রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী কলার বাজার বানেশ্বর হাট। সারি সারি করে সাজানো আছে নানা জাতের কাঁচাপাকা কলা। চলছে ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাক। দরদাম মিটিয়ে কলা কিনে মজুত করতে ব্যস্ত ব্যবসায়ীরা। এরপর ট্রাকে করে ছুটবেন দূরের কোনো জেলায় জোগান দিতে। শনি ও মঙ্গলবার বানেশ্বর, সোম ও বৃহস্পতিবার বসে ঝলমলিয়া হাট। এসব হাট থেকে কলা কিনে ব্যবসায়ীরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যায় আপন গন্তব্যে। বলা হয়, রাজশাহীর প্রধান অর্থকরী ফসল আম। এ তালিকায় কোনো অংশে কম নয় মিষ্টি পান। কিন্তু আম ও পান ছাপিয়ে সম্ভাবনাময় আরেকটি ফল হিসেবে উঁকি দিচ্ছে কলা। শুধু বানেশ্বরেই এক হাটে ১০ থেকে ১৫ হাজার কাঁদি কলা আমদানি হয়। সেই হিসেবে গড়ে ৪০০ টাকা কাঁদি ধরলেও বানেশ্বর হাটেই এক কোটি টাকার কলার বেচাকেনা হয় এখানে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, শীতকালে কম আমদানি হলেও গরমকালে কলার আমদানি বেশি হয়। প্রতি হাটে ১০ থেকে ১৫ ট্রাক কলা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। জেলার সবচেয়ে বড় এ কলার হাটে নিয়মিত বসে সাগর, অনুপম, সবরি, চাপা, জিন, আনাজিসহ বিভিন্ন স্বাদের কলা। যেখানে থেকে একদিনেই স্থানীয় অর্থনীতিতে যোগ হয় শত কোটি টাকারও বেশি।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যানুযায়ী, এ বছর (২০২২-২৩) রাজশাহী জেলায় কলা উৎপাদন হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার হেক্টর জমিতে, যা গত পাঁচ বছর আগে যেখানে এক হাজার ৯০২ হেক্টর জমিতে কলার আবাদ হত। পাঁচ বছরের ব্যবধানে কলার উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি। এতে সম্ভাব্য উৎপাদন ধরা হয়েছে ৮৮ হাজার ৬৫৩ মেট্রিক টন। কৃষি বলছে, রাজশাহীর ৯ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কলার আবাদ হয় পুঠিয়া উপজেলায়। এ উপজেলায় মোট এক হাজার দুই হেক্টর জমিতে কলার আবাদ হয়েছে। এ উপজেলাতেই বসে রাজশাহীর সবচেয়ে বৃহৎ, প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী কলার হাট। কলার আবাদ ও উৎপাদনে পুঠিয়ার পর দুর্গাপুরের অবস্থান। শুধু মাত্র পুঠিয়াতেই প্রায় ৭০০ হেক্টর জমিতে কলার আবাদ হয়। এছাড়া বাগমারা, পবা, চারঘাট ও বাঘায় প্রায় ৪০০ হেক্টর জমিতে কলার আবাদ হয়। তবে জেলার তানোর, মোহনপুর, গোদাগাড়ী ও চারঘাটে কলার আবাদ নেই বললেই চলে।
গত পাঁচ বছরের আবাদ ও উৎপাদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জেলায় ২০১৭-১৮ মৌসুমে এক হাজার ৯৬৭ হেক্টর জমিতে কলার উৎপাদন হয়েছিল ৬১ হাজার ৭৫৬ মেট্রিক টন। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ছিল ৩০.৬০ মেট্রিক টন। ২০১৮-১৯ মৌসুমে ২৫ হেক্টর জমিতে আবাদ বেড়ে মোট উৎপাদন দাঁড়ায় ৬৩ হাজার ৪৯১ মেট্রিক টন। ২০১৯-২০ মৌসুমে আবাদ কমে দাঁড়ায় এক হাজার ৯৬২ হেক্টরে। ওই বছর ফলনও কম হয়। তাতে মোট উৎপাদন হয় ৬২ হাজার ৪০৪ মেট্রিক টন। তবে ২০২০-২১ মৌসুমে উৎপাদন আবারও বাড়ে। ১ হাজার ৯৭৩ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয় ৬৪ হাজার ৬৩ মেট্রিক টন। আগের চেয়ে হেক্টরপ্রতি গড় ফলন বেড়ে দাঁড়ায় ৩২.