বাংলাদেশে পোল্ট্রি খাতে যত সমস্যা বা যে ভয়াবহ রোগের সম্মুখীন হয়

34

বাংলাদেশে পোলট্রি বা গৃহপালিত পাখি সবচেয়ে বেশি মাংস ও ডিম উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে পোলট্রি চাষ হলো বিভিন্ন ধরনের পাখির মাংস, ডিম ও পালক উৎপাদন অথবা বিক্রির জন্য গৃহীত প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের আবহাওয়া পোলট্রি চাষের জন্য অনেক বেশি অনুকূল বা বন্ধুত্বসুলভ। বহু বছর আগে থেকে এখানকার মানুষ বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় জাতের পাখি পালন করে আসছে। কিন্তু এদের উৎপাদনশীলতা যথেষ্ট কম হওয়ায় খামার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ব্রিটিশ শাসনামলে ঢাকার তেজগাঁও, নারায়ণগঞ্জ ও সিলেটে পোলট্রি খামার তৈরি করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৮ সালে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী, সীতাকুণ্ডু, বরিশাল, যশোর, খুলনা ও রাজশাহীতে হাঁস-মুরগির খামার তৈরি করে। বাংলাদেশে ২০০৫ সালে মোট পোলট্রি পাখির সংখ্যা ছিল প্রায় ১৮ কোটি ৮৩ লাখ এবং বার্ষিক প্রায় ৫৩৬ কোটি ৯০ লাখ ডিম উৎপন্ন হয়েছিল।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে দেশে সরকারি হাঁস-মুরগির খামার রয়েছে ৪৫টি, যার মধ্যে আটটিতে বাচ্চা উৎপাদন করা হয় এবং ৬৪ হাজার ৭৫৯টি বেসরকারি নিবন্ধনসহ এক লাখ ৬০ হাজার ৫০৯টি খামার রয়েছে। এ খামারগুলো থেকে প্রতিদিন গড়ে দুই কোটি ৩০ লাখ ডিম এবং এক হাজার ৫৩০ টন মাংস উপৎপাদিত হয়, যা দেশের মোট মাংস উৎপাদনের ৩৭ শতাংশ। ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে পোলট্রি শিল্পে বিনিয়োগ হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী এদেশে এক লাখ ৫০ হাজার পোলট্রি ফার্ম আছে।

পোলট্রি মাংস, ডিম, পালক, সার, পশুখাদ্য ও ওষুধ তৈরির উপকরণের মতো অর্থনৈতিকভাবে মূল্যবান দ্রব্য উৎপাদনকারী গৃহপালিত পাখি, মুরগি, হাঁস, রাজহাঁস, গিনি মুরগি, কোয়েল, কবুতর, পিজেন্ট ও টার্কি সাধারণত পোলট্রি পাখি হিসেবে বিবেচিত হয়। এসব পাখি আবদ্ধ পরিবেশে প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি করতে পারে। গৃহপালিত মুরগির পূর্বপুরুষ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উদ্ভূত লাল বুনো মুরগি বলে মনে করা হয়। ধারণা করা হয়, খাদ্যের জন্য শতাব্দীর পর শতাব্দী বন্য বুনো মুরগি শিকারের পর মানুষ সম্ভবত চার হাজার বছরেরও অনেক আগে মুরগিকে গৃহপালিত করে। প্রাচীন ভারতে সূর্যদেবতাকে উৎসর্গকৃত ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও এসব মুরগি ব্যবহার করা হতো। সম্ভবত তখন পূর্ব এশিয়ার মধ্য দিয়ে মুরগি বিস্তার লাভ করে এবং খ্রিস্টপূর্ব প্রায় এক হাজার বছর আগে পারস্যে পৌঁছায় এবং তাদের প্রাচীন ধর্মে ভূমিকা রাখে।

