বাণিজ্যিকভাবে ছাগলের খামার করতে আগ্রহী নতুন খামারিদের জন্য

2032

উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে আমাদের যে পরিমান কর্মসংস্থান থাকা দরকার ছিল বাস্তবে কিন্তু তা নেই। অনেক শিক্ষিত বেকার ভাল সুযোগের অভাবে কিছু করতে পারছে না। তাদের জন্য আমাদের আজকেই এই পোস্টটি। আশা করি উপকৃত হবেন।

ছাগল-পালন বাংলাদেশের আবহাওয়া এবং প্রেক্ষাপটে একটি লাভজনক ব্যবসা, তবে ছাগলের খামার করার পূর্বে আপনাকে অবশ্যই এ বিষয়ে কিছু ধারণা এবং প্রশিক্ষন নিয়ে নিতে হবে। যারা নতুন ছাগলের খামার করার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করছেন তাদের জন্য “রুফাকা এগ্রো প্লান্ট” এর পক্ষ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করছি, ধন্যবাদ।

বাণিজ্যিক ভাবে ছাগলের খামার করতে হলে আপনাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে আধুনিক পদ্ধতির সেড তৈরী, ভাল জাতের ছাগল নির্বাচন, ভেকসিনেশন ব্যবস্থা এবং ঘাস চাষের উপর। তাছাড়াও সততা, পরিশ্রম, ধৈর্য্য, শিক্ষা এবং বিচক্ষনতার কোন বিকল্প নেই। আধুনিক পদ্ধতির সেড তৈরী না করলে আপনার খামারে সহজেই ভাইরাস এবং ব্যাকক্টেরিয়া আক্রমন করবে, ফলে ছাগলগুলো বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা বেশি থাকবে, তাই বাণিজ্যিক ভাবে ছাগল-পালন করতে গেলে একটু বেশি খরচ হলেও আধুনিক পদ্ধতির সেড তৈরী করে নিন। আধুনিক পদ্ধতির সেডের ডিজাইন এবং প্রোফাইল পেতে “রুফাকা এগ্রো প্লান্টের” অফিসে যোগাযোগ করুন।

যারা একেবারেই নতুন তারা প্রথমে বড় করে শুরু না করে ১০,১২ মাস ৮-১০টা ছগল নিয়ে পরীক্ষা মূলকভাবে শুরু করুন, তাহলে দেখা যাবে এই ১০,১২ মাসে আপনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ নতুন কিছু তথ্য পেয়ে যাবেন, যা পরবর্তিতে আপনার বাণিজ্যিক খামারে কাজে লাগাতে পারবেন। প্রথমে ৮-১০ টা ছাগলকে ক্রস করানোর জন্যে একটি ভাল জাতের পাঠা প্রয়োজন হবে যা “রুফাকা এগ্রো প্লান্ট” আপনাকে সরবরাহ করবে। আর “ফিমেল” ছাগল সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারনা দিয়ে দিলে সেগুলো আপনারা বাজার থেকেই কিনি নিতে পারবেন।

হাইড্রোফনিক ঘাস উৎপাদনের ব্যপারে “রুফাকা এগ্রো প্লান্ট” আপনাদের সর্বাত্তক সহযোগীতা করবে তবে নেপিয়ার এবং ভেকসিনেশন ব্যবস্থা সম্পর্কে যেনে নিতে স্থানিয় “প্রাণী হাসপাতাল” এবং “প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরে” যোগাযোগ করুন।

বাণিজ্যিকঃ

বাণিজ্যিক ভাবে ছাগল-পালন করার সময় বিষয়গুলো মেনে চলুন। খামার এলাকার বেড়া বা নিরাপত্তা বেস্টনীগুলো এমনভাবে নির্মান করুন যাতে সেখানে অনাকাংখিত ব্যক্তি, শেয়াল-কুকুর ও অন্যান্য বন্যপ্রাণী প্রবেশ করতে না পারে। প্রবেশপথে ফুটবাথ বা পা ধোয়ার জন্য ছোট চৌবাচ্চায় জীবাণুনাশক মেশানো পানি রাখতে হবে। খামারে প্রবেশের আগে খামারে গমনকারী তার জুতা/পা ডুবিয়ে জীবাণুমুক্ত করবেন।

খামারের জন্য সংগৃহীত নতুন ছাগল সরাসরি খামারে পূর্বে বিদ্যমান ছাগলের সাথে রাখা যাবে না। নতুন আনীত ছাগলদেরকে স্বতন্ত্র ঘরে সাময়িকভাবে পালনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ধরনের ঘরকে পৃথকীকরণ ঘর বা আইসোলেশন সেড বলে। অন্ততপক্ষে ১২-১৪দিন এই সেডে রাখা বিশেষ জরুরি। এসব ছাগলের জন্য প্রাথমিক কিছু চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রথমে এদেরকে কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে।

