বসতবাড়ি, শস্যাগার ও ফসলে ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনা

916

ইঁদুরের বার্ধক্যকাল বলে কিছু নেই। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তারা তরুণ। একটি পুরুষ ইঁদুর দিনে ২০ বারের মতো যৌনমিলন করে। দ্রুত ও অধিক প্রজনন সক্ষমতা (polyestrous) থাকায় এরা প্রতিবারে ৬-১৫টি বাচ্চা এবং বছরে ৬ বার প্রসব করতে পারে। স্ত্রী ইঁদুর প্রতি ২১ দিনে নতুন করে সন্তানের জন্ম দেয়। জন্মানোর ১০ দিন পরে ইঁদুরের দাঁত গজায় এবং ৩ মাস বয়সে গর্ভধারণ করতে সক্ষম। একজোড়া ইঁদুর হতে বছরে চক্রবৃদ্ধি হারে গড়ে ৮০০-১০০০টি ইঁদুর জন্মলাভ করতে পারে। ইঁদুর সাধারণতঃ গর্তে বাস করে, তবে কোন কোন প্রজাতি ঘরে বা গাছেও বাসা তৈরি করতে পারদর্শী। কিছু প্রজাতি সাঁতারেও বেজায় পটু। এরা স্তন্যপায়ী, সর্বভুক, নিশাচর প্রাণী। এদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হলেও স্পর্শ, শ্রবণ, ঘ্রাণ ও স্বাদেন্দ্রিয় বেশ প্রখর। যে কোন স্থানে একটিমাত্র ইঁদুরের উপস্থিতিও এতটাই ক্ষতিকর যে, এর অর্থনৈতিক ক্ষতির প্রান্তসীমা (EIL) হচ্ছে শূন্য।

সারা বিশ্বে ইঁদুরজাতীয় প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ২,৭৫০ যা মোট স্তন্যপায়ী প্রাণীর শতকরা ৪৩ ভাগ। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১৮ প্রজাতির ইঁদুর শনাক্ত করা হয়েছে। আমাদের দেশে প্রধানত যে সকল প্রজাতির ইঁদুর দেখা যায় সেগুলো মধ্যে মাঠের কালো ইঁদুর (Black field rat/Lesser bandicoot rat, Bandicota bengalensis), মাঠের বড় কালো ইঁদুর বা ধেড়ে ইঁদুর (Big black field rat/Greater bandicoot rat, Bandicota indica), ঘরের ইঁদুর বা গেছো ইঁদুর গোষ্ঠী (House/Roof rats, Rattus rattus complex), বাত্তি বা সোলই বা ঘরের নেংটি ইঁদুর (House mouse, Mus musculus), বাদামী ইঁদুর (Brown/Norway rat, Rattus norvegicus), মাঠের নেংটি ইঁদুর (Field mouse, Mus booduga), নরম পশম বা রোঁয়াযুক্ত ইঁদুর (Soft-furred field rat, Millardia meltada) উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে ইঁদুর ধান, গম, ভুট্টা, আখ, আনারস, নারিকেল, গোল আলু, মিষ্টি আলু, বাদাম, সরিষা, ডালজাতীয় শস্য, বিভিন্ন অর্থকরী সব্জি-ফসল ও ফলদ বৃক্ষের বিপুল ক্ষতিসাধন করে। এর মধ্যে মাঠের কালো ইঁদুর সব ধরনের মাঠ ফসল ও গুদামজাত ফসল, মাঠের বড় কালো ইঁদুর বোনা আমন ধান, মাঠের নেংটি ইঁদুর মাঠের দানাজাতীয় পাকা ফসল, নরম লোমযুক্ত ইঁদুর ধান, গম ভুট্টার ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। নরওয়ে বা বাদামি ইঁদুর ঘরের ও গুদামজাত শস্য, ঘরের ইঁদুর বা গেছো ইঁদুর গুদামজাত শস্য এবং আসবাবপত্র, বাত্তি বা সোলই ইঁদুর ঘরের বইপত্র, কাপড়-চোপড় ও শস্যদানা এবং প্যাসিফিক ইঁদুর (Rattus exulans) ফলদবৃক্ষ বিশেষ করে নারকেল গাছের ক্ষতি করে থাকে। ক্ষতির ব্যাপকতা অনেকাংশে নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ইঁদুর প্রজাতির ধরন ও সংখ্যার নিবিড়তা, শস্যাবস্থা, মাঠে ফসলের পর্যাপ্ততা এবং পারিপার্শ্বিক ভৌত পরিবেশের উপর।

ইঁদুরে কাটা ফসল বা জিনিষপত্র, মেঝেতে ইঁদুরের পায়ের ছাপ, খোবলানো মাঠের পাশে ঝুরঝুরে মাটি, পড়ে থাকা ইঁদুরের মল, কাঠের তাকে বা দেয়ালে তেলতেলে দাগ প্রভৃতি দেখে ইঁদুরের আক্রমণ ও উপস্থিতি বোঝা যায়। একর প্রতি ফসল ক্ষেতে ৪-৫টি টাটকা বা সতেজ ইঁদুরের গর্ত দেখলে প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হয়। ইঁদুর দমনের জন্য বিভিন্ন কার্যকরী দমন ব্যবস্থা রয়েছে। মূলত দমন পদ্ধতি নির্ভর করে উপস্থিত প্রজাতির ধরন, ফসলে ক্ষতির মাত্রা ও পরিমাণ, ফসলের অর্থনৈতিক মূল্য, দমনপদ্ধতির সহজপ্রাপ্যতা এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থা সাপেক্ষে। অধিকন্তু, কোন একক পদ্ধতি প্রয়োগ করার চেয়ে যৌথভাবে সমন্বিত বা সুসংহত দমন ব্যবস্থা নিলে অধিক কার্যকরী হয়। ইঁদুর দমন ব্যবস্থাকে প্রধানত দু’ভাবে ভাগ করা যায়—অরাসায়নিক বা পরিবেশসম্মত দমন এবং বিষ প্রয়োগ বা রাসায়নিক দমন পদ্ধতি।

