বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, নীলফামারী, নওগাঁসহ বেশ কয়েকটি জেলার প্রায় সবকটি উপজেলার গবাদিপশুর মাঝে ব্যাপক হারে লাম্পি স্কিন ভাইরাসজনিত রোগ দেখা দিয়েছে। স্থানীয়ভাবে রোগটি গো-বসন্ত হিসেবেও পরিচিত।
বাংলাদেশে গত বছর এই রোগ প্রথমবারের দেখা দিলেও এবার এর ব্যাপকতা গত বছরের চাইতে বেশি বলে জানিয়েছেন জেলার প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তারা।
গবাদিপশু এই রোগে আক্রান্ত হলে প্রথমে তার চামড়া ফুলে গোটা গোটা ঘায়ের মতো হয়ে যায়, তারপর জ্বর আসে।
অনেক সময় গরুর পায়ে পানি জমতে পারে। খাবারে অরুচি দেখা দেয়।
এক পর্যায়ে চামড়ায় ফোসকা পড়ে ইনফেকশন হয়ে যায়।
চলতি বছরের মে মাস থেকে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে শুরু করে বলে জানা গেছে।
গত বছর প্রায় একই সময়ে এই রোগের বিস্তার দেখা দিয়েছিল।
অজানা এই রোগে গবাদিপশু আক্রান্ত হওয়ায় এক ধরণের আতঙ্কের মধ্যে আছেন স্থানীয় মানুষ।
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান জানান, তিনি আগে কখনও গরুর এ ধরণের রোগ দেখেননি।
তার গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে বলে তিনি জানান। আবার করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে উপজেলা প্রাণীসম্পদ অফিসেও গরুগুলোকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে পারছেন না তিনি।
এ রোগে গবাদিপশুর মৃত্যুর আশঙ্কা কম হলেও দুধের উৎপাদন এবং চামড়ার গুণগত মানের ওপর প্রভাব ফেলে।
আক্রান্ত পশুর চামড়ায় সংক্রমণ দেখা দেয়ায় সেটা বিক্রির অযোগ্য হয়ে যায়। আবার গাভী আক্রান্ত হলে এর দুধের উৎপাদন কমতে থাকে।
তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে বাছুরগুলো। আক্রান্ত অনেক বাছুর ইতোমধ্যে মারা গেছে বলে জানিয়েছেন সৈয়দপুর ও ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা।
বিশেষজ্ঞরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় এই রোগের বিস্তার হতে পারে।
আবার ভাইরাসজনিত এই রোগটি বেশ সংক্রামক এবং মশা/মাছির মাধ্যমে সেটি ছড়িয়ে পড়ে বলে তারা জানিয়েছেন।
আক্রান্ত কোন গরুর শরীরে একটি মশা কামড় দিয়ে যদি সুস্থ গরুর ওপর বসে তাহলে সেটাও আক্রান্ত হতে পারে।
ভাইরাসজনিত এই রোগের এখন পর্যন্ত কোন ওষুধ বা টিকা আবিষ্কার হয়নি।
এক্ষেত্রে ওই গরুগুলোকে টার্গেটেড থেরাপি অর্থাৎ যে ধরণের উপসর্গ দেখা দিয়েছে সে অনুযায়ী চিকিৎসা দিচ্ছেন স্থানীয় ভেট সার্জনরা।
অর্থাৎ কোন গরুর যদি জ্বর আসে বা গা ব্যথা থাকে, তাহলে তাকে প্যারাসিটামল দেয়া হয়, চামড়ায় সংক্রমণ দেখা দিলে সংক্রমণ প্রতিরোধী ওষুধ।
সুস্থ গরুকে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়ার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা সম্ভব হলেও দীর্ঘমেয়াদী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধরে রাখা বিবেচনায় বিকল্প উপায়ে চিকিৎসার কথা ভাবছেন তারা।
তারা মূলত, খাবার সোডা, লবণ, চিটা গুড়, নিমের পাতার সাথে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট মিশিয়ে স্যালাইন তৈরি করে খাওয়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন।
প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা করালে দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে গরুর সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান সৈয়দপুর জেলার ভেট সার্জন রফিকুল ইসলাম।
এদিকে গরুর এই রোগটির সাথে ছাগলে বসন্ত রোগের মিল থাকায় ওই রোগের টিকা ‘গোট পক্স’ প্রাথমিকভাবে সুস্থ গরুগুলোর শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করা শুরু হয়েছে।
এসব ভাইরাস আক্রান্ত গরুগুলোকে সস্তায় বিভিন্ন কসাইখানায় বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে এবং সেখানে গরুগুলোকে জবাই করে হাটবাজারে বিক্রি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
আক্রান্ত গরুর দুধ ১০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফুটিয়ে খেলে এবং মাংস ভালভাবে রান্না করে খেলে কোন স্বাস্থ্য ঝুঁকি না থাকলেও অসুস্থ গরু কসাইখানায় পাঠাতে মানা করছেন প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তারা।
প্রতি বছর বিদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গবাদিপশু বাংলাদেশে আনা হয়। এবং তখন এই গরুগুলোর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় না।
এই স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করার কারণেই এই ভাইরাসজনিত রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে স্থানীয়দের মধ্যে এই রোগের বিস্তার ঠেকাতে সচেতনতার অভাব রয়েছে বলে জানিয়েছেন ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম।
তিনি বলেন, ” এই রোগ প্রতিরোধে আমরা গরুগুলোকে মশারির ভেতরে রাখতে বলছি, বাড়ির আঙিনা পরিস্কার রাখতে বলছি যেন মশা-মাছি না হয়। এজন্য লিফলেট দেয়া হচ্ছে,উঠান বৈঠক করা হচ্ছে। কিন্তু মানুষ কথা শুনছে না।”
সূত্র: বিবিসি বাংলা
ফার্মসএন্ডফার্মার/১৫জুন২০