দেশে যে কয়েকটি শিল্পের নীরব বিপ্লব ঘটেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পোল্ট্রি শিল্প। গার্মেন্টসের পর এটিই দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাত। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় এক শতাংশ আসে পোল্ট্রি শিল্প থেকে। এ খাতে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ জড়িত। আশির দশকে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মাত্র ১ হাজার ৫শ কোটি টাকা। আর বর্তমানে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমান ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। পোল্ট্রি উদ্যোক্তা ও খামারিদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও ত্যাগ এবং সরকারের আন্তরিক সহযোগিতার কারণেই এ অসাধ্য অর্জন সম্ভব হয়েছে।
মাত্র তিন যুগের ব্যবধানে সম্পূর্ণ আমদানি-নির্ভর খাতটি এখন অনেকটাই আত্ম-নির্ভরশীল। বর্তমানে পোল্ট্রি মাংস, ডিম, একদিন বয়সী বাচ্চা এবং ফিডের শতভাগ চাহিদা মেটাচ্ছে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প।
বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প দেশীয় শিল্প হলেও অধিক জনসংখ্যা কারণে বাংলাদেশে পোল্ট্রি ও পোল্ট্রিজাত পণ্যের চাহিদা বেশি থাকায় বিদেশি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশকে তাদের বিনিয়োগের স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে। কিন্তু বিদেশি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে কি পরিমাণ বিনিয়োগ করতে পারবে, স্থানীয় উদ্যোক্তা সঙ্গে নেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা আছে কি না, কিংবা বিনিয়োগের কতো শতাংশ লভ্যাংশ নিয়ে যেতে পারবে তার সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। কাজেই সবার জন্য লেবেল প্লেইং ফিল্ড নেই। বিদেশি কোম্পানিগুলোর সাথে দেশীয় খামারিরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না।
বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পে তাই বিদেশি কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য দেখা যায়। বর্তমানে ৭টি বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশে পোল্ট্রি শিল্পের ব্যবসা করছে যেমন- ভিএইচ গ্রুপ, গোদরেজ, সুগুনা, টাটা, অমৃত গ্রুপ, সিপি এবং নিউ হোপ। এসব কোম্পানি এরই মধ্যে পোল্ট্রি শিল্পের ৪০
শতাংশের বেশি বাজার দখল করে নিয়েছে। ফলে বিপাকে পড়েছে দেশীয় উদ্যোক্তারা। কিছুদিন আগেও যেখানে দেশীয় ১ লাখ খামারী ছিল বর্তমানে তা ৭০ হাজারে নেমে এসেছে।
যদিও ২০০৭ সালে খামারীর সংখ্যা ছিল দেড় লাখের বেশি। এদিকে বিদেশি কোম্পানীগুলো ৩শতাংশ সুদে ব্যাংক ঋণে ব্যবসার সুযোগ পেলেও দেশীয় ব্যবসায়ীরা ১২ থেকে ১৩ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করছে। তবে ব্যাংক ঋণের সুবিধাও পাচ্ছে কেবল বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। আর ঋণ সুবিধা না পেয়ে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামার এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। আরো অনেকগুলো বন্ধ হওয়ার পথে। আর তাই বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো।
বাংলাদেশে অন্যান্য শিল্প যেমন টেক্সটাইল, গার্মেন্টস, লেদার ইত্যাদি শিল্পে বিদেশি কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করছে। সাভারসহ অন্যান্য রপ্তানি শিল্পাঞ্চলে শতাধিক বিদেশি বিনিয়োগকারী কোম্পানিগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। কিন্তু পোল্ট্রি শিল্পে বিদেশি কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। বিদেশি কোম্পানিগুলো সরকারকে ভোক্তা পর্যায়ে পোল্ট্রি ও পোল্ট্রি সামগ্রী মূল্য স্থিতিশীল করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এদেশে বিনিয়োগ শুরু করে। অন্যদিকে বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় বিদেশি কোম্পানিগুলো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রান্তিক খামারি পর্যায়ে কৃত্রিম লোকসান সৃষ্টি করছে। ফলে প্রান্তিক পর্যায়ের খামারগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে বড় ও মাঝারি খামারগুলোও ক্রমশ তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন।
পোল্ট্রি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত পুঁজির স্বল্পতা, অভিজ্ঞ জনবল, প্রযুক্তির ব্যবহার ও কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষে যে কোনো দেশ বিদেশিদের বিনিয়োগের সুযোগ দিয়ে থাকে। তবে এ ক্ষেত্রে পোল্ট্রি শিল্পে কোনো কিছুরই ঘাটতি নেই। এরপরও সরকার বিদেশি কোম্পানিগুলোকে ব্যবসা করার সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু তাদের তদারকির অভাবে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্প বর্তমানে বাজার হারাচ্ছে।
তাই অন্যান্য শিল্পের মতোই এই শিল্পেও বিনিয়োগকারী বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রয়োজন বলে মনে করেন বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
লেখক: ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, প্রধান বৈজ্ঞানিক কমকতা, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল
ফামগেট, ঢাকা।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন