বিপিআইসিসি’র ফেলো সাংবাদিকদের বিদায়ী অনুষ্ঠান

370

Untitled

বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পের উদ্যোক্তারা গণমাধ্যমের সামনে কথা বলার সময় প্রায়ই বলে থাকেন-এটি একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর শিল্প। আবার এও বলেন-খাদ্য ও পুষ্টির যোগান, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্রতা বিমোচনে এক নিরব বিপ্লব ঘটিয়েছে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প।

তারা দাবি করেন- বর্তমানে এ শিল্পে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে, প্রয়োগ হচ্ছে বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ জ্ঞান। উৎপাদিত হচ্ছে স্বাস্থ্য-সম্মত ও নিরাপদ মুরগির মাংস, ডিম, ফিড এবং অপরাপর পোল্ট্রিজাত পণ্য।

নিজের ঢোল সকলেই পেটান। কাজেই যতক্ষণ নিজের চোখে না দেখছেন ততোক্ষণ কি শতভাগ বিশ্বাস করার কোন কারণ আছে? উত্তরটা সহজ- ‘না নেই’। যদি আপনার-আমার মত মানুষের এ অবস্থা হয় তবে যারা অনুসন্ধানী চোখ নিয়ে সমাজটাকে প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করছেন সেই সব পেশাজীবী সাংবাদিকদের জন্য পোল্ট্রি উদ্যোক্তাদের দাবিগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করাতে হলে সরেজমিন পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা ছাড়া তো আর কোন বিকল্প থাকে না।

মূলত: এ মূল্যায়ন থেকেই বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি), সাংবাদিকদের জন্য চলতি বছর প্রথমবারের মতো একটি কার্যক্রম হাতে নেয়। জাতীয় দৈনিক ও টেলিভিশন চ্যানেলে কর্মরত সংবাদ প্রতিবেদকদের জন্য ফেলোশিপের ঘোষণা দেয়। আগ্রহীদের মধ্য থেকে জাতীয় দৈনিকে কর্মরত ৪ জন এবং টেলিভিশন চ্যানেলে কর্মরত ৪ জন অর্থাৎ মোট ৮ জন সংবাদকর্মীকে ফেলোশিপের জন্য নির্বাচন করা হয়। গত কয়েক মাস থেকে তারা পোল্ট্রি শিল্প সম্পর্কে গভীরভাবে জেনেছেন, সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলেছেন। শুধু তাই নয়, তারা বাণিজ্যিক লেয়ার খামার, ফিড মিল এবং ফারদার প্রসেসিং প্লান্ট ভিজিট করেছেন।

গত ৫ নভেম্বর ঢাকার একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত হলো বিদায়ী অনুষ্ঠান। এতে সভাপতিত্ব করেন- বিপিআইসিসি’র সভাপতি মসিউর রহমান। উপস্থিত ছিলেন ওয়ার্ল্ড’স পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখার (ওয়াপসা-বিবি) সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ অঞ্জন, এনিমেল হেলথ কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আহকাব) সভাপতি একেএম আলমগীর, বিপিআইসিসি’র সচিব দেবাশিস নাগ, উপদেষ্টা শ্যামল কান্তি ঘোষ, মিডিয়া উপদেষ্টা মো. সাজ্জাদ হোসেন, কর্মকর্তা আবু বকর, ৭ জন সাংবাদিক ফেলো এবং ফেলো-টিমের মেন্টর দি ইনডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক শামীম এ জাহেদী।

উপস্থিত হতে পারেননি অপর দুই ফেলো চ্যানেল-২৪ এর স্টাফ রিপোর্টার মো. ফাইজুল আলম সিদ্দিক এবং একাত্তর টিভির স্টাফ রিপোর্টার মো. মেহেদি হাসান ডলার।

পোল্ট্রি শিল্পের সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে গিয়ে দৈনিক যুগান্তরের সিনিয়র রিপোর্টার মিজান চৌধুরী এক কথায় বললেন, “আগে এক চোখে দেখতাম, এখন দু’চোখেই দেখতে পাই”। যার ব্যাখ্যাটি অনেকটা এমন-পোল্ট্রি শিল্প সম্পর্কে তার আগের ধারণা ছিল অসম্পূর্ণ, অস্পষ্ট। কিছু ভুল ধারণাও হয়তো ছিল। কিন্তু এখন তার কাছে সবকিছু খুবই স্পষ্ট কারণ তিনি নিজের চোখে দেখেছেন-কতটা স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে মুরগি পালন করা হয়; কতটা বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মুরগির জন্য খাবার তৈরি করা হয়। আধুনিক খামার ব্যবস্থাপনা, বায়োসিকিউরিটি, প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহারে কতটা এগিয়েছে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প।

দি ইনডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক শামীম এ জাহেদী বলেন, এটি সত্যিই ছিল এক ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশের বড় শিল্প বলতে আমরা একবাক্যে গার্মেন্টস শিল্পের কথাই সাধারণত বলি কিন্তু মানুষের মৌলিক যে প্রয়োজন-সেই খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং স্বাস্থ্যবান ও মেধাবী জাতি গঠনে পোল্ট্রি শিল্পের অবদানের কথাটি যেন ছাইয়ের নিচে চাপা পড়েই রয়ে গেছে।

