বাংলাদেশের গবেষকদের দেশি গরু-ভেড়া-হাঁসের জিন রহস্য উম্মোচন

210

দেশে মূলত চারটি স্থানীয় জাতের গরু পাওয়া যায়। উত্তরবঙ্গে নর্থ বেঙ্গল গ্রে ক্যাটল, পাবনায় জার্সি গরু, মুন্সীগঞ্জে মীরকাদিম গরু ও চট্টগ্রামে রেড ক্যাটল গরু। এক গবেষণায় মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিম জাতের গরুর জিন রহস্য বা জিনোম সিকোয়েন্স উম্মোচন করেছেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানীরা। পাশাপাশি তারা দেশি জাতের ভেড়া এবং হাঁসের জিনোম সিকোয়েন্সও বের করেছেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার সাভারে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজির (এনআইবি) হলরুমে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। এতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান উপস্থিত ছিলেন।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই সাফল্য প্রাণীগুলোর সংরক্ষণ, মাংস উৎপাদন ও বিশেষত্ব নির্ধারণ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। একই সঙ্গে এ গবেষণা প্রাণীগুলোর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানতেও সহায়ক হবে।

এনআইবি জানায়, ২০২৩ সালের ১২ জানুয়ারি দেশি গরু, ভেড়া ও হাঁসের জিনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণা শুরু হয়।

তিনটি প্রাণীর জীবনরহস্য উম্মোচনের কাজটি করেছে এনআইবি’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও মহাপরিচালক ড. মো. সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে একটি গবেষক দল। দলটিতে আরও ছিলেনÑসেন্টার ফর নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিং অ্যান্ড অ্যানালাইটিকসের প্রকল্প পরিচালক এবং সিইও কেশব চন্দ্র দাস, এসএসও ড. নুসরাত জাহান, ড. আঞ্জুমান আরা ভূঁইয়া, ড. ইউএস মেহজাবিন আমিন, এসও মো. হাদিসুর রহমান, মোহাম্মদ উজ্জ্বল হোসেন, ইসতিয়াক আহমেদ, তাহমিদ আহসান, জিসান মাহমুদ চৌধুরী ও অরিত্র ভট্টাচার্য।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, জিনোম হচ্ছে কোনো জীবের পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। জীবের অঙ্গসংস্থান, জš§, বৃদ্ধি, প্রজনন এবং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াসহ সব জৈবিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় এর জিনোমে সংরক্ষিত নির্দেশনা থেকে। পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং হচ্ছে কোনো জীবের জিনোমে সব নিউক্লিওটাইডসমূহ (জৈবঅণু) কীভাবে বিন্যস্ত রয়েছে তা নিরূপণ করা। একটি জীবের জিনোমে সর্বমোট জিনের সংখ্যা, বৈশিষ্ট্য এবং তাদের কাজ পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স থেকেই জানা যায়।

গবেষণার তথ্য তুলে ধরে একটি সচিত্র প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন এনআইবির বায়ো ফরমেটিকস বিভাগের বিভাগীয় ইনচার্জ মোহাম্মদ উজ্জ্বল হোসেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ২ কোটি ৫৭ লাখ গরু, ১৯ লাখ ভেড়া ও ৩ কোটি ৪১ লাখ হাঁস রয়েছে। মোট জিডিপির প্রায় ২ দশমিক ৯ শতাংশ প্রাণিসম্পদ খাত থেকে আসে; যা মোট বার্ষিক প্রবৃদ্ধির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। দেশের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ গবাদি প্রাণী, হাঁস-মুরগি পালন করে জীবিকা নির্বাহ করে।

তবে শুধু গরু-মহিষ পালন করছে ৪৫ দশমিক ৯ শতাংশ পরিবার। ছাগল-ভেড়া ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ ও হাঁস-মুরগি পালন করছে ৭৬ দশমিক ৩ শতাংশ পরিবার। এ গবেষণার ফলে এই খাতে আরও সম্ভাবনা বাড়বে।

গবেষণায় তিন প্রাণীর বৈশিষ্ট্য উঠে এসেছে উল্লেখ করে বলা হয়, দেশি মীরকাদিম গরুর চোখের পাতা ও খুর গোলাপি, ত্বক সাদা, লেজের অগ্রভাগ বাদামি, শিং মাঝারি বাঁকা ও অগ্রভাগ সূক্ষ্ম। অন্যদিকে প্রাপ্তবয়স্ক ভেড়ার ওজন হয় ২০ কেজি, লোম মসৃণ ও বিন্যস্ত ও ক্রিমি সাদা বর্ণের হয়। এছাড়া হাঁসের রং হয় বাদামি, কালো ও সাদা পালকের মিশ্রণ, ঠোঁটের রং হয় হলুদাভ কালো, পায়ের পাতা হয় উজ্জ্বল কমলা রংয়ের।

এতে গরুর জিনোমের দৈর্ঘ্যে ২২৩ কোটি ৪৫ লাখ ৩২ হাজার ৮৫৬ জোড়া নিওক্লিউটাইড পাওয়া যায়। মীরকাদিম জাতটির ভারতের জেবু জাতের সঙ্গে মিল রয়েছে। এছাড়া এর নিজস্ব জেনেটিক বৈশিষ্ট্যও উঠে আসে এ গবেষণায়। গরুর মাংস উৎপাদন-সংক্রান্ত পাঁচটি জিনের তথ্য পেয়েছেন গবেষকরা, যা মাংস উৎপাদনের তথ্যে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

ভেড়া ও হাঁসের জিনোম বিশ্লেষণ করে যথাক্রমে ২৮৬ কোটি ৯৪ লাখ ৭৯ হাজার ৯২৫ জোড়া এবং ১৩৩ কোটি, ৬৫ লাখ ৪ হাজার ৭৩৫ জোড়া নিউক্লিওটাইড পাওয়া যায়।

গবেষণার এ তথ্য গত ২৩ মার্চ ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনে নিবন্ধন করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেন, ‘ইতোমধ্যে বেশ টাকা ব্যয় করে আমরা এখানে একটি জিন ব্যাংক করেছি। দেশের যত পশু-পাখি, গাছপালা রয়েছে, সেগুলোর বৈশিষ্ট্য এবং অরিজিনাল বিষয়গুলোকে রক্ষা করতেই আমরা এই জিন ব্যাংক তৈরি করেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কিন্তু সার্বিকভাবেই এই দেশটাকে নিয়েই ভাবি, দেশের মাটি, মানুষ, পশু-পাখি গাছপালা সবকিছুই কিন্তু বায়োটেকনোলজির মধ্যে পড়ে, তাই আমরা চাচ্ছি যে দেশটাকে, আমাদের যেই জিনিসগুলো রয়েছে, সেগুলোকে ভালোভাবে জানতে, যেন আমরা বিশ্বের কাছে গর্বের সঙ্গে তুলে ধরতে পারি যে দিজ আর দ্য ইউনিক ইন বাংলাদেশ।’