঁচু জমিতে চাষ করতে হবে।
২. আগাছা দমন করতে হবে।
৩. সেচ ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৪. রোগ-বালাই দমনে উপযুক্ত ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
৫. অবশ্যই সোহাগা ব্যবহার করতে হবে। ৬. সঠিক বয়সের সুস্থ ও সবল চারা স্থানান-র, পরিমিত সার, সেচ ও অন্যান্য অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা সঠিক সময় ও নিয়ম অবশ্যই সম্পাদন করতে হবে।

ফসল তোলা ও ফলন : সাদা রঙ ও আঁটসাঁট থাকতে থাকতেই ফুলকপি তুলে ফেলা উচিত। মাথা ঢিলা ও রঙ হলদে ভাব ধরলে দাম কমে যায়। একরপ্রতি ফলন ১৫ থেকে ২৫ টন, হেক্টরে ৩৫ থেকে ৬০ টন।

কেঁচো সার দিলে ফুলকপি ভালো হয়
ফুলকপি প্রজাতির বিচারে দুই রকম। ইউরোপিয়ান এবং এশিয়ান টাইপ। প্রথম টাইপে কম তাপমাত্রায় ফুল হয়। দ্বিতীয় টাইপে বেশি তাপমাত্রায় ফুল তৈরি হয়। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মধ্যে ফুল পেতে হলে এশীয় টাইপ এবং পরবর্তী সময়ের জন্য ইউরোপিয়ান টাইপ রোপণ করতে হবে।

বীজ বপন ও চারা তৈরি : ঝুরঝুরে মাটি তৈরি করে প্রতি এক বর্গমিটার জায়গায় এক ঝুড়ি পচা গোবর সার প্রয়োগ করতে হবে। কেঁচো সার প্রয়োগ করলে চারার বৃদ্ধি ভালো হয়। রাসায়নিক সার বীজতলায় প্রয়োগ না করলেও চলবে।
মাটির ভেতরে থাকা ছত্রাক বিনাশ করতে ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা দরকার। সে ক্ষেত্রে জমি বীজতলা তৈরির ১৫ দিন আগে থেকে প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে, যাতে ভেতরের তাপমাত্রা বের হতে না পারে। সেপ্টেম্বর মাসে বীজতলা মাটি থেকে ১৫ সেন্টিমিটার উঁচুতে তৈরি করতে হবে। বিঘাপ্রতি ৪০ থেকে ৭০ গ্রাম বীজ দরকার।

বীজ লাইন করে রোপণ করলে চারা সুস্থ ও সবল হয়। একটি চারা থেকে অন্যটির দূরত্ব হওয়া দরকার পাঁচ থেকে সাত সেন্টিমিটার। বীজ ফেলার পাঁচ থেকে সাত সপ্তাহ পর চারা মূল জমিতে রোপণের উপযুক্ত হয়ে যায়। গোড়া পচা রোগ থেকে চারাকে রক্ষা করতে ডায়াথেন এস-৪৫-এর ০.২ শতাংশ দ্রবণ দিয়ে মাটি ভিজিয়ে নিতে হবে।

মূল জমিতে বিঘাপ্রতি দুই টন গোবর সার প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরির সময়ে ১৫ কেজি ইউরিয়া, ৬০ কেজি ফসফেট ও ১০ কেজি পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে। রোপণের আগে গোড়া অনুখাদ্যের দ্রবণে ভিজিয়ে নিলে বৃদ্ধি ভালো হয়।
জমি তৈরি করার সময় ১৫ কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে। অবশিষ্ট ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করতে হবে। সার জমিতে ছড়িয়ে না দিয়ে গাছের গোড়ার চারপাশে দিতে হবে।

অনুখাদ্যের অভাব মেটাতে চারা অবস্থায় গাছে ০.৩ শতাংশ বোরন স্প্রে করা যেতে পারে অথবা দেড় থেকে দুই কেজি বোরন মূল জমিতে স্প্রে করা যেতে পারে।

পরিচর্যা : মাটি বেশি শুকনো হয়ে গেলে হালকা সেচ দিতে হবে। ঘাসের উপদ্রব হলে চারা রোপণের আগে তা তুলে ফেলতে হবে। ফুলকপির নানা রকমের শারীরবৃত্তীয় উপসর্গ দেখা দিতে পারে, এর মধ্যে পাতা লম্বা হয়ে যাওয়া, ছোট ফুল, ফুল না আসা, ভ্যাদভেদে রোগ অন্যতম। বাদামি রোগ হয় বোরনের অভাবে।

মলিবডেনামের অভাবে পাতা সরু ও লম্বা হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে বোরন দেওয়ার পদ্ধতি আগেই বলা হয়েছে।
ফুলকপিতে বেশ কয়েকটি ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ দেখা যায়। এর মধ্যে ধসা রোগ, ক্লাব রট, ডাউনি মিলডিউ, পাতা পচা রোগ উল্লেখযোগ্য।

ধসা রোগ ঠেকাতে ডায়াযেন এম-৪৫-এর ০.২ শতাংশ দ্রবণে মাটি ভিজিয়ে নিতে হবে। পাতা পচা রোগ ঠেকাতে ব্যাকটেরিয়ানাশক দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হয়। এক ধরনের মাছির শুককীট রয়েছে যারা শিকড় খেয়ে ফেলে। এতে গাছ শুকিয়ে যায়। এ ধরনের সমস্যা হলে ম্যালাথিয়ন ০.০২ শতাংশ দ্রবণ স্প্রে করতে হবে।

ফসল : চারা রোপণের ৭০ থেকে ৮০ দিন পর ফসল সংগ্রহ করা যায়। ঠিকঠাকমতো চাষ করতে পারলে বিঘাপ্রতি দুই থেকে তিন টন ফুল পাওয়া যায়। শংকর প্রজাতির ক্ষেত্রে বিঘাপ্রতি সাত থেকে আট টন ফুল পাওয়া সম্ভব।

ফার্মসএন্ডফার্মার/১৮নভেম্বর২০২০