প্রায় প্রতি বছরই আষাঢ় থেকে আশ্বিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলে বন্যা হয়ে থাকে এর কারণ স্বল্প সময়ে অতিবৃষ্টিজনিত বন্যা মৌসুমে বন্যা, আকস্মিক বন্যা, উপকূলীয় বন্যা এবং উজানের দেশ ভারত, ভুটান ও চীন হতে ঢল হিসেবে আসা পানি। সুনামগঞ্জ, সিলেট নেত্রকোনা, নিলফামারী, কুড়িগ্রাম, জামালপুরর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, বরগুনা, পিরোজপুর, মাদারীপুরসহ আশপাশের জেলাগুলো এ জলাবদ্ধতা লক্ষণীয় মাত্রায় চোখে পরে।
বন্যা ও জলাবদ্ধতার ব্যাপকতার ওপর ক্ষতির ধরন ও পরিমাণ নির্ভর করে। দেখা গেছে, বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ হেক্টর জমি আকস্মিক বন্যা ও জলাবদ্ধগ্রস্ত। দেশের এ জলাবদ্ধ স্থানগুলো বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবস্থান করে এবং এই সময়টা ভাসমান ফসল চাষের আওতায় এনে দেশে কৃষিজ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।
বাংলাদেশের এর বিশাল অঞ্চল সমুদ্র লেবেল প্রায় ২ মি. নিচে অবস্থতি এবং জোয়া-ভাটার প্রতি খবুই স্পর্শকাতর। বন্যা ও জলাবদ্ধতায় বাংলাদেশের একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। জলবায়ু পরিবর্তন এ সমস্যাকে আরও অধিকতর মন্দ করেছে। এর ফল স্বরূপ দেশ শস্য উৎপাদন কমছে এবং খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পতিত হচ্ছে এর সাথে জীবনযাত্রার মান নিম্নগামী হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী নিজেদের টিকিয়ে রাখতে বয়রা (Baira) ফসল চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করছে।
বিভিন্ন এনজিও যেমন, Bangladesh, Centre for Advanced Studies (BCAS) এবং তার সহযোগী স্থানীয় সংগঠন বন্যা কবলিত ও জলাবদ্ধ উপকূল ও লবণাক্ত এলাকায় (Floating vegetable bed cultivation) ভাসমান সবজি চাষ পদ্ধতি সম্প্রসারণ করছেন। যাহা স্থানীয় জনগণ ও সম্পৃক্ত কৃষক পরিবারের কর্মসংস্থান, আয়, খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অধিকন্তু এর মাধ্যমে উপকূলীয় বন্যাকবলিত এলাকার জনগোষ্ঠীর বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনের সাথে তালমিলিয়ে চলার অভিজোযন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
স্বল্প পরিশরে ভাসমান বেডে সবজি চাষ অনেক আগে থেকেই কিছু কিছু গ্রামের কৃষকরা করে আসছে। এটা মূলত পানির উপর মাটিবিহীন ভেলা, জলজ উদ্ভিদ যেমন কচুরিপানা, হেলঞ্চা ইত্যাদি, গোবর ও কম্পোস্টের মিশ্রণের ওপর সবজি চাষ যাকে ভাসমান বাগান বলে (Floating gander) স্থানীয়ভাবে এর নাম বয়রা (Baira)
এ প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত উদ্ভিদ ভেলার উপর কম্পোস্ট ও পানি থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে থাকে। বন্যা ও জলাবদ্ধ অবস্থায় ক্ষেতের ফসল পানিতে পচে যায় কিন্তু ভাসমান চাষ পদ্ধতিতে ফসল সার্বিকভাবে বেড়ে উঠতে সক্ষম।