ক) অরাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন (Non-chemical control)

আদিকাল থেকে কোনপ্রকার বিষ বা বিষটোপ ছাড়া ইঁদুর দমন প্রচেষ্টা চলে আসছে। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে সংখ্যাধিক্য ঘটলে বিষ বা বিষটোপ ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তবে যথাসম্ভব পরিবেশসম্মত পদ্ধতিতে দমনব্যবস্থা নেওয়া শ্রেয়।

১। পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা (Ecological management)

চাষাবাদ পদ্ধতি (Cultural control): জমি তৈরির সময় ন্যুনতম ১৮ ইঞ্চি গভীর করে চাষ দিয়ে, আইল ছেঁটে ছোট বা চিকন রেখে, আইলের সংখ্যা কমিয়ে, নিয়মিত আগাছা পরিস্কার করে, ইঁদুর-সৃষ্ট গর্ত দূর করে ইঁদুর নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। সাধারণত ৬ ইঞ্চি উচ্চতা ও ৮ ইঞ্চি প্রশস্ততা বিশিষ্ট আইল তৈরি করলে ইঁদুর আইলে গর্ত করে বসবাস করতে পারে না। ইঁদুর আক্রমণপ্রবণ অঞ্চলে ‘শুন্য কর্ষণ (Zero tillage)’কিংবা‘ন্যুনতম কর্ষণ (Minimum tillage)’পরিহার করতে হবে। আখ লম্বা হয়ে বাতাসে ঢলে পড়লে ইঁদুরের উপদ্রব বাড়ে। তাই আখ বান্ডল বা গোছা করে বেঁধে ঠেকনা দিয়ে রাখতে হবে। স্মর্তব্য যে, আহার, বাসস্থান ও পানি এ তিনের যে কোন একটির অভাব হলে ইঁদুর স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়।

শস্যাবর্তন পদ্ধতি বা শস্য–পর্যায় (Crop rotation) অবলম্বন: গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে ধান-আখ-গম শস্য-চক্র ইঁদুরের বিস্তার ও বংশবৃদ্ধিতে সহায়ক। কারণ, ধান-গম শস্য ব্যবস্থায় ধান কর্তন শেষে ইঁদুর পার্শ্ববর্তী আখ ক্ষেতে গমন করে এবং আখ কর্তন শেষ হলে পুনরায় গম ক্ষেতে ফিরে এসে বাধাহীন জীবনচক্র চালিয়ে যায়। তাই ভিন্ন শস্য-পর্যায় অবলম্বন করলে ইঁদুরের স্বাভাবিক বিস্তার ও প্রজনন বাধাগ্রস্ত হয়। ইঁদুর শুকনোর চেয়ে ভেজা মাটি অধিক পছন্দ করে বিধায় শস্য বহুমুখীকরণ প্রক্রিয়ায় ধান কিংবা গমের স্থলে অন্য কোন উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল যোগ করলে ইঁদুরের আক্রমণ হ্রাস পায়।

পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা (Cleanliness/Hygiene) বজায় রেখে: বসত-বাড়ি, রান্নাঘর, ভাণ্ডার, খাদ্য গুদাম, বাড়ির আঙ্গিনা, পুকুর পাড়, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, নদীর পাড় ও জমির চারপাশের ময়লা-আবর্জনা, উচ্ছিষ্ট খাবার-দাবার, অবাঞ্ছিত আগাছা ও ঝোপ-ঝাড় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও নির্মূল করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইঁদুরের দ্বারা ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমিয়ে আনা যায়। খড়ের গাদা মাটি হতে ১৮-২৪ ইঞ্চি উঁচুতে মাচা তৈরি করে স্থাপন করলে ইঁদুরের আক্রমণের মাত্রা হ্রাস পায়। মুরগির বিষ্ঠা মুরগির শেড থেকে দূরে রাখলে খামারে ইঁদুরের উপদ্রব কমে যায়।

শস্যসূচী মেনে চলে (Crop scheduling) বা একযোগে চাষাবাদ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে (Synchronous planting): মাঠে সবাই মিলে একসাথে ফসল রুয়ে, বুনে ও কেটে আনলে দীর্ঘদিন মাঠে খাবার না পেয়ে ইঁদুরের জন্মহার হ্রাস পেলে পরোক্ষভাবে তা ইঁদুর দমনে সহায়ক হবে। কারণ, ইঁদুর আগাম বোনা ফসলে আহার্য ও আশ্রয়ের সন্ধানে আগে আক্রমণ করে কিন্তু উক্ত ফসল কর্তন শেষে তদসংলগ্ন অন্য নাবি ফসলে স্থানান্তরিত হয়। তাই বিস্তৃত এলাকায় একই সাথে একই সময়ে পরিপক্ক হওয়া জাত বপন বা রোপন করলে ইঁদুরের আক্রমণের মাত্রা কমে।

২। ভৌত ও যান্ত্রিক দমন (Physical and Mechanical Control)