যমুনা টেলিভিশনের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট সুশান্ত সিনহা বলেন, না জানলে সমস্যা নেই কিন্তু ভুল জানলেই সমস্যা। পোল্ট্রি শিল্প সম্পর্কে আমার অনেক সহকর্মীও ভুল জানেন। শুধু তারাই নন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অনেক কর্মকর্তারাও পোল্ট্রি শিল্প সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে জানেন না। লেয়ার খামারে ঢুকতে গিয়ে আমাদের প্রত্যেককে তিনবার করে গোসল করতে হয়েছে। ফেসবুকে যখন খামারের ছবি পোস্ট করলাম, তখন এক বন্ধু প্রশ্ন করল, এটা কী বাংলাদেশে? আমার তো মনে হয় এনবিআর এর কর্মকর্তাদেরও খামার পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া উচিত।

দৈনিক সমকাল পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার মিরাজ শামস বলেন, কেউ কেউ মনে করেন অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ভাল না। ২৮-৩০ দিনে ব্রয়লার মুরগি খাওয়ার উপযোগী হয়ে যাচ্ছে। তাই অনেকে বলেন, ব্রয়লার খেয়ো না।
বিপিআইসিসি’র সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, হাজার কিংবা লাখের মধ্যে সেরা মোরগ এবং মুরগি বাছাই করার মধ্য দিয়ে আসে বেস্ট ব্রিড। আমরা সেই ব্রিডই ব্যবহার করি। মুরগিকে যে ধরনের উন্নতমানের খাবার দেয়া হয় বাড়িতে আমরা সে ধরনের বিজ্ঞানভিত্তিক চুলচেরা বিশ্লেষণ করে খাবার তৈরি করি না কিংবা খাই না। তাছাড়া বাণিজ্যিক খামারগুলোতে যে পরিবেশে মুরগি পালন করা হয় সেটিও খুবই আধুনিক, জীবানুমুক্ত এবং উন্নতমানের।

যমুনা টিভির সুশান্ত সিনহা একটা গল্প বললেন। তিনি বলেন, বাইরের একটি দেশে তার এক বন্ধু লিফটে চড়ে ১৩০ তলা ভবন মাত্র কয়েক সেকেন্ডে উঠে রীতিমত ভিমড়ি খেয়েছিলেন। আমাদের দেশে মাত্র ৩০ তলা উঠতেই এর চেয়ে বেশি সময় লাগে। সুশান্ত বলছিলেন, সময় দ্রুত গতিতে ছুটছে। বিজ্ঞানের এ অগ্রগতি সম্পর্কে যিনি জ্ঞাত নন, তার কাছে ব্রয়লার মুরগির বৃদ্ধিকে অস্বাভাবিক বলেই মনে হবে কিন্তু এটাই আজকের বাস্তবতা।

দি ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস এর স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট হুমায়ন কবির নয়ন বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে-২০১৬ দেখলাম। প্রোটিন ইনটেকের পরিসংখ্যানটি বেশ লক্ষ্যণীয়। ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে গরু মাংসের ইনটেক সামান্য বেড়েছে, কমেছে খাসির মাংসের ইনটেক। আর সেখানে মুরগির ডিম ও মাংসের ইনটেক বেড়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। এটা নিঃসন্দেহে একটি অনেক বড় অর্জন।

দৈনিক কালের কণ্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার আবুল কাশেম বিপিআইসিসি’কে আরও ভিজিবল করার পরামর্শ দিলেন। সংবাদকর্মীরা যাতে আরও সহজে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত পেতে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিপিআইসিসি সভাপতিকে অনুরোধ জানালেন।

দি ইনডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট আব্দুল্লাহ আল মামুন জানতে চাইলেন আগামী দিনের কথা।

ওয়ার্ল্ড’স পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখার সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, ফিড মিলগুলো প্রতিদিন উন্নত হচ্ছে। আপনারা যেসব ফিড মিল, খামার বা প্লান্ট ভিজিট করে এসেছেন, ক’মাস পরে ওইগুলোতে গেলেও দেখবেন অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। আগামী ২০ বছরে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে পোল্ট্রি শিল্প যতটুকু এগোবে, বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প তারচেয়েও বেশি উন্নতি লাভ করবে বলে আমার বিশ্বাস।

তিনি বলেন, তৃণমূল ও ক্ষুদ্র খামারিদের বাঁচিয়েই এ শিল্পকে বড় করতে হবে এবং সে লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করছি।

বিপিআইসিসি’র সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, সাশ্রয়ী দামে পুষ্টিমান সমৃদ্ধ প্রাণিজ আমিষ সবার জন্য সহজলভ্য করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। রফতানির জন্যও প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে আরও কিছুটা সময় লাগবে। ছোট-বড় খামারি ও উদ্যোক্তা সকলকে সাথে নিয়েই আমরা এগিয়ে যেতে চাই। সরকার, গণমাধ্যমসহ স্টেকহোল্ডারদের সহযোগিতা পেলে নিশ্চয় আমরা সফল হবো।

পোল্ট্রি সেক্টরে আলোচনা তো অনেকই হয় কিন্তু এত সংক্ষিপ্ত পরিসরে এমন অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ মতবিনিময় হয়ত প্রতিদিন হয় না। ফেলোদের বিদায়ী অনুষ্ঠানের একজন অংশগ্রহণকারি হিসেবে সেদিনের আলোচনার সংক্ষিপ্ত সারটি অন্যদের জানানোর তাগিদ অনুভব করলাম। তাই দু’কলম না লিখে পারলাম না। ফেলোদের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ বিপিআইসিসি’কে ফেলোশিপের মতো এমন একটি কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য। গণমাধ্যম ও সংবাদকর্মীদের সাথে পোল্ট্রি শিল্পের জোটবন্ধন আরও ইতিবাচক আরও বন্ধুত্বপূর্ণ হবে এই প্রত্যাশা রইল।

লেখক: মো. সাজ্জাদ হোসেন, মিডিয়া উপদেষ্টা, বিপিআইসিসি।

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/এম