বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করে ঝিনাইদহে ২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি

84

বিজয় দিবসকে ঘিরে প্রতিবছরই ফুলের চাহিদা থাকে ব্যাপক। এই দিবসকে ঘিরে তাই বেচাকেনা হয় কয়েক কোটি টাকার ফুল। এবার ফুলের দাম কিছুটা বেশি থাকায় স্বস্তি ফিরেছে চাষিদের মুখে। যদিও দফায় দফায় বিএনপি-জামায়াতের হরতালের কারণে ফুল চাষিরা অনেকটা শঙ্কায় ছিলেন। টানা হরতাল-অবরোধে লোকসানও গুণতে হয় চাষিদের।

ঝিনাইদহের অন্যতম লাভজনক ফুল চাষ। জেলা থেকে বছরে প্রাই ২০০ কোটি টাকার বেশি ফুল বিক্রি হয়ে থাকে। জেলার সদর উপজেলার গান্না গ্রামের কৃষক নজরুল জোয়ারদার। তিনি এবার ৩০ শতক জমিতে ২০ হাজার টাকা খরচ করে গাঁদা ফুল লাগিয়েছিলেন। আশা ছিল লাভের মুখ দেখবেন। কিন্তু দফায় দফায় হরতাল-অবরোধের কারণে লোকসানে ছিলেন তিনি। ফুল পচনশীল হওয়ায়, পরবর্তী ফলন বাঁচাতে তিনি ফুল তুলে ফেলে দিতে বাধ্য হন। তবে হঠাৎ করেই ৬ দিনের ব্যবধানে ফুলের দাম বেড়ে যাওয়ায় কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে চাষি নজরুলের মুখে। ৬ দিন আগে এক ঝোপা ফুল বিক্রি করেছেন ৪০ থেকে ৫০ টাকায় সেই ফুল সপ্তাহ ঘুরতেই ২৫০ থেকে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছেন। এতে করে আগের লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারবেন বলে আশা করছেন তিনি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সকালে ভোরের সূর্য ওঠার আগেই কৃষকেরা গান্না ফুল বাজারে নিয়ে আসার এক ঘণ্টার ব্যবধানে সব ফুল বিক্রি শেষ। এরপর ব্যবসায়ীরা সেগুলোকে ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কৃষক ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের থেকে জানা যায়, এক সপ্তাহ আগে যে গাঁদা ফুল বিক্রি হয়েছিল ৪০-৫০ টাকা ঝোপা। সেই ফুলের দাম বৃদ্ধি পেয়ে বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৪০০ টাকা ঝোপা। এভাবে অন্যান্য ফুলের দামও বেড়েছে। এতে সাধারণ কৃষক ও ব্যবসায়ীরা কিছুটা হলেও লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারবে।

কৃষকেরা বলছেন, সনাতন ধর্মালম্বীদের দীর্ঘদিন পর লগ্নে বিবাহ বেড়েছে, এ ছাড়া বিজয় দিবস ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আমেজ শুরু হয়েছে। যার কারণে হঠাৎ করেই ফুলের দাম বেড়েছে। নভেম্বরের শেষ দিকে হঠাৎ বৃষ্টির কারণে ক্ষেতেই বেশির ভাগ ফুল নষ্ট হয়ে যায়। যার ফলে উৎপাদনও কমে যায়। একদিকে ফুলের উৎপাদন কম অন্যদিকে বিজয় দিবসকে ঘিরে ফুলের চাহিদা বাড়ায় দাম বেড়েছে ফুলের।

দেশের সবচেয়ে বড় গাঁদা ফুলের বাজার গান্না ফুল বাজার। গান্না ফুল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, আগে ঢাকায় এক গাড়ি ফুল পৌঁছাতে খরচ হতো ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতায় বর্তমানে ব্যবসায়ীদের গুনতে হচ্ছে ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা। তারপরও গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। অবরোধের কারণে গাঁদা ফুল প্রতি ঝোপা (১০ চোইন) বিক্রি হয়েছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা দরে। রীতিমতো ধস নেমেছিল ফুল ব্যবসায়। বিজয় দিবসকে ঘিরে ৬ দিনে পুরো ফুল বাজার সেটা পুশিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। ৬ দিনে এক বিঘা জমি থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার ফুল বিক্রি করেছি নিজেই। এখনো ক্ষেতে ফুল রয়েছে।

