ব্রাসেলস স্প্রাউট মূলত শীতকালীন সবজি। এর বৈজ্ঞানিক নাম – Brassica Oleracea. Brassicaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এ সবজি ৫ম শতাব্দীতে পূর্ব ইউরোপের দেশ ইতালি বা তার আশেপাশে প্রথম দেখা যায়। পরবর্তীতে ১৫৮৭ সালে এর বীজ বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে এনে রোপন করা হয়। সেই থেকে ব্রাসেলস স্পাউট নামে এই সবজি পরিচিতি পায়।
ব্রাসেলস স্প্রাউট দেখতে ছোট আকৃতির বাঁধাকপি মতো বলে অনেকে একে শিশু বাধাকপি বা বেবি ক্যাবেজ বলে ডাকে।
ব্রাসেলস স্প্রাউট এর পুষ্টিগুনঃ সাধারণ বাঁধাকপির চেয়ে এর খাদ্যগুণ অনেকটাই বেশি, প্রচুর মাত্রায় প্রোটিন ও ভিটামিন এ, বি কমপ্লেক্স (থায়ামিন, রিবোফ্লাভিন, নিয়াসিন), এবং অন্যান্য এন্টি অক্সিডেন্ট এর পরিমাণও অনেক বেশি মাত্রায় থাকে। ক্যান্সার প্রতিরোধী গ্লুকোসিনোলেটস নামক বায়োকেমিকাল এজেন্ট থাকে।
চাষাবাদ পদ্ধতিঃ ব্রাসেলস স্প্রাউটের চাষাবাদ পদ্ধতি অনেকটা বাঁধাকপির মতো। বীজও দেখতে বাঁধাকপির মতো। বীজ থেকে চারা হয়। এ চারা পরবর্তীতে মুল জমিতে লাগাতে হয়।
জলবায়ু ও আবহাওয়াঃ ব্রাসেলস স্প্রাউট শীতকালে সারাদেশে চাষ করা যাবে। এদেশের আবহাওয়া, জলবায়ু, মাটি ও পরিবেশ সম্পূর্ণ এই সবজি চাষের উপযোগী। শীতকালে ১৫-১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমত্রা থাকলে এটি সর্বোচ্চ ফলন দিবে। ০৭-২৪ ডিগ্রি তাপমাত্রায় এই সবজি আবাদ করা যায়।
এটি শীতকালীন ফসল। তাই শীতকাল যত দীর্ঘ হবে,এ ফসলের ফলন তত বেশি হয়। সে বিবেচনায় দেশের উত্তরাঞ্চল বেশ উপযোগী হতে পারে। তাই আগাম চাষে ফলন অনেক বেশি হবে। তাপমাত্রা যত বাড়বে ততই বাডের আকার ছোট হয় এবং বাডগুলো তুলনামূলক শক্ত হয়।
জাতঃ বাংলাদেশে এখনো কোনো জাত বের হয়নি। তবে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর আবুল হাসনাত এম সোলায়মান ব্রাসেলস স্প্রাউট নিয়ে কাজ করে পজিটিভ রেজাল্ট পেয়েছেন। হয়তো শীঘ্রই আমাদের কাছে নতুন জাত আসবে বলে আশা করা যায়।
তবে আমাদের পাশ্ববর্তী দেশের পশ্চিমবঙ্গ, চব্বিশ পরগণায় ব্রাসেলস স্প্রাউটের আবাদ বেশ চোখে পড়ে। সেখানে হিলস আইডল, অ্যামেজার, অলিভার, রিভাকো পার্ল ক্রিস্টাল, জেড ক্রস প্রভৃতি জাতের ব্রাসেলস স্প্রাউট আবাদ করা হচ্ছে।
ব্রাসেলস স্প্রাউটের বর্ণ (কালার)ঃ সবুজ, পিংক, রেড, হালকা হলুদ কালারের ব্রাসেলস স্প্রাউট বিভিন্ন দেশে পাওয়া যায়।
বীজের হারঃ বীজ বপনের জন্য বিঘা প্রতি ৫০-৬০ গ্রাম বীজ লাগে।
চারা রোপণের সময় ও পদ্ধতিঃ বাঁধাকপির বীজ বপন করার মূখ্য সময় হলো কার্তিক-অগ্রহায়ণ (সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাস)। আগাম চাষের জন্য ভাদ্র-আশ্বিন মাসে লাগানো যেতে পারে। ৩০-৩৫ দিন বয়সের চারা রোপণ করতে হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ৬০ সেমি বা ২ ফুট, চারা থেকে চারার দুরুত্ব হবে ৪৫ সেমি বা ১.৫ ফুট। বিকেলে চারা রোপণ করা উত্তম।