এজন্য বহিঃপরজীবী এবং আন্তঃ পরজীবীর জন্য কার্যকর কৃমিনাশক প্রয়োগ করতে হবে। চর্মরোগ প্রতিরোধের জন্য প্রতিটি ছাগলকে (০.৫%) শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ ম্যালাথিয়ন দ্রবণে গোসল করাতে হবে। আইসোলেশন শেডে ছাগল রাখার পর ১৪ দিনের মধ্যে যদি কোনো রোগ না দেখা দেয় তাহলে প্রথমে পিপিআর রোগের ভ্যাকসিন এবং সাত দিন পর গোটপক্সের ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে হবে। শেষ টিকা প্রদানের সাত দিন পর এসব ছাগলকে মূল খামারে নেয়া যেতে পারে। প্রতিদিন সকাল এবং বিকালে ছাগলের ঘর বা সেড পরিষ্কার করতে হবে। কোনো ছাগল যদি অসুস্থ হয় তাহলে তাকে আলাদা করে আইসোলেশন শেডে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি কোনো ছাগল মারা যায় তবে অবশ্যই তার কারণ সনাক্ত করতে হবে।

ল্যাবরেটরিতে রোগ নির্ণয়ের পর তদনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বিশেষ করে অন্যান্য ছাগলের অন্য নিতে হবে। মৃত ছাগলকে খামার থেকে দূরে নিয়ে মাটির গভীরে পুতে বা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। রোগাক্রান্ত ছাগলের ব্যবহার্য সকল সরঞ্জামাদি ও দ্রব্যাদি সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।

ছাগলের ঘর, সেড বা বাসগৃহঃ

ছাগলের ঘর শুষ্ক, উচুঁ, পানি জমেনা এমন স্থানে স্থাপন করতে হবে । পূর্ব পশ্চিমে লম্বালম্বি, দক্ষিণ দিক খোলা এমন হলে ভাল হয়। এক্ষেত্রে কাঠাঁল, ইপিল ইপিল, কাসাভা ইত্যাদি গাছ লাগানো যেতে পারে। এছাড়া পানি নিষ্কাশনের জন্য উত্তম ব্যবস্থা আছে এমন স্থানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ছাগল ঠাসাঠাসি অবস্থায় বাস করতে পছন্দ করে না। এরা মুক্ত আলো বাতাস এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন স্থানে থাকতে পছন্দ করে। এক জোড়া ছাগলের জন্য ৫-৬ ফুট লম্বা, ১.৫-২ ফুট চওড়া এবং ৬-৭ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট খোয়াঁড় প্রয়োজন।

প্রতিটি পূর্ণ বয়স্ক ছাগলের জন্য গড়ে ১২-১৪ বর্গ ফুট এবং বাড়ন্ত বাচ্চার জন্য ৪-৮ বর্ঘ ফুট জায়গা প্রয়োজন। ছাগলের ঘর ছন, গোলপাতা, খড়, টিন বা ইট নির্মিত হতে পারে। তবে ঘরের ভিতর কাঠের মাচা প্রস্তুত করে তার উপর ছাগল রাখা উচিত। মাচার উচ্চতা মাটি থেকে ১ মিটার বা (৩.৩৩ ফুট) এবং মাচা থেকে ছাদের উচ্চতা ৮-১০ ফুট হবে । মল-মূত্র নিষ্কাষনের গোবর ও চনা সুবিধার্থে কাঠের মাঝে ১সেঃ মিঃ ফাক লাখতে হবে। মল-মুএ গুলো যেন মাচা থেকে পড়ার সাথে সাথে ড্রেনে চলে যায় সেভাবে সেড তৈরী করতে হবে। বৃষ্টি যেন সরাসরি ঘরের ভিতর প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য ছাগলের ঘরের চালা (৩-৩.৫ ফুট) ঝুলিয়ে দিতে হবে। শীতকাল ছাড়াও সেডের চারপাশে তৃপাল বা পর্দার ব্যবস্থা রাখতে হবে। পাঠাঁর জন্য অনুরূপভাবে পর্যাপ্ত আলো বাতাস ও মল-মূত্র নিষ্কাষনের উত্তম সুবিধাযুক্ত পৃথক খোয়াড় তৈরি করতে হবে। শীতকালে মাচার উপর ১.৫ ইঞ্চি পুরু খড় বিছিয়ে তার উপর ছাগল রাখতে হবে। প্রতিদিন ভালোভাবে পরিষ্কার করে রৌদ্রে শুকিয়ে পুনরায় বিছাতে হবে।

ছাগলের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাঃ

একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে মুক্তভাবে ছাগল প্রতিপালনের তুলনায় আবদ্ধ অবস্থায় ছাগল পালন অনেক বেশি ঝুকিপূর্ণ। এ ব্যবস্থায় বৈজ্ঞানিক চিন্তা-ভাবনা ও প্রযুক্তির সমন্নয় না ঘটালে খামারীকে বিস্তর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এটা একটি বাস্তব উপলদ্ধি। এজন্য ছাগলের সুখ-সাচ্ছন্দ্য ও স্বাস্থ্যর প্রতি খামারীকে স্বতন্ত্র ভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। ছাগলের খামারে রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে থাকে। তাই বিভিন্ন রোগ দমনের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে খামার থেকে লাভের আশা করা যাবে না। খামারে ছাগল-আনার পর থেকে প্রতিদিনই প্রতিটা ছাগলের স্বাস্থ্যের দিকে থেয়ল করতে হবে। প্রথম পাঁচ দিন সকাল ও বিকালে দুবার থার্মোমিটার দিয়ে ছাগলের দেহের তাপমাত্রা পরীক্ষা করতে হবে। হঠাৎ কোনো রোগ দেখা মাত্রই পশু চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। তীব্র শীতের সময় ছাগী বা বাচ্চাদের গায়ে চট পেঁচিয়ে দেয়া যেতে পারে। মাচার নিচ এবং ঘর প্রতিদিন সকালে পরিষ্কার করতে হবে এবং কর্মসূচি অনুযায়ী জীবাণুনাশের ব্যবস্থা নিতে হবে।

সুস্থ ছাগলের বৈশিষ্ট্যঃ

সুস্থ ছাগলের নাড়ীর স্পন্দন প্রতি মিনিটে ৭০-৯০ বার, শ্বাস-প্রশ্বাস প্রতি মিনিটে ২৫-৪০ বার এবং তাপমাত্রা ৩৯.৫ সেঃ হওয়া উচিত। সুস্থ ছাগল দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করে, মাথা সবসময় উঁচু থাকে, নাসারন্ধ থাকবে পরিষ্কার, চামড়া নরম, পশম মসৃন ও চকচকে দেখাবে এবং পায়ু অঞ্চল থাকবে পরিচ্ছন্ন। ছাগল সুস্থ রাখতে যেসব ব্যবস্থাদি গ্রহণ করা আবশ্যক সেগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ

কর্মসূচি অনুযায়ী টিকা প্রদানঃ

ভাইরাসজনিত রোগ যেমন পিপিআর, গোটপক্স, ক্ষুরারোগ ইত্যাদি এবং ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ যেমন এনথ্রাক্স, ব্রুসেলোসিস ইত্যাদি খুবই মারাত্মক বলে এগুলোর বিরুদ্ধে যথারীতি টিকা প্রদান করতে হবে। যেসব ছাগীকে পূর্বে পিপিআর, গোটপক্স, একথাইমা, ব্রুসেলোসিস ইত্যাদি টিকা দেয়া হয়নি তাদেরকে গর্ভের ৫ম মাসে উক্ত ভ্যাকসিনগুলি দিতে হবে। বাচ্চার বয়স যখন ৫ মাস তখন তাকে পিপিআর ভ্যাকসিন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন দিতে হবে।

ছাগলের টিকা প্রদান কর্মসূচিঃ
পিপিআর ১ মিঃ চামড়ার নীচে ইন্জেকশন

ক্ষুরা রোগ ১ মিঃ চামড়ার নীচে ইন্জেকশন
এ্যানথ্র্যাক্স ১ মিঃ চামড়ার নীচে ইন্জেকশন

কৃমিনাশক ঔষধ প্রয়োগঃ

সকল ছাগলকে নির্ধারিত মাত্রায় বছরে তিনবার কৃমিনাশক ঔষধ প্রদান করতে হবে। কৃমিনাশক কর্মসূচি অনুসরণের জন্য পশু চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

মহান আল্লার দরবারে “শিপ এন্ড গট ফার্মিং বাংলাদেশ”সহ আপনাদের সকলের ব্যবসায়িক জীবনের সাফল্য কামনা করে আজকের মত এখানেই শেষ করছি, আল্লাহ হাফেজ।

ফার্মসএন্ডফার্মার/১১আগস্ট২০