ইঁদুরের ফাঁদ পেতে (Trapping): বসতবাড়িতে ফাঁদ পেতে ইঁদুর ধরা একটি চিরায়ত আদি দমন পদ্ধতি। কৃষকেরা নিজস্ব উদ্ভাবনী কায়দায় বাঁশ, কাঠ, টিন ও লোহার তৈরি ফাঁদ কিংবা বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন ফাঁদ ব্যবহার করে কার্যকরভাবে ইঁদুর দমন করেন। এ সমস্ত ফাঁদে টোপ হিসাবে শুটকী মাছ, নারিকেলের টুকরা, কলা, বিস্কুট, রুটি, আম, আলু, চালভাজা ইত্যাদির সাথে কার্বন ডাইসালফাইড (CS2) মিশ্রিত করে ব্যবহার করলে দ্রুত ভাল ফল পাওয়া যায় (৫০-৬০% বেশী)। ফাঁদে স্ত্রী বা পুরুষ ইঁদুরের মলমূত্র, গায়ের গন্ধযুক্ত টোপ ব্যবহার করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। ফাঁদ ব্যবহার কৌশল ও তা স্থাপনের স্থান নির্ধারণ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, অন্যথায় ফাঁদ লাজুকতার (Trap shyness) সমস্যা দেখা দিতে পারে। ইঁদুরের আকার-আকৃতি অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের ফাঁদ ব্যবহার করা সমীচীন। যেমন ঘরের নেংটি ইঁদুর ধরার ফাঁদ দিয়ে বড় আকৃতির মাঠের ধেড়ে কালো ইঁদুর ধরা সম্ভব নয়। এসব ফাঁদ ইঁদুরের চলাচলের পথ বা আনাগোনাবহুল স্থান যথাঃ ঘরের কিনারায়, দেয়ালের পার্শ্বে, মাচায়, চালের উপর বা গর্তের কাছাকাছি স্থাপন করতে হয়। মাঠে ইঁদুরের টাটকা গর্তের উঠানো মাটির ৩০ সে.মি. দূরে টোপসহ ফাঁদ পাততে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন ফাঁদে ধৃত ইঁদুর যথাশীঘ্রই সম্ভব সরানো হয় এবং পুরাতন, খারাপ ও মোল্ডযুক্ত টোপ সরিয়ে নতুন টোপ দেওয়া হয়। প্রয়োজনানুযায়ী ফাঁদের সংখ্যা কম হলে সাফল্য হ্রাস পায়। কোন কোন ফাঁদে ইঁদুর ধরা পড়ার সময়ই যাঁতাকলে আটকে মারা যায়। এগুলোকে মৃত্যু-ফাঁদ (Kill trap) বা মরণ-ফাঁদ বা কেচিকল (Snap trap) বলে। আবার কোন কোন ফাঁদ যেমন-বাঁশের ফাঁদ, বাক্সের ফাঁদ বা শেরম্যান (Sherman) ফাঁদ, তারের খাঁচার ফাঁদ বা ওয়ান্ডার ফাঁদে ইঁদুর জীবন্ত ধরা পড়ে বলে এগুলোকে‘জীবিত অবস্থায় ধরা ফাঁদ’ (Live trap) বলে। শেরম্যান ফাঁদ টিনের বা লোহার পাত দ্বারা তৈরি এবং এতে স্প্রিং নিয়ন্ত্রিত কপাট আছে। অন্যদিকে ওয়ান্ডার ফাঁদ তারজালি দিয়ে তৈরি এবং তা দ্বারা একসাথে একাধিক ইঁদুর ধরা যায়। ইঁদুরের ফাঁদ ভীতি কাটানোর জন্য প্রথম ২-৩ দিন এ ফাঁদের মুখ খোলা রেখে স্থাপন করা হয়। ধৃত জীবন্ত ইঁদুর পানিতে ডুবিয়ে মেরে এবং মৃত ইঁদুরসমূহ মাটির গভীরে গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে। ফাঁদ ইঁদুরের জরিপ ও পর্যবেক্ষণ কাজে সহায়তা করে, যাতে প্রজাতির ধরন ও ঘনত্ব সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।

আঠা ব্যবহারের মাধ্যমে (Glue board): সাধারণত ১’×১’ আকারের কাঠবোর্ড, মোটা শক্ত কাগজ, টিন, হার্ডবোর্ড ইত্যাদিতে একপ্রকার আঠার প্রলেপ দিয়ে ইঁদুরকে আকৃষ্ট করার জন্য লোভনীয় খাবারের টোপসহ ইঁদুরের চলাচলের রাস্তায় রাখা হয়। খাবারের লোভে ইঁদুর আঠার সংস্পর্শে এসে লোমসহ আটকে চলৎশক্তিহীন হয়ে মারা পড়ে। মৃত ইঁদুর পশমসহ শীঘ্রই সরিয়ে নিয়ে নতুন আঠার প্রলেপ লাগিয়ে পুনঃস্থাপন করা যায়। বাজারে ‘No Rat’, ‘Rat Glue’, ‘All Trap’ ইত্যাদি বাণিজ্যিক নামে আঠাসমূহ বেশ কার্যকর ও সমাদৃত।

গর্তে পানি ঢেলে অথবা ধোঁয়া দিয়ে (Watering/Smoking): পানির উৎস সহজ হলে ইঁদুরের গর্তে পানি ঢেলে শ্বাসরোধ করে বা পিটিয়ে ইঁদুর নিধন কার্যকরী। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এ কাজটি বেশ সোৎসাহেই করে থাকে। গর্তে গরম পানি ঢাললে ইঁদুর তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসে। গমের ক্ষেতে দিনের বেলায় সেচ দিলে গর্তের ইঁদুর বের হয়ে আসে। সেচ দেওয়ার সময় জমির চারিদিকে দাঁড়িয়ে থেকে পিটিয়ে ইঁদুর নিধন করতে হবে। প্রচলিত পদ্ধতিতে শুকনা মরিচ-পোড়া ধোঁয়া বা খড় জ্বালানো ধোঁয়া ইঁদুরের গর্তে ঢুকিয়েও ইঁদুর দমন ফলদায়ক। পানি বা ধোঁয়া প্রয়োগ করার সময় গর্তের মুখগুলি জাল দিয়ে ঢেকে দিলে ইঁদুর গর্ত থেকে বের হয়ে জালের ভিতর আটকা পড়ে পালাতে পারে না। একসাথে অনেক লোক মিলে দলবদ্ধভাবে এ ব্যবস্থা নিলে ভাল ফল পাওয়া যায়। মাঠে ইঁদুরের আক্রমণ বেশী হলে সেচের পানি দ্বারা কয়েকদিন প্লাবিত রেখে ইঁদুর দমন করা যায়।

