বাড়ির আঙিনায় ঢেঁড়শের বীজ বপন করবেন যেভাবে

834

ঢেঁড়শ বাংলাদেশে একটি জনপ্রিয় সবজি। শীতের সময়টুকু ছাড়া ঢ্যাঁড়শ প্রায় সারা বছরই চাষ করা যায়, তবে গ্রীষ্মকালেই এর চাষ বেশি হয়। শীতের শেষ দিকে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ থেকেই ঢেঁড়শের বীজ বপন করে আগাম ফসল সংগ্রহ করা যায়। কচি ঢেঁড়শ সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

ঢেঁড়শ গাছের কান্ড থেকে আঁশ পাওয়া যায়, যা দিয়ে ঘরে ব্যবহার্য দড়ি তৈরি করা সম্ভব। এছাড়া এটা সংগ্রহের শেষ পর্যায়ে যখন ফলন কমে যায়, তখন গাছের গোড়া নিচ থেকে ১৫-২০ সে.মি. উপরের দিকে কেটে দেয়ার পর নতুন যে কুশি বের হয় তার থেকে বাছাই করা সুস্থ ও সতেজ একটি শাখা রেখে দিলে আবারও নতুন করে ঢেঁড়শ পাওয়া যায় প্রায় আগের মতোই। এটিকে ঢেঁড়শ মুড়ি চাষও বলা যায়। জমিতে বাণিজ্যিক আকারে চাষ করা ছাড়াও বসতবাড়ির বাগানে বা ছাদ বাগানেও ঢেঁড়শ চাষ করা যায়।

উপযোগী আবহাওয়া ও মাটি: ঢেঁড়শ একটি উষ্ণ মৌসুমের সবজি। এর বীজ গজানোর জন্য কম তাপমাত্রা লাগলেও বৃদ্ধি ও ফুল ফল ধারণের জন্য দীর্ঘ সময় গরম আবহাওয়ার প্রয়োজন হয়। সব ধরনের মাটিতেই ঢ্যাঁড়শ ভাল হয়, তবে বেলে দো-আঁশ বা এঁটেল দো-আঁশ মাটি এবং মাটির অম্লমান ৬.০-৬.৮ থাকা এর চাষের জন্য সবচেয়ে ভালো। ৪-৫টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে ও সমতল করে নিতে হয়।

জাত : বাংলাদেশে মোজাইক ভাইরাস প্রতিরোধী সবচেয়ে ভালো জাত হলো- বারি ঢ্যাঁড়শ-১। এ ছাড়া উফশী জাতের অরকা অনামিকা (নামধারী মালিক সিডস), ওকে ২৮৫, অর্কা অনামিকা ও চয়েস (লালতীর), বারি ঢ্যাঁড়শ-১ (ইস্পাহানি) এবং হাইব্রিড জাতের মধ্যে- উত্তম, রানী ও বিনয় (এ আর মালিক সিড), সিলভিয়া-৫, লাকী-৭ (লালতীর), সিরাজউদ্দৌলা, গোলাম হোসেন, আলেয়া (মলিস্নকা সিড), এভারগ্রিন (ব্র্যাক সিড), গ্রিন এনার্জি ও গ্রিন গ্লোরি (সুপ্রিম সিড), তিশান, পরশ প্লাস, পলক ও সরস-২ (সিনজেনটা বাংলাদেশ), গ্রিন লেডি ও গ্রিন ফিংগার (এসিআই সিড) জাতগুলো ভালো ফলনের জন্য উল্লেখযোগ্য।

বীজ বপনকাল : গ্রীষ্মকালে ফেব্র“য়ারি মাস থেকে মে মাস ঢ্যাঁড়শ বীজ বপন করা যায়। ভালোভাবে পরিচর্যা করলে জুলাই মাস পর্যন্ত বপন করা গাছ থেকে শীতের শুরু পর্যন্ত ফলন পাওয়া যেতে পারে। প্রতি শতকে প্রায় ১৫-২০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। ঢ্যাঁড়শের বীজের খোসা খুবই শক্ত, তাই বীজ বপনের আগে ২৪ ঘণ্টা বীজ পানিতে ভিজিয়ে রাখলে অঙ্কুরোদগম দ্রুত হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব ৪৫-৫০ সেমি. এবং সারিতে গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৩৫-৪০ সেমি. রাখতে হয়।

উঁচু ভেলি বা নালা করে তার মধ্যে বীজ বপন করতে হয়। সার ব্যবহার : শতক প্রতি ৪০ কেজি শুকনো পচা গোবর, ৬০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৪০০ গ্রাম টিএসপি ও ৬০০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হয়। এ ছাড়া মাটির ধরন অনুযায়ী প্রতি শতকে জিপসাম ৪০০ গ্রাম, জিংক সালফেট ৪০ গ্রাম ও বোরন সার ৪০ গ্রাম প্রয়োগ করা যেতে পারে। গোবর ও টিএসপি সার সবটুকু ও ইউরিয়া ১৫০ গ্রাম শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হয়। পরে ৩ কিস্তিতে প্রতিবারে ইউরিয়া ২০০ গ্রাম ও এমওপি ১৫০ গ্রাম সার চারা গজানোর ২০ দিন, ৪০ দিন ও ৬০ দিন পরে উপরি প্রয়োগ করতে হয়।

আন্তঃপরিচর্যা : চারা অবস্থায় আগাছা নিড়ানো, গোড়ায় মাটি তুলে দেয়া, দুর্বল ও ঘন হয়ে জন্মানো গাছ তুলে ফেলতে হয়। বীজ বপনের আগে যদি মাটিতে রস কম থাকে তাহলে সেচের ব্যবস্থা করতে হয়। এ ছাড়া চারা গজানোর পর থেকে ফলন্ত গাছে মাটির রসের অবস্থা বুঝে ৪-৫ দিন পর পর সেচের ব্যবস্থা করতে হয়। অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হয়।

ফসল সংগ্রহ : বীজ বপনের ৩৫-৪০ থেকে ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে জাত ভেদে ঢ্যাঁড়শ গাছে ফুল আসে এবং ফুল ফোঁটার ৬-৭ দিনের মধ্যেই ৮-১০ সেমি দৈর্ঘ্যরে কচি ফল সংগ্রহ উপযোগী হয়। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই কচি ফল সকালের দিকে সংগ্রহ করতে হয়। গাছ থেকে ঢ্যাঁড়শ সংগ্রহে দেরি করলে ফলের ভেতরের আঁশ শক্ত হয়ে খাবার অনুপযোগী হয়ে বাজারমূল্য কমে যায়।

বালাই ব্যবস্থাপনা : ঢ্যাঁড়শগাছ পাতার হলুদ মোজাইক ও শিরা স্বচ্ছতা রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। এ রোগে আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হয়। বাকি সুস্থ গাছে যদি সাদা মাছি পোকার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় তাহলে ডাইমেথোয়েট (১ মিলি) বা ইমিডাক্লোরপিড (০.৫ মিলি) জাতীয় কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হয়। কীটনাশক স্প্রে করার পর ১৫ দিন পর্যন্ত কোনো ঢ্যাঁড়শ সংগ্রহ করা উচিত নয়। শুকনো আবহাওয়ায় সাদা গুঁড়া রোগে সংক্রমিত ঢ্যাঁড়শ গাছের পাতার নিচের দিকে ধূসর স্তুপ দেখা যায়।

সংক্রমণ ব্যাপক হলে পাতা হলুদ হয়ে ঝরে পড়ে, গাছ দুর্বল হয়ে যায়। ৮০% সালফার গুঁড়া প্রতি লিটার পানিতে ১-২ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করলে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কান্ড ও ফলছিদ্রকারী পোকা বাড়ন্ত গাছের কান্ড, ফুল ও কচি ফল ছিদ্র করে ভেতরের অংশ খেয়ে নষ্ট করে। এ পোকা নিয়ন্ত্রণে কার্বারিল জাতীয় কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১০ গ্রাম হারে বপনের ৪০ দিন ও ৬০ দিন পর স্প্রে করা যেতে পারে। এ ছাড়া জ্যাসিড বা সবুজ পাতা ফড়িং গাছের কচি অংশ ও পাতার রস চুষে খায়, ফলে পাতা কুঁকড়িয়ে যায়। ৫০০ গ্রাম নিম বীজ ভাঙা ১০ লিটার পানিতে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে সেই পানি বা ৫ গ্রাম গুঁড়া সাবান ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে পাতার নিচের দিকে স্প্রে করে এ পোকা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

ফলন : আধুনিক চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করলে প্রায় ৯০-১০০ দিনে শতক প্রতি ৫৫-৬৫ কেজি ঢ্যাঁড়শ সংগ্রহ করা যায়। লেখক ঃ কৃষিবিদ খোন্দকার মো. মেসবাহুল ইসলাম, উদ্যান বিশেষজ্ঞ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রংপুর অঞ্চল, রংপুর।

ফার্মসএন্ডফার্মার/২২এপ্রিল২০