বাণিজ্যিকভাবে কার্প মাছ চাষ করে লাভবান হওয়ার উপায়

241

বাণিজ্যিকভাবে কার্প মাছ চাষ তুলনামূলকভাবে সহজ। আজ এর বিস্তারিত তুলে ধরা হলো

কার্পজাতীয় মাছের মধ্যে সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, মিরর কার্প, বিগহেড কার্প, ব্ল্যাক কার্প, কার্পিও প্রভৃতি অন্যতম। বাংলাদেশে সাধারণত কার্পিও অন্যান্য রুইজাতীয় মাছের সঙ্গে একত্রে চাষ করা যায়। কেননা এ-জাতীয় মাছকে এককভাবে চাষ করা হয় না। চাষ করা গেলেও তা স্বল্প সময়ের জন্য হয়ে থাকে। কার্প চাষের জন্য আঁতুড় পুকুর ও চারা পুকুর রুইজাতীয় মাছ চাষের অনুরূপ পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়। আঁতুড় ও চারা পুকুরে সার হিসেবে জৈব সার বেশি ব্যবহার করা হয়। অন্য সারের প্রয়োজন পড়ে না। এ কারণে কার্প মাছের চাষ অত্যন্ত সহজ ও লাভজনক।

মাছ চাষের জন্য প্রথমে নির্বাচন করতে হবে উপযুক্ত পুকুর। তা না হলে মাছ চাষে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বাংলাদেশে সাধারণত শীতকালে কার্পের চাষ করা হয়। চাষ করা পুকুরে পানির গভীরতা দুই থেকে তিন মিটার হওয়া উচিত। দোআঁশ মাটির পুকুর হলে ভালো। পুকুরপাড়ে যেন বড় গাছপালা বেশি না থাকে। এমন পুকুরে কার্পের পোনা ছাড়া যায়। তবে এ সময়ে পুকুরে পূর্ববর্তী মৌসুমের রুইজাতীয় মাছও মজুত থাকতে পারে। তাই কার্পের মজুদ সাধারণত মধ্যবর্তী মজুত হিসেবে ধরা হয়। তবে কার্প পোনা পুকুরে ছাড়ার আগে পুকুর শোধন করে নেওয়া উত্তম। এজন্য পুরোনো মাছ পুকুর থেকে তুলে পানি শুকিয়ে নিতে হবে। এ সময় রাক্ষুসে মাছ বা অবাঞ্ছিত মাছ সরিয়ে ফেলা যায়। এরপর জৈব সার ও চুন দিয়ে পরিষ্কার পানি ছেড়ে পুকুর পূর্ণ করতে হবে। পুরোনো মাছসহ কার্পের পোনা পুকুরে ছাড়তে হবে। কার্পের পরিপূরক খাদ্য হিসেবে খৈল, চালের কুঁড়া, মৎস্যচূর্ণ প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়। একক ও প্রধান মাছ হিসেবে চাষ করা হলে এসব খাবার ছাড়াও গম বা আটা, শামুক, ঝিনুক, সয়াবিনের খৈল, নারকেলের খৈল, শাকসবজির উচ্ছিষ্ট প্রভৃতি দেওয়া হয়।

চাষের সুবিধা-অসুবিধা

বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও কার্প মাছ চাষ করা হয়। বাণিজ্যিকভাবে এ-জাতীয় মাছের চাষ তুলনামূলক সহজ। পাশাপাশি কিছু অসুবিধাও রয়েছে। এসব সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন:

সুবিধা

# বদ্ধ জলাশয়েও কার্প মাছ প্রজনন ঘটায়। জলাশয়ের নানা স্তরের খাবার খেতে পারে

# এরা রাক্ষুসে স্বভাবের নয়। তাই খাদ্য ও স্থান নিয়ে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়

# কষ্টসহিষ্ণু ও রোগ-প্রতিরোধক্ষমতা তুলনামূলকভাবে বেশি

# অম্ল ও ক্ষারযুক্ত পানিতেও টিকে থাকতে পারে

# ২০ থেকে ৩০ শতাংশ লবণাক্ত পানিতে চাষ করা যায়

# দ্রুত বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎপাদন হার তুলনামূলকভাবে বেশি

# পুকুরের তলদেশের খনিজ উৎপাদন ও পুষ্টিকারক পদার্থ তৈরিতে সহায়তা করে

# বেঁচে থাকার হার তুলনামূলক বেশি। নি¤œমানের খাবার খাওয়ানো যেতে পারে

# অভিজ্ঞতা ছাড়াও চাষ করা যেতে পারে

# খেতে সুস্বাদু। ফলে এর চাহিদা রয়েছে।

অসুবিধা

# পুকুরের তলদেশ ও পাড়ের মাটিতে কার্প মাছ খাদ্য অন্বেষণ করে, এতে পানির ঘোলার হার বাড়ে ও পাড় ভেঙে যায়

# তলদেশে বিচরণকারী ও গর্তে বাস করার স্বভাব বলে আহরণ করা কষ্টসাধ্য

# তলদেশে বিচরণকারী দেশি মাছের প্রতিদ্বন্দ্বী

দেশে দেশে প্রজনন পদ্ধতি

পুকুরে প্রাকৃতিক উপায়ে প্রজনন করে কার্প মাছের পোনা তৈরি করা হয়। এ মাছের প্রজননের জন্য বিভিন্ন দেশে নানা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। ব্যবস্থাপনার বৈশিষ্ট্যের কারণেই পদ্ধতিতে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়:

বাংলাদেশি পদ্ধতি: প্রজনন মৌসুমের দুই থেকে তিন মাস আগে মাছ পুকুর থেকে আলাদা করে অন্য পুকুরে মজুত করা হয়। প্রজননের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুকুর সেচ দিয়ে শুকিয়ে রাক্ষুসে মাছ, আমাছা ও পোকামাকড় নির্মূল করা হয়। সেচের পর চুন ছিটিয়ে পানি শোধন করতে হয়। শোধনের পরে পানি দিয়ে পুকুর পূর্ণ করা হয়। পূর্ণ করার এক সপ্তাহের মধ্যে মাছ ছেড়ে দেওয়া হয়। পুকুর ছাড়াও হাপা কিংবা হ্যাচারির সারকুলার ট্যাংকেও প্রজনন সম্পন্ন করা যায়। সম্পূরক খাদ্য হিসেবে খৈল, চালের কুঁড়া, গমের ভুসি, মৎস্যচূর্ণ প্রভৃতির মিশ্রণ দেওয়া হয়। সাধারণত কচুরিপানার সাহায্যে ডিম সংগ্রাহক বা বাসা তৈরি করা হয়। কচুরিপানা ছাড়াও পাটের আঁশ, ঝাউ, নারকেলের ছোবড়া প্রভৃতি ব্যবহার করা যায়। প্রজননপর্ব সম্পন্ন হলে প্রজনন পুকুর থেকে মাছ সরিয়ে পুকুরেই পোনা তৈরি করা হয়, অথবা বাসাসহ নিষিক্ত ডিম তুলে এনে হাপা বা ট্যাংকে পোনা তৈরি করা হয়।

ভারতীয় পদ্ধতি

প্রজনন মৌসুমের কয়েক মাস আগে স্ত্রী ও পুরুষ মাছ আলাদা পুকুরে মজুত করা হয়। পরিপক্ব মাছকে খৈল ও চালের কুঁড়ার মিশ্রণ খেতে দেওয়া হয়। ভারতীয় পদ্ধতিতে এ মাছের প্রজনন হয় হাপা, পাকা চৌবাচ্চা অথবা ছোট পুকুরে। একটি স্ত্রী মাছের সঙ্গে দুই থেকে তিনটি পুরুষ মাছ প্রজননের উদ্দেশ্যে হাপায় ছেড়ে দেওয়া হয়। নির্গমনশীল সাধারণ জলজ আগাছা ডিম সংগ্রাহক হিসেবে হাপায় দেওয়া হয়। নারকেলের ছোবড়াও কখনও কখনও

ব্যবহার করা হয়। হাপা কিংবা চৌবাচ্চায় সন্ধ্যায় মাছ ছাড়া হয়। ছাড়ার ছয় থেকে আট ঘণ্টার মধ্যে প্রজনন সম্পন্ন করে। প্রজননের চার-পাঁচ দিনের মধ্যে হাপা থেকে রেণুপোনা সংগ্রহ করা হয়।

ইউরোপীয় পদ্ধতি

ইউরোপের দেশগুলোয় কার্পের প্রজননের সাধারণ পদ্ধতি ডুবিসচ পদ্ধতি নামে পরিচিত। এ পদ্ধতিতে ১৫ মিটার পরিমাপের পুকুর প্রজননের জন্য ব্যবহার করা হয়। প্রজননের আগে পুকুর শুকিয়ে তলদেশে ঘাস জš§ানো হয়। ডিম সংগ্রাহক হিসেবে ঘাস প্রায় ৪০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়তে দেওয়া হয়। এরপর প্রজনন উপযোগী মাছ লবণপানিতে কিছুক্ষণ রেখে পুকুরে ছাড়া হয়। ভারতীয় পদ্ধতির মতো একটি স্ত্রী মাছের সঙ্গে দুটি পুরুষ মাছ রাখা হয়। প্রজননসম্পন্ন হওয়ার পর মাছ অপসারণ করা হয়। প্রজননের পাঁচ থেকে সাত দিন পর পোনা সংগ্রহ করে আঁতুড় পুকুরে স্থানান্তর করা হয়। এখানে ডুবিসচ পদ্ধতি ছাড়াও আরও কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে। যেমন জিমিন্দ পদ্ধতি, রান্তজাপাকু ও সুমাত্রা পদ্ধতি। মৎস্যবিজ্ঞানীরা প্রজনন ও পরিস্ফুটনের ক্ষেত্রে কৌশলগত পরিবর্তন সফল করে উদ্ভাবন অনুযায়ী এমন নামকরণ করেছেন। জিমিন্দ পদ্ধতিতে একই পুকুরে অস্থায়ী পাড় বা বাঁধ দিয়ে কুঠুরি তৈরি করে প্রজনন পুকুর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। রান্তজাপাকু পদ্ধতিতে তলদেশ বালুকাময় ও পাথুরে পুকুর ব্যবহার করা হয়। প্রজনন ও পরিস্ফুটন পুকুর পাশাপাশি অবস্থানে তৈরি করা হয়। দুই পুকুরের মধ্যবর্তী নুড়িপাথরের বাঁধ সুবিন্যস্ত থাকে। প্রজননের পর নিষিক্ত ডিম প্রবাহের কারণে বাঁধের ফাঁক দিয়ে পরিস্ফুটন পুকুরে চলে আসে। এ পদ্ধতিতে সতেজ কাটা ঘাস ডিম সংগ্রাহক হিসেবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সুমাত্রা পদ্ধতিতে তন্তু বা আঁশ প্রজনন পুকুরে পরিমিত স্থানজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তবে ডিম সংগ্রহের বেলায় তন্তু ব্যবহার করা হয় না। প্রজননের পাঁচ দিনের মধ্যে রেণুপোনা আঁতুড় পুকুরে স্থানান্তর করা হয়।

ইন্দোনেশীয় পদ্ধতি

ইন্দোনেশিয়ায় কার্প প্রজননে সুন্দানিজ গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে বিবেচ্য। এ পদ্ধতিতে ডিমওয়ালা মাছের পরিচর্যা করা হয়। মাছকে চালের কুঁড়া ও রান্নাঘরের উচ্ছিষ্ট খাবার হিসেবে দেওয়া হয়। পুকুরের তলদেশ কাদা ও আবর্জনামুক্ত করে শক্ত ভেদ তৈরি করা হয়। এরপর কয়েক দিন পুকুর শুকিয়ে নিতে হয়। মাছ ছাড়ার আগে পরিষ্কার পানি দিয়ে পূর্ণ করে ডিম সংগ্রাহক বা বাসা তৈরির জন্য মসৃণ তন্তু ছিটিয়ে দেওয়া হয়। বিছানো শেষ হলে পুকুরের চারপাশে বাঁশের চটার সাহায্যে বেড়া বাঁধতে হয়।

পরিচর্যা ও সতর্কতা

স্বাস্থ্যকর মাছের জন্য নিয়ন্ত্রিত নিবিড় পরিচর্যা দরকার। মাছ কিংবা পোনার বিশেষ যত্ন না নিলে মাছ বড় হবে না।

কার্প যেনতেন পুকুরে চাষ করা উচিত নয়। যেহেতু এরা খাওয়ার ক্ষমতার দিক থেকে দুর্বল, তাই কঠিন পরিবেশের সঙ্গে সহজে মানিয়ে নিতে পারে না। প্রজনন থেকে পোনা হওয়া পর্যন্ত আলাদা হাপা বা ট্যাংকে লালন করতে হবে। আট থেকে ১২ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য হলে পুকুরে স্থানান্তর করতে হবে। যে পুকুরে রাখা হবে, সে পুকুরের সার ব্যবস্থাপনা ঠিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ-জাতীয় মাছ ছাড়ার আগে পুকুরে যেন রাক্ষুসে মাছ না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। খাদ্য

ব্যবহার, পুকুরের পানি পরিবর্তনের সুযোগ এবং পানিতে অক্সিজেনের জোগানের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

পোনা মজুতের পর থেকেই প্রতিদিন সকাল ও বিকালে খাদ্য দিতে হবে। মাছের সম্পূরক খাদ্যে আমিষ বেশিরভাগ থাকলে ভালো। অতিরিক্ত সার দেওয়া যাবে না, এতে পানি দূষিত হতে পারে। তাছাড়া মাছ চাষে সফলতা অধিকাংশে নির্ভর করে পুকুরে পানির পরিবেশের ওপর। পুকুরে যেন পচন না ধরে, সেদিকে নজর দিতে হবে। পুকুরে গাছে পাতা পড়ে অনেক সময় পানির পরিবেশ নষ্ট হয়। এর প্রতিকারের জন্য পুকুরপাড়ের গাছের ডালপালা কেটে ফেলতে হবে। প্রয়োজনে পুকুরপাড়ে বেশি গাছ না রাখাই উত্তম। নালা-নর্দমার বিষাক্ত পানি পুকুরে যাতে কোনোভাবে প্রবেশ করতে না পারে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ এসব উপাদান কার্প মাছের ক্ষতি করে, দ্রুত রোগবালাই সংক্রমণ করে। মাছ বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পর আর দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে না, তাই বাজারজাত করার উপযোগী মাছ ধরতে হবে। কারণ পুকুরে সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতার মাছ বেশি রাখলে ছোট মাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।