গর্ত খনন করে (Digging): ইঁদুরের গর্ত লম্বায় ১৫ মিটারের বেশী এবং গভীরতায় প্রায় ১ মিটার হয়ে থাকে। তাই জমিতে ফসল থাকা অবস্থায় গর্ত খোঁড়া সম্ভব হয় না। তবে ফসল কর্তনের পর মাঠে বা ক্ষেতের আইলের গর্তের মাটি খুঁড়ে ইঁদুর নিধন করা যায়। কিছু আদিবাসীর খাবার মেন্যুতে ইঁদুর একটি উপাদেয় খাদ্য।

প্রতিবন্ধকতা (Barrier) সৃষ্টি করে/ইঁদুর প্রতিরোধক্ষম ব্যবস্থা (Rat proofing): দালানকোঠা, ঘরবাড়ি ও খাদ্যগুদামে দরজা-জানালা, গ্রিল, পাইপের খোলা মুখ ও অন্যান্য ইঁদুর প্রবেশ্য স্থানের ফাঁক-ফোকরে ধাতব পাত বা তারজালি লাগিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ইঁদুরের অনুপ্রবেশ বন্ধ এবং চলাচল প্রতিহত করা সম্ভব। পানির ট্যাপের ছিদ্র, ভাঙা ড্রেন সর্বদা মেরামত করতে হবে যাতে ইঁদুরের জন্য পানি সহজলভ্য না হয়। ঘরে ড্রাম, মটকা, টিনের পাত্র ইত্যাদিতে ধান, গম ও অন্যান্য শস্য-সামগ্রী সংরক্ষণ করলে ইঁদুরের আক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। সম্ভব হলে শস্যাধারের মেঝে পাকা হওয়া বাঞ্ছনীয়। ইঁদুরের উপদ্রব থেকে রেহাই পেতে নারিকেল, সুপারিসহ অন্যান্য ফলদ বৃক্ষে মাটি হতে ২-৩ মিটার উপরে গাছের খাড়া কাণ্ডের চারদিকে ৪৫-৬০ সেমি চওড়া টিনের মসৃণ পাত শক্ত করে আটকাতে হবে যাতে ইঁদুর উপরে উঠতে না পারে। এক গাছের সাথে অন্য গাছের সংযোগ থাকতে পারবে না।

বৈদ্যুতিক বাধা সৃষ্টির মাধ্যমে (Electrical barrier): ইঁদুরের চলাচলের পথে অল্প বিদ্যুতায়িত তারের বেড়া স্থাপন করে ইঁদুর দমন সম্ভব। ইঁদুর তারের বেড়ার সংস্পর্শে আসলে তড়িতাহত হয়ে মারা যায়। তবে এ পদ্ধতি ব্যয়বহুল এবং মানুষ ও অন্যান্য প্রাণির জন্য বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় অধিকতর সাবধানতা আবশ্যক। ফিলিপাইনের আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরীক্ষাধীন প্লটে এ ব্যবস্থা বেশ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।

৩। জৈবিক দমন (Biological control): কেবল পরিবেশ বিধ্বংসী রাসায়নিক দ্রব্যের সাহায্যে ইঁদুর নিধনযজ্ঞ চালানো সম্ভব নয়। তাই আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে হবে পরিবেশবান্ধব জৈবিক দমনের দিকে। পরভোজী প্রাণীর মধ্যে দিবাচর শিকারি পাখি যেমন- ঈগল, তিলা বাজ, হেরিয়াল চিল; নিশাচর শিকারি পাখি যেমন- লক্ষী পেঁচা, ব্রাউন হক আওল (Owl); স্তন্যপায়ী প্রাণি যেমন- বনবিড়াল, মেছো বিড়াল, পাতি শিয়াল, খেঁকশিয়াল, বাগডাস, বেজি; সরীসৃপ যেমন- সাপ, গুইসাপ ইত্যাদি দৈনিক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইঁদুর শিকার করে ইঁদুরের আধিক্য কমায়। একটি লক্ষ্মী পেঁচা প্রতি রাতে ১-৬ টি (গড়ে ১.৫৮টি) ইঁদুর শিকার করে। কিন্তু মানুষের অবিমৃষ্যকারিতায় ও অবৈধ শিকারীদের উৎপাতে প্রকৃতিতে এসব উপকারী প্রাণির সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান ও অস্তিত্ব বিপন্নপ্রায়। আমাদের নিজেদের স্বার্থে এসব ইঁদুরভুক উপকারি প্রাণিকুলের নির্বিচার নিধন বন্ধে ও সংরক্ষণে যথাযথ কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ফসল ক্ষেতে পাখি বসার ডাল পুঁতে দিলে এদের ইঁদুর ধরা সহজ হয়। গৃহপালিত কুকুর-বিড়াল দ্বারাও ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

অণুজীবীয় জৈবিক দমনের অংশ হিসাবে প্রটোজোয়া পরজীবি Trypanosoma evnsi যা গবাদিপশুতে ট্রিপ্যানোসোমিয়াসিস রোগ সৃষ্টি করে তা পৃথিবীর নানা দেশে গবেষণাগারে ঘরের ইঁদুর ও মাঠের কালো ইঁদুর দমনে শতভাগ সফল বলে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রাণিবাহিত রোগ বিষয়ে গঠিত কমিটি মানুষ ও গবাদিপশুর স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনায় এ অনুজীবঘটিত ইঁদুরনাশকের ব্যবহারিক প্রয়োগে সতর্কতা জারি করেছে। বিভিন্ন বহিঃপরজীবি যেমন-মাকড়, আঠালি, ফ্লি, উঁকুন শুধু ইঁদুরের রক্ত শোষণ করে না, এদের দেহে নানা রোগ-জীবাণুর সংক্রমণও ঘটায়। তাছাড়া অন্তঃপরজীবি হিসাবে ইঁদুরের দেহে ২০০টিরও বেশী প্রজাতির ফিতাকৃমি ও সুতাকৃমি শনাক্ত হয়েছে।

