ময়মনসিংহ সদরের মৎস্য চাষি মনসুর আলী (৫৯) গুণগত মানের দেশি জাতের রেণু পোনার চাষ করে পেয়েছেন সফলতা। বছরে প্রায় দেড় কোটি টাকার মতো রেণু পোনা বিক্রি করেন তিনি। সব খরচ বাদে আয় করেন অর্ধ কোটি টাকার মতো। এছাড়া মাছ চাষে অবদানের জন্য দুই দুইবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন এই চাষি। সর্বশেষ জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উপলক্ষে গত ২৯ আগস্ট বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে মনসুরের হাতে তুলে দেওয়া হয় জাতীয় পুরস্কার।
জানা যায়, ময়মনসিংহ সদরের রঘুরামপুর গ্রামের প্রান্তিক কৃষক মরহুম ওয়াহেদ আলীর ছেলে মনসুর আলী ১৯৮৪ সালে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে রেনু ও পোনা সংগ্রহ করে চাষ শুরু করেন। প্রথমে নার্সারি, পরে বাণিজ্যিকভাবে হ্যাচারিতে পোনা চাষ শুরু করেন। প্রথম বছরেই খরচ বাদে ১৬ হাজার টাকা লাভের মুখ দেখেন। এরপর থেকেই পুরোদমে মাছ চাষে মনোনিবেশ করেন তিনি।
ময়মনসিংহ সদরের শম্ভুগঞ্জ রঘুরামপুরে দেশবন্ধু মৎস্য নার্সারি ও হ্যাচারি নামে বাণিজ্যিকভাবে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন মনসুর। নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে বর্তমানে ১৬টি পুকুরে পোনা ও ১২টি পুকুরে রয়েছে ব্রুড মাছ। এছাড়া রেনুর জন্য রয়েছে অর্ধশত হাউজ। তার দেশবন্ধু নার্সারি ও হ্যাচারিতে বিলুপ্তপ্রায় দেশি জাতের কৈ, শিং, মাগুর, গুলশা, গুজি, টেংরা, পাবদার রেনু ও পোনার চাষ হচ্ছে। মনসুরের গুণগত মানের রেনু ও পোনা সারাদেশের মাছ চাষিরা এসে নিয়ে যান।
আলাপচারিতায় মনসুর জানান, গরিব কৃষক পরিবারে জন্ম নিয়ে অভাবের কারণে প্রাইমারি স্কুল পাসের পর আর লেখাপড় করা হয়নি। লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার পর বাপের সঙ্গে কৃষি কাজে সহযোগিতা করার পাশাপাশি স্থানীয়দের কাছ থেকে মাছ সংগ্রহ করে শহরের বাজারে বিক্রি করা শুরু করেন। এরপরই মাছ চাষের প্রতি আগ্রহ বাড়ে। এভাবে পাঁচ হাজার টাকা আয় করে ১৯৮৪ সালে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে রেণু পোনা সংগ্রহ করে মাছ চাষ শুরু করেন। রেণু পোনা বিক্রি শুরু করে লাভের মুখ দেখেন তিনি। বছর না ঘুরতেই খরচ বাদে লাভ হয় ১৬ হাজার টাকা। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাননি।
তিনি আরও জানান, তার মাছ চাষের সফলতা দেখে বিএফআরআই কর্তৃপক্ষ তাকে অফিসে ডেকে নেয় এবং নানা সময়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করে। প্রশিক্ষণ পেয়ে তিনি গুণগত মানের রেণু পোনা উৎপাদনে সক্ষম হন।
মনসুর আরও জানান, মাছ চাষে লাভবান হয়ে আশপাশের কৃষকদের থেকে জমি বছর চুক্তিতে বন্ধক নিয়ে দেশবন্ধু মৎস্য নার্সারি ও হ্যাচারিকে বড় আকারে গড়ে তুলেন। সারা বছরের মধ্যে জানুয়ারি থেকে আগস্টের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত মাছের রেণু পোনা বিক্রি করেন মনসুর। বাকি সময় কেনাবেচা সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। এতে করে বছরের ৮ মাসে দেড় কোটি টাকার রেণু পোনা বিক্রি করে খরচ বাদে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা মুনাফা আসে তার।
মনসুরের খামারে স্থানীয় ২১ জন বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। এছাড়া আশপাশের মাছ চাষিরা এসে তার কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে যান। চার সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে সাদ্দাম হোসেন মনসুরকে ব্যবসার কাজে সহায়তা করেন। এছাড়া বাকিরা লেখাপড়া করছেন।
সফল এ চাষি জানান, মাছ চাষের আয় দিয়ে শম্ভুগঞ্জ বাজার মোড়ের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ১৮ শতক জায়গা কিনেছেন এবং বাড়ি করে সেখানেই বসবাস করছেন।
মনসুর বলেন, সরকারি আর্থিক সহযোগিতা কিংবা ব্যাংকের ঋণ ছাড়াই নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে পরিশ্রম আর মেধাকে কাজে লাগিয়ে মাছ চাষে সফলাতা পেয়েছি। এই সফলতায় ২০১০ সালে এবং ২০২১ সালে তাকে জাতীয় পুরস্কার হাতে উঠেছে। সততার সঙ্গে পরিশ্রম করলে যে কোনও কাজেই সফলতা আসে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দিলীপ কুমার সাহা জানান, ময়মনসিংহ সদরের মৎস্য চাষি মনসুর আলী মাছ চাষিদের জন্য রোল মডেল। শিক্ষিত না হয়েও তিনি মেধা ও পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে মাছ চাষকে শিল্প প্রতিষ্ঠানে রূপ দিয়েছেন। দেশীয় প্রজাতির মাছের রেণু ও পোনা চাষ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সফলতায় দুইবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। মনসুর আলীকে দেখে শিক্ষিত যুব সমাজ মাছ চাষে এগিয়ে আসবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ফার্মসএন্ডফার্মার/ ১০সেপ্টেম্বর ২০২১