জমি তৈরিঃ অন্যান্য কপিজাতীয় ফসলের তুলনায় ব্রাসেলস স্প্রাউট এর জীবনকাল দীর্ঘ হওয়ায় সারের মাত্রা একটু বেশি লাগে। ইউরিয়া সার ৩-৪ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হয়। ৪-৫টি আড়াআড়িভাবে জমি চাষ দিয়ে আগাছা পরিস্কার করে, মাটি নরম করে জমি তৈরি করে নিতে হয়। মই দিয়ে জমি সমতল করতে হবে। মালচিং পেপার বিছিয়ে দিলে আরো ভালো ফল পাওয়া যাবে।
সার প্রয়োগঃ জমি তৈরির সময় প্রতি হেক্টরে গোবর ৬ টন, টিএসপি ৯০ কেজি ও এমপি ১২০ কেজি মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়। প্রতি হেক্টরে ইউরিয়া ১৫০ কেজি লাগে। ইউরিয়া তিনভাগ করে এক ভাগ চারা রোপণের ৭ দিন পর ছিটিয়ে, ২য় ভাগ ২৫ দিন পর ও ৩য় ভাগ ৪০ দিন পর বন্ধনী পদ্ধতিতে গাছের চারদিকে দিতে হবে।
পরিচর্যাঃ গাছ বড় হওয়ার সাথে সাথে দু’সারির মাঝখান থেকে মাটি তুলে সারি বরাবর আইলের মতো করে দিলে স্প্রাউট বড় হয়। পানি জমলে নিকাশ করতে হয়। দ্রুত ফলন পেতে চাইলে চারা লাগানোর দু মাস পর গাছে মাথা ভেঙে দিতে হবে। একে টপিং বলে। টপিং এর ফলে স্প্রাউট এর সংখ্যা কমে গেলেও স্প্রাউট এর আকার ও ওজন বাড়বে।
রোগ-বালাইঃ ব্রাসেলস স্প্রাউটে রোগ বালাই অনেকটা বাঁধাকপির মতো। তাপমাত্রা বাড়লে গাছের বয়স্ক পাতায় অল্টারনারিয়া ছত্রাকজনিত দাগ ও ব্লাইট রোগ দেখা দেয়। আবার এক ধরনের লেদাপোকা অনেক সময় স্প্রাউটগুলো বাহির থেকে খেয়ে ফেলে। যথাযথ ছত্রাকনাশক ও কীটনাশক স্প্রে করে এগুলো সফলভাবে দমন করা সম্ভব।
জীবনকালঃ ফসলের জীবনকাল জাতভেদে ৯০- ১৫০ দিন। সাধারনত দু মাস পর থেকে গাছে স্প্রাউট আসা শুরু হয়।
ফসল সংগ্রহের সময়ঃ স্প্রাউট আসার ১৫-২০ দিন পর সংগ্রহ করা যায়। সপ্তাহে ১-২ বার গাছ থেকে স্প্রাউট তোলা যায়।
ফলনঃ একটি গাছে ৪০-৬০ টি স্প্রাউট হয়। গাছে যতগুলো পাতা থাকবে ততগুলো স্প্রাউট হবে। স্প্রাউটগুলো ৭-১০ সেমি আকারের এবং ওজন ৫০-৭০ গ্রাম হতে পারে।
ব্রাসেলস স্প্রাউট ছাদে লাগানোর উপযোগিতাঃ ব্রাসেলস স্প্রাউট ছাদ বাগানের জন্য উপযোগী একটি শীতকালীন সবজি। এ গাছের উচ্চতা সর্বোচ্চ ৪.৫ ফিট পর্যন্ত হয়, এবং গাছ লাগানোর ১ -২ মাসের মধ্যে গাছের সর্বাঙ্গ জুড়ে স্প্রাউট( বাড) দেখা দেয়। বাড বের হওয়ার ২৮ দিনের মধ্যে স্প্রাউট হার্ভেস্ট করার উপযোগী হয় এবং প্রায় প্রতিদিন উৎপাদন করা যায়।
সম্ভাবনাঃ দেশব্যাপী সম্ভাবনাময় এই নতুন সবজি চাষাবাদের সম্প্রসারণ ঘটলে দেশের পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা অনেকাংশে পূরণ হওয়া ছাড়াও লাভজনকভাবে সবজি চাষ সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২৬ডিসেম্বর২০২০