খ) রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন (Chemical control method)

১। বিষটোপের (Poison bait) সাহায্যে: বিষটোপে ব্যবহৃত ইঁদুরনাশক বা র‍্যাটিসাইড বা রোডেন্টিসাইডকে মূলতঃ দু’ভাবে ভাগ করা হয়েছে—(ক) তীব্র বা তাৎক্ষণিক বিষ (Acute poison), (খ) দীর্ঘমেয়াদী বিষ (Chronic poison)।

(ক) তীব্র বা তাৎক্ষণিক বিষ: যে সব বিষ মাত্র একবার খাওয়ার পর ইঁদুরের দেহে তাৎক্ষণিক বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে মৃত্যু ঘটায় তাদেরকে তীব্র বিষ বলে। জিংক ফসফাইড একটি বহুল ব্যবহৃত তীব্র বিষ। অন্যান্যের মধ্যে আন্টু (ANTU, আলফা-ন্যাফথাইল থায়োইউরিয়া), বেরিয়াম কার্বনেট, আর্সেনিক ট্রাইঅক্সাইড, ব্রোমেথিলিন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছড়াও সোডিয়াম ফ্লুরোঅ্যাসিটেট এবং থেলিয়াম সালফেট দারুণ কার্যকরী, কিন্তু মারাত্মক বিপজ্জনক। এ ধরনের বিষটোপ ইঁদুরের পাকস্থলীতে পাচক রসের সংস্পর্শে এসে বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি করে এবং লিভার ও কিডনিকে অকেজো করে ও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ করে ইঁদুরের মৃত্যু ঘটায়। কিন্তু এ বিষটোপের প্রধান অসুবিধা হলো বিষটোপ লাজুকতা (Bait shyness) বা বিষটোপ বিমুখতা (Bait aversion)। বিষটোপ পাত্রের আশেপাশে মরা ইঁদুর পড়ে থাকতে দেখে অন্যরা আর বিষটোপ খেতে চায় না, একে বিষটোপ লাজুকতা বলে। তাই বিষটোপ লাজুকতা কাটাতে বিষটোপ ব্যবহারের পূর্বে প্রথম ২/৩ দিন বিষহীন টোপ (শুধু গম) ব্যবহার করে (Pre-baiting/False baiting) ইঁদুরকে টোপ খেতে অভ্যস্ত করে নেওয়া যায় কিংবা বিষযুক্ত ও বিষহীন টোপের মিশ্রণ একসাথে ব্যবহার করা যায় (One-shot baiting)। একই স্থানে একাদিক্রমে দু’রাত্রের বেশী এ বিষটোপ ব্যবহার অনুচিত এবং অন্তত ২-৩ মাস বিরতি দিয়ে পুনর্বার ব্যবহার করতে হবে। দৈবাৎ দুর্ঘটনা ঘটলে এ বিষের তেমন কোন প্রতিষেধক (antidote) নেই।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অনিষ্টকারী মেরুদণ্ডী প্রাণিবিভাগের বিজ্ঞানীগণ কর্তৃক উদ্ভাবিত গমে জিংক ফসফাইড আবরণযুক্ত বিষটোপ (২%) ইঁদুর দমনে খুবই কার্যকর, যা খুব সহজেই তৈরি করা যায়। এক কেজি বিষটোপ তৈরির জন্য একটি অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে ১০০ মিলিলিটার পানিতে ১০ গ্রাম বার্লি বা সাগু মিশিয়ে জ্বাল দেওয়ার পর যখন ঘন হয়ে আসবে তখন হাঁড়িটি নামিয়ে ভালভাবে ঠান্ডা করে তাতে ২৫ গ্রাম ধূসর কালো রঙের জিংক ফসফাইড (সক্রিয় উপাদান ৮০%) ভালভাবে মিশিয়ে ৯৬৫ গ্রাম গম ঢেলে দিতে হবে। সমস্ত মিশ্রণটাকে একটি চামচ বা কাঠির সাহায্যে এমনভাবে নাড়াতে হবে যাতে সমস্ত গমের গায়ে জিংক ফসফাইডের কালো আবরণ পড়ে। এরপর সদ্য প্রস্তুত মিশ্রণকে দেড় থেকে দু’ঘন্টা রোদে শুকিয়ে নিয়ে ঠান্ডা করে এবং তেল দিয়ে ভালভাবে মেখে নিয়ে বায়ু নিরোধক পাত্রে বা পলিথিন ব্যাগে রেখে দিতে হবে। প্রয়োজনানুযায়ী সেখান থেকে নিয়ে ব্যবহার করতে হবে। এভাবে প্রস্তুতকৃত বিষটোপের কার্যকারিতা ২/৩ বছর পর্যন্ত থাকতে পারে।

