বেগুন আমাদের দেশে একটি অতি জনপ্রিয় সবজি। বেগুন চাষ করে আমাদের দেশের অনেক কৃষক বর্তমানে লাভবান হচ্ছেন। বর্তমানে বেগুন আমাদের দেশে একটি অর্থকারী ফসল। এই বেগুন চাষ করার ক্ষেত্রে আমাদেরকে অনেক সচেতন হতে হবে। কারণ বেগুন ক্ষেতে বেশ কিছু পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। এসকল পোকার আক্রমণের হাত থেকে বেগুন গাছকে রক্ষা করতে হবে। আসুন জেনে নেই বেগুন ক্ষেতের কিছু ক্ষতিকর পোকার লক্ষণ ও প্রতিকার।
রোগের প্রভাব ও লক্ষণ/ পোকামাকড়ের আক্রমণের লক্ষণ:
১। ফিউজারিয়াম উইল্ট (Fusarium wilt)- ফিউজারিয়াম উইল্ট (Fusarium wilt) নামক ছত্রাক দ্বারা বেগুনের ঢলে পড়া রোগ হয়। গাছের গোড়া ও শেকড় বিবর্ণ হয়ে যায়। এ রোগ হলে পাতা নেতিয়ে পড়ে ও গাছ ঢলে পড়ে। পরবর্তীতে গাছ মারা যায়।
২। ঢলে পড়া বা নেতিয়ে পড়া রোগ- আক্রান্ত গাছের কচি পাতা প্রথমে ঢলে পড়ে কিংবা নীচের বয়স্ক পাতা বিবর্ণ হয়ে যায়।শিকড়ের মাধ্যমে আক্রমন শুরু হলেও পরে তা কান্ডে ছড়িয়ে পড়ে। রোগের জীবানু মাটি থেকে পানি গ্রহন ও সঞ্চালনে বাধা দেয়, ফলে গাছ ঢলে পড়ে ও শেষে মারা যায়।
৩। চারা ধ্বসা রোগ- বীজতলায় চারা গজানোর পর থেকে মূল ক্ষেতে চারা রোপন পর্যন্ত এ রোগের আক্রমন হয়ে থাকে। অংকুরিত বীজের বীজপত্র, কান্ড এবং শিকড় নষ্ট করে দেয়। আক্রান্ত চারা প্রথমে হালকা সবুজ হয়ে ঢলে যায় এবং সম্পূর্ন চারাটিই মরে যায়। আক্রান্ত চারা ২-৪ দিনের মধ্যেই পচে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
৪। ডাউনি মিল্ডিউ- এর জন্য গাছের পাতা ধূসর হয়ে যায়। পাতায় সাদা পাউডার দেখা যায়।
৫। মোজাইক- কচি চারার বীজপত্র হলুদ হয় এবং চারা নেতিয়ে পড়ে। কচি ডগা জটলার মত দেখায়। আক্রান্ত পাতা ছোট, বিবর্ণ, বিকৃত ও নীচের দিকে কুঁকড়ানো হয় এবং শিরা-উপশিরাও হলুদ হয়ে যায়।
৬। বেগুনের ছোট পাতা (Little leaf of brinjal)- মাইকো প্লাজমার আক্রমণের ফলে বেগুনের পাতা ছোট হয়ে যায়। এক ধরণের পোকা এই মাইকো-প্লাজমা ছড়ায় বেগুনের ছোট পাতা রোগ হলে বেগুন ধরে না। ২-১ টি বেগুন ধরলেও গুনগত মানের হয় না।
৭। বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা- বেগুনের বোঁটার নীচে ছোট ছিদ্র দেখা যায়। কচি ডগা ঢলে পড়ে ও শুকিয়ে যায়। আক্রান্ত ফলের ভিতরটা ফাঁপা ও পোকার বিষ্ঠায় পরিপূর্ণ থাকে।
৮। মাছি পোকা- স্ত্রী মাছি কচি ফলে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে কীড়াগুলো বের হয়ে ফলের শাস খায় এবং ফল পচে যায় ও অকালে ঝরে পড়ে।
আরও পড়ুন অর্কিডের পাতার দাগ রোগ
৯। কাটুই পোকা- কীড়া অবস্থায় এই পোকা দিনের বেলা মাটির ফাটলে বা গর্তে লুকিয়ে থাকে। রাতের বেলা বের হয়ে চারা গাছের গোড়ার মাটি বরাবর কেটে দেয়।
১০। ছাতরা পোকা / মিলিবাগ- ছাতরা পোকা বেগুন গাছের পাতার বোঁটা এবং কচি ডগার রস চুষে খায়। এর দেহ থেকে মধু জাতীয় পদার্থ নিঃসৃত হয় এবং আক্রান্ত অংশে কালো ছাতা বা শুটি মোন্ড ছত্রাকের আক্রমন হয়। গাছের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্থ হয় এবং কোন ফুল/ফল ধরে না। অনেক সময় পাতা নষ্ট হয়ে ধীরে ধীরে গাছ মারা যায়।
১১। বেগুনের কাঠালে পোকা- বাচ্চা ও পূর্ণ বয়স্ক পোকা পাতার উপরের সবুজ অংশ খেয়ে জালের মত ঝাঁঝরা করে ফেলে।আক্রান্ত পাতা শুকিয়ে যায় এবং গাছের বৃদ্ধি কমে যায়। আক্রমন বেশি হলে গাছ মারা যায়।
১২। পাতা মোড়ানো পোকা- কীড়া পাতা মুড়িয়ে ফেলে এবং ভিতরে বসে পাতার সবুজ অংশ কুড়ে কুড়ে খায়। ফলে মোড়ানো পাতা জালের মত ঝাঝড়া হয়ে যায় ও পরে সাদা হয়ে শুকিয়ে যায়। সবুজ ডগা ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে এবং ডগার ভিতরের অংশ খায় ফলে ডগা সাদা হয়ে যায়।
১৩। জাব পোকা- পূণবয়স্ক ও নিম্ফ উভয়েই পাতা, কচি কান্ড, ফুল ও ফলের কুঁড়ি, বোঁটা এবং ফলের কচি অংশের রস চুষে খায়। ফলে গাছ প্রথমে দুর্বল ও পরে হলুদ হয়ে যায়। গাছে ফুল ও ফল অবস্থায় আক্রমণ হলে ফুলের কুঁড়ি ও কচি ফল ঝরে পড়ে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে কচি ডগা মরে যায়।
রোগের প্রতিকার:
১। ফিউজিয়াম রোগ- স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে পোকা দমন না হলে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণের অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে পরামর্শের জন্য যোগাযোগ করা যেতে পারে।
২। ঢলে পড়া বা নেতিয়ে পড়া রোগ- ঢলে পড়া চারা দেখা মাত্রই তুলে তা ধ্বংস করতে হবে। ২. জমি সব সময় আর্দ্র বা ভিজা না রাখা এবং পানি নিকাশের ব্যবস্থা রাখা।৩. রিডোমিল গোল্ড ৬৮ ডব্লিউজি – প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম হারে রিডোমিল গোল্ড মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে ভালভাবে স্প্রে করুন।
৩। চারা ধ্বসা রোগ- শোধনকৃত বীজ বপন করা এবং রিডোমিল গোল্ড ৬৮ ডব্লিউজি (প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম হারে ৫ শতাংশ জমির জন্য)। ব্যবহার করে বীজতলার মাটি শোধন করা যায়। ২. আক্রান্ত গাছ জমি থেকে তুলে ধ্বংস করতে হবে।
৪। ডাউনি মিল্ডিউ- থিয়োভিট ৮০ ডব্লিউজি- প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৫০ গ্রাম থিয়োভিট মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে ১৫ দিন পর পর সেপ্র করুন।
৫। মোজাইক- আক্রান্ত গাছ তুলে ধ্বংস করতে হবে।২. ক্ষেত আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।৩. বাহক পোকা সাদা মাছি দমন করতে হবে (একতরা ২৫ ডব্লিউজি- ২.৫ গ্রাম একতারা প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ভালভাবে গাছ ভিজিয়ে সেপ্র করতে হবে)।
৬। বেগুনের ছোট পাতা (Little leaf of brinjal)- এই রোগ হলে আক্রান্ত গাছ তুলে ধ্বংস করতে হবে। সুস্থ গাছে কোন পোকার আক্রমণ করলে তা দমনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৭। বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা- নিমবিসিডিন, ৮০ এম এল/একর জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
৮। মাছি পোকা- প্লেনাম ৫০ ডব্লিউজি- আক্রমণের তীব্রতা বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে প্লেনাম মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। ২. সবিক্রন ৪২৫ ইসি- প্রতি লিটার পানিতে ২ এমএল হারে মিশিয়ে ভালভাবে গাছ ভিজিয়ে স্প্রে করুন।
৯। কাটুই পোকা- ক্যারাটে ২.৫ ইসি-বেগুনের চারা রোপনের পর প্রতি শতাংশ জমিতে ৩ এমএল ক্যারাটে প্রয়োজনীয় পানির সাথে মিশিয়ে সারি ভিজিয়ে স্প্রে করুন।
১০। ছাতরা পোকা / মিলিবাগ- রাথমিক পর্যায়ে আক্রান্ত পাতা ও ডগা ছিঁড়ে ফেলা।২. সম্ভব হলে হাত দিয় ডিমের গাদা বা পোকা ধ্বংস করা।৩. নিমবিসিডিন, ৮০ এম এল/একর জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
১১। বেগুনের কাঠালে পোকা- আক্রমণের প্রথম অবস্থায় ডিমের গাদা এবং পাতাসহ কীড়া হাত দিয়ে সংগ্রহ করে ধ্বংস করা। গাছের গোড়সহ বেগুনের সম্পূর্ন মাঠ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা। আক্রমনের মাত্রা তীব্র হলে সবিক্রন ৪২৫ ইসি (প্রতি লিটার পানিতে ২ এমএল হারে) প্রয়োগ করুন।
১২। পাতা মোড়ানো পোকা- আক্রমণের প্রথম অবস্থায় ডিমের গাদা এবং পাতাসহ কীড়া হাত দিয়ে সংগ্রহ করে ধ্বংস করা।২. গাছের গোড়সহ বেগুনের সম্পূর্ন মাঠ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা।৩. আক্রমণের মাত্রা তীব্র হলে অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করা।
১৩। জাব পোকা- আক্রান্ত পাতা, ডগা, ফুল পোকাসহ সংগ্রহ করে ধ্বংস করা।২. একতারা ২৫ ডব্লিউজি- আক্রমণের তীব্রতা বেশি হলে ২.৫ গ্রাম একতারা প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ভালভাব গাছ ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।৩. প্লেনাম ৫০ ডব্লিউজি- আক্রমণের তীব্রতা বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে প্লেনাম মিশিয়ে ভালভাবে গাছ ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
দমন পদ্ধতি/ কীটনাশক:
বেগুন গাছে যদি পোকার আক্রমণ দেখা দেয় তবে উক্ত পোকা চিহ্নিত করতে হবে। এর পর উপরোক্ত বর্ণনা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২২মার্চ২০