৪৭ মেট্রিক টন। গত মৌসুমে (২০২১-২২) আকস্মিকভাবে বাড়ে কলার আবাদ ও উৎপাদন। এক বছরের ব্যবধানে রাজশাহী জেলায় ৪৩৭ হেক্টর জমিতে কলার আবাদ বৃদ্ধি পায়। আবাদি জমির ওপর ভিত্তি করে এক বছরের ব্যবধানে মোট উৎপাদন হয় ৭৮ হাজার ৭৮০ মেট্রিক টন, যা গত বছরের চেয়ে ১৪ হাজার ৭১৭ মেট্রিক টন বেশি। গড় ফলনও বেড়ে দাঁড়ায় ৩২.৮৯ মেট্রিক টন। চলতি মৌসুমে জেলায় কলা চাষ হচ্ছে ২৪৩০ হেক্টর জমিতে। এতে সাম্ভাব্য উৎপাদন ধরা হয়েছে ৮৮ হাজার ৬৫৩ মেট্রিক টন।
কৃষকরা জানান, এক বিঘা জমিতে কলার জাত ভেদে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ কলার চারা রোপণ করা হয়। যতœসহকারে কলা চাষ করলে ফলন ভালো পাওয়া যায়। এক বিঘা জমিতে কলা চাষ করতে ৩০-৪০ হাজার টাকা খরচ পড়লেও প্রতি বিঘা জমি থেকে কলা বিক্রি হয় ৮০ হাজার থেকে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা আয় করা সম্ভব, যা অন্য কোনো ফসলে সম্ভব নয়। পাইকাররা জমি থেকেই কলা কেটে নিয়ে যায়। আম চাষে বছরে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ফলন হয়। আর কলা বারো মাস চাষ করা হয়। তিন মাস পরপর কলা বিক্রি করার মতো উপযুক্ত হয়। কলাচাষে ঝামেলা কম। লোকসানও নেই বললেই চলে। তবে কলা চাষে লাভ বেশি আছে।
পুঠিয়া উপজেলার বিড়ালদহ এলাকার কৃষক আলাউদ্দিন মণ্ডল। তিনি ৩ বিঘা জমিতে দীর্ঘ ২৫ বছর আমবাগান করতেন। তাতে ৫ বছরে ৫ লাখ টাকাও আয় করতে পারেননি। তবে বাড়তি আয়ের আশায় চলতি বছর সেই জমিতে আমের পরিবর্তে করেছেন কলাচাষ। তাতেই করেছেন বাজিমাৎ। বছরের শুরুতেই লাভ করেছেন ৫ লাখ টাকারও বেশি। তবে এর সংখ্যা ভবিষ্যতে আরও বাড়াব।
শুধু আলাউদ্দিনই নন; তার মতো এখানকার শত শত কৃষকের বাড়তি আয়ের ফসলে পরিণত হয়েছে কলাচাষ। তারা কলাচাষ করেই হয়েছেন স্বাবলম্বী। যারা বিঘাপ্রতি সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা খরচ করে অন্তত ২ লাখ টাকার কলা বিক্রি করছেন।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, কলাচাষ করেও যে সংসারে সচ্ছলতা ফেরানো যায় বছরের পর বছর তারই যেন প্রমাণ করে চলেছেন রাজশাহীর চাষিরা। সহজলভ্য ও জনপ্রিয় ফল কলার বড় জোগান দিয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে তাদের কলা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। রাস্তা ও পুকুরপাড়ে কলার আবাদ, নতুন জাতের উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল কলার চাষ এবং মানুষের খাদ্য তালিকায় কলার অন্তর্ভুক্তিতে রাজশাহী অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে বাড়ছে কলার আবাদ ও উৎপাদন। এতেই বছরে ৫০০ কোটি টাকার কলার বাজার গড়ে উঠেছে পদ্মাপাড়ের এ জনপদে।
তিনি বলেন, কলাচাষ এখন খুবই লাভজনক। কলার ভালো দাম পাচ্ছেন চাষিরা। প্রতি বিঘা জমিতে কলাচাষ করতে খরচ হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। লাভ হচ্ছে প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকা। রাজশাহীতে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় সবরি বা অনুপাম বা মানিক কলার। ঢাকাসহ সারাদেশেই রাজশাহীর কলার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।