গৃহপালিত গিনি মুরগির উদ্ভব হয়েছে আফ্রিকার শিরস্ত্রাণযুক্ত গিনি মুরগি থেকে। জানা যায়, সুদানের দক্ষিণাঞ্চল ও পশ্চিম আফ্রিকার দুটি স্থানে এদের প্রথমে গৃহপালিত করা হয়েছিল, তবে সময়কাল সম্পর্কে স্থির হওয়া যায়নি। প্রাচীনকালে গ্রিক ও রোমানদের কাছে গিনি মুরগি খুব পরিচিত ছিল। অবশ্য প্রায় সব আধুনিক গিনি মুরগি সম্ভবত পর্তুগিজদের নিয়ে আসা পশ্চিম আফ্রিকান উপ-প্রজাতি থেকে উদ্ভূত। মুরগি গৃহপালিত হওয়ার সময় থেকে গিনি মুরগিও গৃহপালিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। প্রাচীনকাল থেকে এটি স্বীকৃত যে, বুনো হাঁস থেকে গৃহপালিত হাঁস উদ্ভূত। বন্য ও গৃহপালিত হাঁসে খুব কম পার্থক্য দেখা যায়। তারা মুক্তভাবে নিজেদের মধ্যে প্রজনন ঘটায় এবং সংকরগুলো সম্পূর্ণভঅবে প্রজননক্ষম। গৃহপালিত টার্কির উদ্ভব হয়েছে একটি ম্যাক্সিকান উপ-প্রজাতি থেকে। এদের গৃহপালিত করার কোনো নির্দিষ্ট স্থান ও সময় জানা যায়নি।

স্থানীয় জাতের মুরগির মাংস ও ডিমের উৎপাদনশীলতা যথেষ্ট কম হওয়ায় বাংলাদেশে বর্তমানে উন্নত জাতের ছোট-বড় হাঁস-মুরগির খামার প্রতিষ্ঠা করার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। এসব উন্নত জাতের পাখির মধ্যে রয়েছে সাদা লেগহর্ন, রোড আইল্যান্ড রেড, প্লাইমাউথ রক, অ্যাসেল, ওয়াইনডট প্রভৃতি। স্থানীয় জাতের তুলনায় এসব পাখি আকারে বড় এবং ওজনও হয় প্রায় চার কেজি। সাদা লেগহর্ন বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে এবং এ জাতের একটি মুরগি বছরে প্রায় ২৩০টি ডিম দিতে পারে। বাংলাদেশে কোয়েলের জনপ্রিয়তাও বাড়ছে। এই ছোট পাখিটির ওজন হয় মাত্র প্রায় ১৫০ গ্রাম। এটি বছরে প্রায় ২০০ ডিম দিয়ে থাকে।

মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস-ঘটিত হাঁস-মুরগির একটি ব্যাক্টেরিয়াজনিত রোগ হচ্ছে এভিয়ান টিউবারকুলোসিস। রোগটি খুবই ব্যাপক, তবে যেসব সাধারণ খামার ও বাড়িতে দীর্ঘকাল হাঁস-মুরগি প্রতিপালিত হচ্ছে, সেখানেই এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। আধুনিক হাঁস-মুরগির খামারে রোগটির প্রকোপ কম, কারণ সেখানে পাখি সাধারণত দু’বছরের বেশি সময় রাখা হয় না। দেশি মোরগ-মুরগি, টার্কি ও গিনি ফাউল এই জীবাণু দ্বারা সহজে আক্রান্ত হয়, কিন্তু হাঁসে সচরাচর সংক্রমণ কম। তিন থেকে ছয় মাস বয়সের বাচ্চাদের মধ্যে এই রোগের প্রবণতা বেশি। রোগটি বাংলাদেশের হাঁস-মুরগি খামারের জন্য তেমন কোনো হুমকি নয়। শীতকালে মাঝেমধ্যে যক্ষ্মার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। রোগটি ধীরে ধীরে বাড়ে এবং আক্রমণের অনেক দিন পর মুরগি মারা যায়। কখনও কখনও আক্রান্ত মুরগির দেহের ওজন কমে যায় এবং সেটি খুঁড়িয়ে হাঁটে।