এ প্রচলিত পদ্ধতিকে বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও গবেষণার সহায়তার আরও উন্নয়ন ও টেকসই করতে হবে। প্রযুক্তির ছোয়া পেলে বেশি মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী বেড তৈরি সবজি চাষে বৈচিত্র্য ও শস্য আবর্তন সম্ভব।
ভাসমান বেড (Baira) তৈরির উপকরণ
# কচুরিপানা (Water hyacinth)
# গভীর পানির ধানের খর (Deep water rice straw)
# বিভিন্ন প্রকার জলজ উদ্ভিদ
◊ kochuripana (Eichhornia crassipes)
◊ Khudipana (Lemna trinulca)
◊ Kutipana (Azolla pinnata)
◊ Shayala (Bluxa japonica)
# কিছু বাঁশের খণ্ড (Pieces of bamboo)
ভাসমান বেড (Baira) তৈরির পদ্ধতি
পানির উপর ভাসমান কচুরিপানার স্তূপ করে বাঁশের ভেলা স্থাপন করতে হবে। এর ওপর জলাবদ্ধতার স্থায়িত্বের ওপর ভিত্তি করে ঘন করে কচুরিপানার স্তূপ করতে হবে যাতে পুরো জলাবদ্ধতার সময় এটি ভাসমান থাকে। এর ওপর গোবর ও কম্পোস্টের স্তর দিয়ে ১০-১৫ দিন পর সবজির বীজ ছিটিয়ে বা চারা রোপণ করতে হবে। যেহেতু বয়রা (Baira) পানিতে সঞ্চালন সক্ষম সেহেতু সুবিধাজনক ব্যবস্থাপনার স্থানে বয়রাকে স্থাপন করে বাঁশের খুঁটি দিয়ে স্থায়ী করে দিতে হবে। এভাবে সবজি চাষে কৃষকরা প্রতি বছরে একটি বয়রা (Baira) থেকে ২-৩ বার ফসল সংগ্রহ করতে পারে।
ভাসমান বেডের জন্য শস্য ও সবজি নির্বাচন
ফসল চাষ আসলে মৌসুমের ওপর নির্ভর করে তথাপিও দেশে বিভিন্ন স্থানে ২০টিরও বেশি সবজি জাত এ ভাসমান বেডে চাষ করা যায়। দেশে বিভিন্ন স্থানে সবজি যেমন-
লালশাক (Red amaranth)
পুঁইশাক (Jadian spinach)
ধনেপাতা (Coriander leaves)
ফুলকপি (Cauliflower)
বাঁধাকপি (Cabbage)
টমেটো (Tomato)
বরবটি (Lady`s fingure)
শসা (Cucumber)
করলা (Bitter gourd)
লাউ (Bottle gourd)
চিচিঙ্গা (Snake gourd)
চালকুমড়া (Ash gourd)
মিষ্টিকুমড়া (Sweet pumpkin)
শিম (Bean)
ঢেঁড়স (Radish)
বেগুন (Egg plant)
আলু (Potato)
মসলা : মরিচ (Chilli), পিয়াজ (Onion), রসুন (Garlic), আদা (Turmeric) এবং সরিষা (Mustard)
ভাসমান বেডের জন্য শস্য ও সবজি চাষ এর সুবিধা
◊ দেশের নিম্ন অঞ্চল দীর্ঘ সময় ধরে বন্যা ও জলাবদ্ধ থাকার কারণে স্থানীয় জনসাধারণের মাঠে কোনো ফসল বা সবজি চাষ করা সম্ভব নয় ফলে তারা আর্থিক অসচ্ছলতার সাথে সাথে প্রয়োজনীয় পুষ্টিহীনতায় ভুগেন। এক্ষেত্রে প্রধানত বয়রায় সবজি ও ফসল চাষের মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।
◊ পানি শুকিয়ে যাওয়ার পর কচুরিপানা ও কম্পোস্ট জৈবসার হিসেবে ফসলের জমিতে ব্যবহার করা যায়।
◊ বন্যার সময় গ্রামীণ জনগণের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়।
◊ বন্যার সময় অথবা জলাবদ্ধ স্থানে বয়রার ফসল বা সবজি চাষের মাধ্যমে পরিবারে দৈনিক পুষ্টি ও আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখা সম্ভব বলে আমি মনে করি।
কৃষিবিদ মো. মাহমুদুল হাসান খান*
*বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (উদ্ভিদ প্রজনন), বি.এ.আর.আই, গাজীপুর।
ফার্মসএন্ডফার্মার/ ২৫ অক্টোবর ২০২১