(খ) দীর্ঘমেয়াদী বিষ: যে সমস্ত বিষ খেলে ইঁদুর তাৎক্ষণিকভাবে মারা না গিয়ে ক্রমশঃ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে মারা যায় তাদেরকে দীর্ঘমেয়াদী বিষ বলে। এ ধরনের সব বিষ অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট (Anticoagulant) বা রক্ত পানিকারক। এ বিষকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে—(ক) একমাত্রা (Single dose) বিষ, (খ) বহুমাত্রা (Multiple dose) বিষ। একমাত্রা বিষ (যেমন-ব্রোমোডায়োলোন, ব্রডিফেকৌম) একবার খেলেই ইঁদুর ৩-৪ দিনের মধ্যে মারা যায়। প্রখ্যাত ব্রিটিশ কোম্পানি ‘শেল (Shell)’ কর্তৃক উদ্ভাবিত একমাত্রার দীর্ঘমেয়াদী বিষ ফ্লোকৌমাফ্যান (স্টর্ম) ইঁদুর দমনে শতভাগ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। বহুমাত্রা বিষে (যেমন- ওয়ারফারিন, কৌমাটেট্রালিল) ইঁদুর মরার জন্য ২-৩ বার বিষটোপ খেতে হবে এবং ৬-১০ দিনের মধ্যে ইঁদুর মারা যায়। এক মাত্রার বিষে বহুমাত্রার বিষের চেয়ে ডোজ, শ্রম ও সময় কম লাগে এবং তা বসতবাড়ি ও মাঠ সবক্ষেত্রে সমানভাবে কার্যকর।

দীর্ঘমেয়াদী বিষ যকৃতে ভিটামিন কে-১ সৃষ্টিতে বাধা প্রদান করে রক্তের প্রথ্রোম্বিনকে ধীরে ধীরে কমিয়ে রক্তজমাট বাঁধার প্রক্রিয়াকে নষ্ট করে এবং অনবরত রক্ত অন্তঃক্ষরণের ফলে ইঁদুর মারা যায়। এ ধরনের বিষে আক্রান্ত ইঁদুরে সহসা কোন লক্ষণ দেখা যায় না বিধায় অন্যান্য ইঁদুরেরাও এ ধরনের বিষটোপ খেতে দ্বিধাবোধ করে না, ফলে এতে বিষটোপ লাজুকতা দেখা যায় না। এ বিষটোপ ব্যবহারে শতকরা নব্বই ভাগ পর্যন্ত ইঁদুর মারা সম্ভব। তীব্র বিষটোপ প্রয়োগের পর বেঁচে যাওয়া অবশিষ্ট ইঁদুরকে নিধনের জন্য নির্দিষ্ট বিরতিতে দ্বিতীয় প্রজন্মের অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট/ দীর্ঘমেয়াদী বিষটোপ (যেমন- ব্রোমোডায়োলোন) ব্যবহার করলে (Pulse baiting) অধিক ফল পাওয়া যায়। দৈবাৎ মানুষে এ বিষের বিষক্রিয়া দেখা দিলে প্রতিষেধক হিসাবে ভিটামিন কে-১ দিতে হবে। শীঘ্রই ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে রক্ত সঞ্চালনের ব্যবস্থাও করতে হবে।

এক কেজি বিষটোপ তৈরিতে ৫০ গ্রাম কৌমাটেট্রালিল (০.৭৫% সক্রিয় উপাদান) বা ২০ গ্রাম ব্রোমাডায়োলোন (০.২৫% সক্রিয় উপাদান) চাল/গম/ডাল ভাঙ্গা, গুড় ও উদ্ভিজ্জাত তেলের সাথে ৯৬: ২: ২ অনুপাতে মিশাতে হয়, এতে যথাক্রমে ০.০৩৭৫ এবং ০.০০৫% বিষমাত্রার বিষটোপ প্রস্তুত করা যায়। ৪-৫ দিন ছোট ছোট পাত্রে বিষটোপ নিয়ে ইঁদুর চলাচলের পথে সন্ধ্যার পর রেখে সকালে সরিয়ে নেওয়া হয়।

ঘরে বা মাঠে ইঁদুরের চলাচলের রাস্তায় বা সতেজ গর্তের নিকটে কিংবা সরাসরি গর্তের ভিতরে বিষটোপ আগুনে ঝলসানো কলা পাতা বা কাগজে মুড়িয়ে ছোট ছোট পোটলা বানিয়ে রাখতে হয়। তীব্র বিষটোপের ক্ষেত্রে আনুমানিক ৫ গ্রাম এবং দীর্ঘমেয়াদী বিষটোপের বেলায় ২০০-৩০০ গ্রাম বিষটোপ প্রতিটি বিষটোপ স্টেশনে রেখে দিতে হবে। বিষটোপ ইঁদুরে খেল কিনা তা প্রতিদিন পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং প্রয়োজনানুযায়ী বিষটোপ পাত্রে আরো বিষটোপ পূরণ বা পরিবর্তন করতে হবে। বৃষ্টির পানি বা মাটির আর্দ্রতা থেকে রক্ষা করার জন্য বিষটোপ মোম বা প্যারাফিনের আবরণে ঢেকে একটি বড় ছিদ্রযুক্ত ঢাকনাওয়ালা পাত্রে স্থাপন করা যেতে পারে, যাতে টোপের কার্যক্ষমতা কমে না যায়।

নিচে তীব্র ও দীর্ঘমেয়াদী বিষটোপ তৈরিতে বহুল পরিচিত ইঁদুরনাশকের একটি তালিকা দেওয়া হলো-

প্রথম প্রজন্মের ইঁদুরনাশক
(তীব্র বিষ)

দ্বিতীয় প্রজন্মের ইঁদুরনাশক (দীর্ঘমেয়াদী বিষ, প্রথম প্রজন্মের রক্ত পানিকারক) তৃতীয় প্রজন্মের ইঁদুরনাশক
(দীর্ঘমেয়াদী বিষ, দ্বিতীয় প্রজন্মের রক্ত পানিকারক)

জিংক ফসফাইড, আর্সেনিক লবণ, স্ট্রাইকনিন, লিলিয়েসি পরিবারের উদ্ভিদ রেড স্কুইলের (Urginea maritima) বাল্ব থেকে আহরিত যৌগ- সিলিরোসাইড গ্লাইকোসাইড, নরবরমাইড (র‍্যাটিক্যাট, সক্সিন), কোলেক্যালসিফেরল ওয়ারফারিন ও প্রোলিন, ফিউমারিন, ক্লোরোফ্যাকিনোন, ডাইফ্যাকিনোন, কৌমাটেট্রালিল (র‍্যাকুমিন), কৌমাটুরিল ডাইফেনাকৌম, ব্রডিফেকৌম (ক্লের‍্যাট), ব্রোমোডায়োলোন (ব্রোমাপয়েন্ট, ল্যানির‍্যাট), ফ্লোকৌমাফ্যান (স্টর্ম), ডাইফেথায়োলোন
*বন্ধনীতে সংশ্লিষ্ট ইঁদুরনাশকের বাণিজ্যিক নাম দেওয়া হলো

২। ট্র্যাকিং পাউডার (Tracking powder) বা হাইওয়ে বিষ (Highway poisons): এটি এক ধরনের রক্ত পানিকারক বা এন্টিকোয়াগুলেন্ট। ট্র্যাকিং পাউডার সাধারণতঃ ইঁদুর চলাচলের পথে, গর্তের মুখে বা ভিতরে ছড়িয়ে দিতে হয় যাতে ইঁদুর ঐ জায়গা দিয়ে চলাচলের সময় পায়ে এবং গায়ে পাউডার লেগে যায়। পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য ইঁদুরের নিজের শরীর চাটার অভ্যাস থাকায় কিছু বিষ গলাধকরণ হয়ে ইঁদুর মারা যাবে। মাঠের কালো ইঁদুরের চেয়ে এটি বাদামি ইঁদুর দমনে বেশী কার্যকর। তবে বিষটোপের চেয়ে এটি ব্যয়বহুল। কৌমাটেট্রালিল, সোডিয়াম ফ্লুরোসিলিকেট, ভ্যালোন, ক্লোরোফ্যাকিনোন (০.২%) বা কৌমাফেন (০.৫%) ট্র্যাকিং পাউডার হিসাবে বেশ কার্যকরী। দীর্ঘস্থায়ী এ বিষ ব্যবহারে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।

৩। ধূম্রবিষ/বিষবাস্প/ধূপক/গ্যাস বড়ি (Fumigants/Gassing): ইঁদুরের সক্রিয় গর্ত অর্থাৎ, সদ্য মাটি তোলা গর্তের মুখের মাটি সরিয়ে ৩ গ্রাম ওজনের অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড-এর ১টি বড়ি প্রতিটি গর্তের ভিতরে ঢুকিয়ে ভালভাবে মাটি চাপা দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। গর্তের মুখ খোলা থাকলে বা মাটিতে ফাটল থাকলে গ্যাস বেরিয়ে যাবে এবং ইঁদুর মারা যাবে না। এ বড়ি গর্তের আবদ্ধ বায়ুর আর্দ্রতার সংস্পর্শে আসলে ধীরে ধীরে নির্গত বিষাক্ত ফসফিন (PH3) গ্যাসের বিষক্রিয়ায় ইঁদুর মারা যায়। সাধারণত মিথাইল ব্রোমাইড (CH3Br), কার্বন টেট্রাক্লোরাইড (CCl4), ইথাইলিন ডাইব্রোমাইড (EDB), EDCT, অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (ফসটক্সিন, কুইক্‌ফিউম, সেল্‌ফস, কুইক্‌ফস) ইত্যাদি ধূম্রবিষ ব্যবহৃত হয়। সম্প্রতি বাজারে প্রচলিত অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড বড়ির (সক্রিয় উপাদান ৫৬%) চেয়ে অনেক কম মাত্রার সক্রিয় উপাদানযুক্ত বড়ি (৬%) ব্যবহার করেও ভাল ফল পাওয়া গেছে, যা অনেক খরচ সাশ্রয়ী। বড়ির পরিবর্তে ৫০ গ্রাম ক্যালসিয়াম কার্বাইড ভেজা কাপড়ে জড়িয়ে গর্তে ঢুকিয়ে মুখ বন্ধ করলে একই ফল পাওয়া যায়। গুদামে সংরক্ষিত শস্যের পোকা দমনের জন্য যে ধূম্রবিষ ব্যবহার করা হয় তাতে পোকার সাথে সাথে ইঁদুরও মারা যায়। এ ধরনের গ্যাস প্রাণঘাতী বিধায় ব্যবহারের পূর্বে স্বাস্থ্য সুরক্ষা পোশাক, বিশেষ প্রয়োগ যন্ত্রপাতি এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোক বা বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করা উচিত। ব্যবহারকারী হঠাৎ অসুস্থ বোধ করলে সাথে সাথে নিকটস্থ ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া অতীব জরুরী। বৃষ্টির দিনে বা প্রবল বাতাসে ধূম্রবিষ ব্যবহার সমীচীন নয়।