এইমেরিয়া গণের কতিপয় প্রজাতির প্রোটোজোয়া দ্বারা সংক্রমিত এক রোগ কক্সিডিওসিস। অন্তত সাতটি প্রজাতির মধ্যে প্রধানত বাংলাদেশে কক্সিডিওসিস রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী। এ রোগে পাখিগুলো ঝিমিয়ে পড়ে, খাওয়া বন্ধ করে এবং বিষ্ঠায় রক্ত দেখা যায়। আক্রান্ত পাখির মৃত্যু হার যথেষ্ট বেশি। মুরগির কলেরা চধংঃবঁৎবষষধ নামের ব্যাকটেরিয়াঘটিত মুরগির মারাত্মক সংক্রামক রোগ। এটি হিমোরেজিক সেপটিসেমিয়া নামেও পরিচিত। বাংলাদেশে মাঝেমধ্যে এ রোগের মড়ক দেখা দেয়। তিন থেকে ছয় মাস বয়সী মুরগিই এতে অধিক আক্রান্ত হয়। রুগ্ণ পাখি দ্বারা দূষিত মাটি, খাদ্য ও পানির মাধ্যমে রোগটি ছড়ায়।

মুরগির পক্ষাঘাত হাঁস-মুরগির ভাইরাস-ঘটিত রোগ। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। বাংলাদেশে তিন থেকে আট মাস বয়সী পাখিকেই পক্ষাঘাতে অধিক আক্রান্ত হতে দেখা যায়। কিন্তু তিন সপ্তাহের বেশি, এমনকি এক বছর বয়সী ব্রয়লারও এতে আক্রান্ত হয়ে থাকে। স্থানীয় জাতের মুরগির এই রোগ হওয়ার প্রবণতা কম। আক্রান্ত পাখিকে এক বা দু’পায়ে খোঁড়াতে দেখা যায়। কখনও কখনও একটি বা দুটি ডানা ঝুলে পড়ে। মৃত্যুহার বিভিন্ন, কিন্তু ছয় থেকে আট মাস বয়সীদের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশের বেশি হতে পারে। শীতকালেই এ রোগের প্রাদুর্ভাব অধিক।

পাখির বসন্ত মুরগির ভাইরাসজনিত ব্যাধি। এর লক্ষণ আঁচিলের মতো গণ্ডিকা বা নড্যুল, যা নানা আকারের হতে পারে। কোনোটি শিমের দানা আবার কোনোটি এর চেয়ে অপেক্ষাকৃত কিছুটা বড় হয়ে থাকে। গণ্ডিকাগুলো মুরগির ঝুঁটি, চোখের পাতা এবং নাক ও কানের ছিদ্রের প্রবেশপথে বা মাথার অন্যান্য অংশে তৈরি হয়। বাংলাদেশে সচরাচর শীতকালে রোগটির প্রাদুর্ভাব ঘটে। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক পাখির তুলনায় কম বয়সী পাখি এই রোগে বেশি ভোগে। মৃত্যুহার খুব একটা উল্লেখ করার মতো নয়। পাখির টাইফয়েড গৃহপালিত পাখির রক্তদূষণজনিত ব্যাধি। এর আক্রমণ তীব্র এবং এতে মৃত্যুহার অধিক। রোগের কারণ ইধপরষষঁং মধষষরহধৎঁস ব্যাকটেরিয়া। আক্রান্ত পাখির মল দ্বারা দূষিত খাদ্য ও পানির মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে এ রোগের সংক্রমণ ঘটে। বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে এর প্রাদুর্ভাব বেশি। মৃত্যুর হার শতকরা ২০-৮০ ভাগ।

