কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। জীবনজীবিকার পাশাপাশি আমাদের সার্বিক উন্নয়নে কৃষি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তাই কৃষির উন্নয়ন মানে দেশের সার্বিক উন্নয়ন। টেকসই কৃষি উন্নয়নে সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কৃষি ক্ষেত্রে সময়োপযোগী পদক্ষেপ এবং দিকনির্দেশনায় খোরপোশের কৃষি আজ বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। খাদ্যশস্য উৎপাদন, টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, কর্মসংস্থান ও রপ্তানি বাণিজ্যে কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিজমি কমতে থাকাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। ধান, গম ও ভুট্টা বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের স্থান দশম। দারিদ্র্য, ঘনবসতি, নগরজীবনের নানা অনিশ্চয়তা আর জলবায়ুর পরিবর্তনের ভেতর বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও টিকে থাকার মূল জায়গাটি হচ্ছে ভূমি ও কৃষক সম্প্রদায়।
উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দানাদার খাদ্যশস্যের উৎপাদন (৪৩২.১১ লাখ মেট্রিক টন) এর লক্ষ্যমাত্রা (৪১৫.৭৪ লাখ মেট্রিক টন) ছাড়িয়ে গেছে।
দেশ আজ চালে উদ্বৃত্ত; ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ। ভুট্টা উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৪৬ লাখ টন। নিবিড় চাষের মাধ্যমে বাংলাদেশ সবজি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। সবজি উৎপাদন বেড়ে ১ কোটি ৭২ লাখ ৪৭ হাজার টন হয়েছে। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ উদ্বৃত্ত এবং বিশ্বে সপ্তম। এ বছর আলু উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৯ লাখ টন। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। দেশে ফল উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। আম উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম এবং পেয়ারায় অষ্টম। আম উৎপাদন প্রায় ২৪ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে।
আলুসহ বিভিন্ন সবজি, ফল ও ফুল রপ্তানি সম্প্রসারণের নিমিত্তে উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থা উন্নয়নসহ কার্যকর ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। যশোরের গদখালির পলিহাউসে রপ্তানিযোগ্য ফুল এবং নিরাপদ সবজি উৎপাদনের উদ্যোগ দেশি-বিদেশি মহলে প্রশংসিত হয়েছে। কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি ও নিরাপদ সবজি/ফল সহজলভ্য করার নিমিত্তে ঢাকায় শেরেবাংলা নগরে কৃষকের বাজার চালু করা হয়েছে যেখানে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি বাজারজাত করছে। ক্রমান্বয়ে এই ব্যবস্থা জেলা-উপজেলা শহরে সম্প্রসারিত হবে। ডাল, তেলবীজ, মসলা ও ভুট্টা চাষ বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন সহায়তা অব্যাহত আছে। এ ছাড়াও কাজু বাদাম ও কফি ইত্যাদি অর্থকরী ফসল চাষ ও বাজারব্যবস্থা উন্নয়নে মন্ত্রণালয় কাজ করছে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৩৩ কোটি ১৫ লাখ ৬২ হাজার টাকা কৃষি উপকরণ ও আর্থিক সহায়তা হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। ফসলের উন্নত ও প্রতিকূলতা সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনে অভূতপূর্ণ সাফল্য এসেছে। ২০১৮-১৯ সালে অবমুক্তকৃত বিভিন্ন ফসলের উদ্ভাবিত প্রতিকূলতা সহিষ্ণু জাত ১২টি, উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ৯৫টি এবং নিবন্ধিত জাত ২৬টি। গম ও ভুট্টার গবেষণা সম্প্রসারণের জন্য সরকার ২০১৮ সালে গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। গমের ১টি জাত উদ্ভাবন, গম ও ভুট্টার ৪ হাজার ৫শটি জার্মপস্নাজম সংগ্রহ এবং রোগবালাই ব্যবস্থাপনার ওপর ১টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সারাদেশে ৫৩ লাখ ৫৪ হাজার ৮০০ নারিকেল, তাল, খেজুর ও সুপারি চারা বিতরণ ও রোপণ করা হয়েছে। মাল্টা, রামবুতান, ড্রাগন প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের অপ্রচলিত ও বিদেশি ফল চাষে উৎসাহ প্রদান অব্যাহত রয়েছে। ২০১৮-১৯ সালে সম্প্রসারিত সেচ এলাকা ২২ হাজার ৮৪০ হেক্টর। সরবরাহকৃত সেচযন্ত্র ৫৪৭টি এবং স্থাপিত সোলার প্যানেলযুক্ত সেচযন্ত্র ৯৫টি। ৪৮০টি সেচ অবকাঠামো, ৫৮১ কিলোমিটার খাল-নালা খনন/পুনঃখনন, ৬৮২ কিলোমিটার ভূ-গর্ভস্থ (বারিড পাইপ) সেচনালা এবং ৮ কিলোমিটার ভূ-উপরিস্থ সেচনালা, ২৪ কিলোমিটার গাইড/ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। ক্ষুদ্র সেচ ব্যবস্থার আওতায় সৌরবিদ্যুৎ চালিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সুপেয় পানির ব্যবস্থাকরণ ও সেচ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ১০০টি পাতকুয়া স্থাপন করা হয়েছে।
কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে দেশের হাওর ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় কৃষকের জন্য ৭০ শতাংশ এবং অন্যান্য এলাকার জন্য ৫০ শতাংশ হারে কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ভর্তুকি প্রদান করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৩২২ কোটি ৮০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এ জন্য নতুন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। জাতীয় কৃষি যান্ত্রিকীকরণ নীতিমালা-২০১৯ চূড়ান্ত করা হয়েছে, যাতে বিনা সুদে কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ঋণের ব্যবস্থা থাকবে। ডিজিটাল কৃষি তথা ‘ই-কৃষি’ প্রবর্তনের ধারা জোরদার করা হয়েছে। দেশে মোট ৪৯৯টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র (এআইসিসি), কৃষি কল সেন্টার ১৬ হাজার ১২৩, ইউটিউব, কৃষি তথ্য বাতায়ন, কৃষক বন্ধু ফোন-৩ হাজার ৩৩১, ই-বুক, অনলাইন সার সুপারিশ, ই-সেচসেবা, কৃষকের জানালা, কৃষকের ডিজিটাল ঠিকানা, কমিউনিটি রেডিওসহ বিভিন্ন মোবাইল এবং ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ও সফটওয়্যার ব্যবহৃত হচ্ছে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/১৩জানু২০২০