পাইকারি ফুল ব্যবসায়ী সোহাগ হোসেন জানান, শুধু কৃষকই না, অবরোধের কারণে লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে ফুল ব্যবসায়ীরাও। ১৬ই ডিসেম্বর ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিয়ের উৎসব চলায় ব্যবসা বেড়েছে। এতে করে ঝিনাইদহের আশপাশের জেলাসহ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় ফুল যাচ্ছে। গান্না বাজার থেকে প্রতিদিন গড়ে দেড় থেকে দুই কোটি টাকার ফুল বেচাকেনা হচ্ছে। তবে চাহিদার বিপরীতে জোগান কিছুটা কম।

ঝিনাইদহ গান্না বাজার ফুল ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি ও ফুল চাষি মো. জামির হোসেন বলেন, এক সপ্তাহ আগেও দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দফায় দফায় হরতাল-অবরোধের কারণে ফুলের বাজার দর অনেক কম ছিল। আবার গাড়ি ভাড়াও বেশি ছিল। কৃষক ও ব্যবসায়ীরা হতাশাই ভুগছিলেন। বর্তমানে পাইকারি গাঁদা ফুল বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা ঝোপা, জারবেরা ২০ থেকে ২৫ টাকা, রজনীগন্ধা ৮ থেকে ১০ টাকা, চন্দ্রমল্লিকা ৩ থেকে ৪ টাকা, গোলাপ ১৫ থেকে ২০ টাকায়। যা গত সপ্তাহের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।

তিনি আরও বলেন, ঝিনাইদহের গান্না ফুল বাজার, বেলেডাঙ্গা ফুল বাজার, সামান্তা ফুল বাজারসহ জেলার ৬টি ফুল বিক্রি কেন্দ্র থেকে গত ৬ দিনে প্রায় ২০ কোটি টাকার বেশি বিভিন্ন ধরনের ফুল বিক্রি করেছে কৃষকেরা। এরমধ্যে বেশি বিক্রি হয়েছে গাঁদা ফুল। জেলা থেকে উন্নত মানের যে গাঁদা ফুল, যা সারাদেশের ফুলের চাহিদা মিটিয়ে থাকে। ফুলের গুণগত মান ভালো থাকাই এই জেলা থেকে বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়। ঝিনাইদহ জেলাতে তালিকাভুক্ত ফুল চাষি রয়েছে ৮ হাজারের বেশি। এর বাইরেও প্রাই দুই হাজার ফুলচাষি রয়েছেন। বর্তমানে হরতাল অবরোধের কারণে ট্রাক ভাড়া পাওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। গাড়ির মালিকেরা গাড়ি ভাঙচুর ও পোড়ানোর ভয়ে কেউ রাস্তায় বের হতে চাইছে না। সরকারের কাছে দাবি, ফুলের গাড়িগুলো পুলিশের নজরদারিতে জেলা থেকে পাঠাতে পারলে কোনো আতঙ্ক ছাড়াই নিরাপদে ফুলগুলো পৌঁছানো যেত।

ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আজগর আলী জানান, জেলায় ২৫৪ হেক্টর জমিতে ফুলের আবাদ হয়েছে। ঝিনাইদহ সদর উপজেলা, কালীগঞ্চ, কোটচাঁদপুর, মহেশপুর ও হরিণাকুন্ডু উপজেলাতে বেশি ফুল চাষ হয়। বর্তমানে গাঁদা ফুলের চাষ সব থেকে বেশি। এর পাশাপাশি জারবেরা, চন্দ্রমল্লিকা, রজনীগন্ধা ও গোলাপের চাষও ব্যাপক হারে বেড়েছে। এবছর ফুলের চাষও অনেক ভালো হয়েছে। হরতাল ও বৃষ্টির কারণে ফুল চাষিরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বিজয় দিবসকে ঘিরে এক সপ্তাহে যে বাজার পেয়েছে, তা আগের লোকসান কমিয়ে আনবে। এই জেলা থেকে আরও উন্নত ও মান-সম্মত ফুল চাষে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের নানা পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।