গেপ রোগ খুদে গোল কৃমিঘটিত মুরগিছানার রোগ। কৃমিটি হাঁস-মুরগির শ্বাসনালি, ক্লোমনালি ও ক্লোমনালিকায় থাকে। এই কৃমির কর্মকাণ্ডের ফলে শ্লেষ্মা উৎপাদনসহ শ্বাসনালির স্ফীতি ঘটে আর বাতাস ঢোকার দরুন শ্লেষ্মা ফেনায় পরিণত হয়। আক্রান্ত পাখি মুখ হাঁ করে থাকে, হিস-হিস শব্দে শ্বাস ফেলে, মাথা ঝাঁকায় এবং গলা লম্বা করে রাখে। বাংলাদেশে খামারের হাঁস-মুরগির বাচ্চাদের মধ্যে গেপ রোগ বহুদৃষ্ট হলেও মৃত্যুহার খুব বেশি নয়। গামবোরো রোগ খামারে হাঁস-মুরগির ভাইরাসঘটিত একটি মারাত্মক রোগ। যুক্তরাষ্ট্রের ডেলওয়ারের একটি শহরের নামানুসারে এই রোগের নাম হয়, যেখানে রোগটি প্রথম ধরা পড়ে। সাধারণত তিন-চার সপ্তাহের ব্রয়লার মুরগি এতে আক্রান্ত হয়। বর্তমানে পৃথিবীর সব দেশেই রোগটির প্রাদুর্ভাব ঘটে। ঢাকা ও শহরতলিতে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিপুলসংখ্যক মুরগিছানা সম্ভবত গামবোরো রোগেই মারা গেছে। সংক্রমণ একবার শুরু হলে চার থেকে সাত দিন বয়সী প্রায় ৭০ শতাংশ বাচ্চাই আক্রান্ত হতে পারে। মৃত্যুহার ৫০ শতাংশের অধিক। সংক্রমিত খাদ্যের মাধ্যমে রোগটি দ্রুত ছড়ায়। রোগের প্রধান লক্ষণ এবড়োখেবড়ো পালকসহ মারাত্মক ডায়রিয়া।

রানিখেত মুরগির একটি তীব্র ভাইরাসরোগ। দৃশ্যত প্লেগের মতো হলেও এটি পৃথক ও অনাক্রম্যতানুসারে সুচিহ্নিত আরেকটি ভাইরাসজনিত রোগ। ১৯২৬ সালে ইংল্যান্ডের নিউক্যাসেøস্ অঞ্চলে প্রথম শনাক্ত হওয়ার জন্যই এ নামকরণ। রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হাঁচি, কাঁশি, জবুথবু অবস্থা, অতঃপর কাঁপুনি, পাক-খাওয়া, পড়ে-যাওয়া, মাথা ও গলা মোড়ানো বা সম্পূর্ণ পক্ষাঘাত। সব ব্রয়লার মুরগি এই রোগপ্রবণ হলেও তিন থেকে আট সপ্তাহ বয়সী মুরগিই বেশি আক্রান্ত হয়। মৃত্যুহার ৮০ থেকে ১০০ শতাংশ। প্রধান লক্ষণ হলুদ-সাদা রঙের চুনের মতো দুর্গন্ধযুক্ত উদরাময়। আরেকটি বিশিষ্ট লক্ষণ মুখে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস নেয়া। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এই রোগের প্রকোপ অত্যধিক এবং মুরগির মড়কের প্রধান হেতু। আক্রান্ত ডিম-পাড়া মুরগির ডিমের সংখ্যা ও মান দ্রুত হ্রাস পায়। চিকিৎসার জন্য এখন টিকা পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের হাঁস-মুরগির প্রচুর পরজীবী শনাক্ত করা হয়েছে, আর এগুলোর বেশিরভাগই সন্ধিপদ ও চ্যাপ্টা কৃমির দলভুক্ত। এক জাতের এঁটেল থাকে মুরগির খোয়ার ও খামারঘরের চিড় ও ফাটলে। পরজীবী হাঁস-মুরগির অনিদ্রা ও রক্তাল্পতা ঘটায়, উৎপাদন ক্ষমতা কমায় এবং এদের মধ্যে স্পাইরোকিটোসিস ও রিকেটসিয়ার মতো রোগ ছড়ায়। উকুন হাঁস-মুরগির ত্বকের উপরিভাগে বাস করে এবং চুলকানি, ওজন-হ্রাস, দুর্বলতা, ডিম-পাড়ার ক্ষমতাহানি এমনকি ছানাদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। বাংলাদেশে হাঁস-মুরগির প্রধানত ১২ প্রজাতির কৃমির মধ্যে অ. মধষষর ও জধরষষরবঃরহধ প্রজাতিগুলো আর্থিক দিক থেকে ক্ষতিকর রোগ ঘটায়। এতে সংক্রমণের স্থান অত্যধিক ফুলে ওঠে। গ্রামীণ পরিবেশে এই পরজীবী বেশি দেখা যায়।