৪। বিকর্ষক বা বিতাড়ক দ্রব্যের ব্যবহার (Use of repellents): মাঠে ইঁদুর তাড়ানোর জন্য কোন কার্যকর রাসায়নিক বিকর্ষক না থাকলেও দানাদার ফসল যেমন-ধান, গম ফসলে কীটনাশক (যথা-ম্যালাথিয়ন), ছত্রাকনাশক (যথা-থাইরাম, সাইক্লোহেক্সিমাইড/এক্টিডায়োন), আগাছানাশক (যথা-ট্রাইবিউটাইলটিন ক্লোরাইড) প্রয়োগ করলে ইঁদুর কিছুদিন সেসব ক্ষেতসমূহ এড়িয়ে চলে এবং গর্ত খোঁড়া ও শীষ কাটা বন্ধ রাখে। অন্যদিকে, যে সব রাসায়নিক দ্রব্যাদি ইঁদুর অপছন্দ করে ও এড়িয়ে চলতে চায় সে সব দ্রব্য বিভিন্ন বাক্সে, খাদ্যদ্রব্যের পাত্রে, ছালার বস্তায় কিংবা অন্যান্য জায়গায় বিকর্ষক বা বিতাড়ক হিসাবে রাখা হয়। অনেক সময় উদ্ভিদজাত পাউডার বা তরল পদার্থ যেমন-নিম পাতা বা নিম তেল বিকর্ষক হিসাবে ব্যবহার হয়ে থাকে। তা’ছাড়া লরোনিট্রাইট, ডেনাটোনিয়াম বেনজোয়েট ইত্যাদিও ইঁদুর বিতাড়ক হিসাবে স্বীকৃত। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘আর-৫৫’ (Tertiary butyl sulfinyl dimethyl dithio carbamate) নামক একটি রাসায়নিক বিকর্ষক (যা রোডাব্যান নামেও পরিচিত) উদ্ভাবিত হয়েছে। ইঁদুর বিতাড়ক হিসাবে অতি উচ্চ কম্পাঙ্কের শব্দ (>১৮-২০ কিলোহার্টজ) সৃষ্টিকারী যন্ত্র প্রয়োগের চেষ্টা চালানো হলেও তা সাফল্যের মুখ দেখেনি। কারণ কিছুদিন পরে ইঁদুর সে শব্দে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে ও সফলতা নিম্নগামী হয়।

৫। রাসায়নিক বন্ধ্যাকারক (Chemosterilants) বা প্রজনন নিবারকের (Reproductive inhibitors) ব্যবহার: দ্রুত ও অধিক প্রজননশীল হওয়ায় ইঁদুর দমন সত্যিই দুঃসাধ্য। তাই আলফা-ক্লোরোহাইড্রিন (০.৫%) দানাদার বিষটোপের সাথে প্রয়োগের মাধ্যমে স্ত্রী ও পুরুষ ইঁদুরে বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি করা যায়। এতে ইক্ষু ক্ষেতে ৬০-৮০% পর্যন্ত মাঠের কালো ইঁদুর দমন সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া ফিউরাড্যান্টিন (০.০২ গ্রাম) পুরুষ ইঁদুর এবং কলচিচিন স্ত্রী ইঁদুরে (০.১৪ গ্রাম) বন্ধ্যাত্ব তৈরি করে। আবার এ দু’য়ের নির্দিষ্ট মিশ্রণে উভয়ে বন্ধ্যাত্ব তৈরি করা যায়। অন্যান্য রাসায়নিক বন্ধ্যাকারকের মধ্যে গসিপল, মেটাপা, ট্যাপা, থায়োট্যাপা, অ্যাফোলেট, হ্যাম্পা উল্লেখযোগ্য। আশার কথা, সম্প্রতি আমেরিকায় মায়ার লরেটা নামক এক নারী প্রাণিবিজ্ঞানী তাঁর অ্যারিজোনা ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্সটেক থেকে ইঁদুরের জন্য এক বিশেষ জন্মনিরোধক পিল ‘কন্ট্রাপেস্ট’ উদ্ভাবন করেছেন, যা ইঁদুরের বন্ধ্যাকরণে খুবই ফলপ্রদ।

এছাড়াও মাঝে মাঝে ইঁদুর দমন কর্মসূচী ঘোষণা করে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো যায়। বাংলাদেশে ইঁদুরের লেজ সংগ্রহে সরকারের আর্থিক পুরষ্কার ঘোষণা ইতোপূর্বে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল এবং তাতে আশানুরূপ ফলও পাওয়া গেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মাঠ পর্যায়ে কৃষকের মাঝে ফি বছর ইঁদুর নিধন ও দমনে বিভিন্ন কার্যকরী কর্মসূচী প্রণয়ন করে বেশ সাফল্য দেখিয়েছে। তা’ছাড়া ইঁদুর দমনের বিভিন্ন কলাকৌশল ও নির্দেশিকা সম্বলিত পোস্টার প্রদর্শন, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, পুস্তিকা ইত্যাদি বিলি করে, বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়ায় নিবন্ধ ছাপিয়ে ও ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে কথিকা ও নাটিকা প্রচারের ব্যবস্থা করে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা যায়।

ইঁদুর আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এক বিরাট হুমকি। ইঁদুর দমনে কোন একক পদ্ধতি শতভাগ কার্যকর নয়। আমাদের কাছে এমন কোন হ্যামিলিনের মোহন বাঁশিও নাই যাতে নিমিষেই ইঁদুরের বংশকে নিশ্চিহ্ন করা যায়। ইঁদুরের আচরণগত জটিলতা ও পরিবেশে অধিক অভিযোজন ক্ষমতার কারণে প্রচলিত দমন পদ্ধতিসমূহ কম ফলদায়ক। ইঁদুরের উচ্চ প্রজনন ক্ষমতার কারণে দমন পদ্ধতি শেষে বেঁচে যাওয়া অবশিষ্ট জনসংখ্যা এবং দমনের আওতার বাইরের এলাকা থেকে অনুপ্রবেশেকারী সদস্যগণ থেকে ইঁদুর শীঘ্রই পূর্ব জন-ঘনত্বে ফিরে আসে। তাই দীর্ঘমেয়াদে কার্যকরভাবে ইঁদুর দমনে একইসাথে প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া অপরিহার্য। এ ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি যেমন- বাসস্থান ব্যবস্থাপনা, ফাঁদ পাতা প্রভৃতির সঙ্গে অপেক্ষাকৃত অধিক নিরাপদ ভিটামিন ডি-৩ ভিত্তিক অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট ইঁদুরনাশক প্রাপ্যতার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা উচিত।

ফার্মসএন্ডফার্মার/০৫জানুয়ারি২০২১