ব্রয়লার মুরগীতে তাপমাত্রার প্রভাব

1100

গ্রীষ্মকাল এলেই বানিজ্যিক ব্রয়লার মুরগী নিয়ে খামারীরা নতুন সমস্যায় পরে। সমস্যাটা হলো হিটস্ট্রেস ও হিটস্ট্রেসে মর্টালিটি (কনজেসটিভ হার্ট ফেইলর)। অাপনার খামারে মুরগী যদি হিটস্ট্রেসের শিকার হয় তবে মর্টালিটি না থাকলেও আপনি আশানুরূপ ওজন পাবেন না। আর মর্টালিটি হলে তো কথাই নাই!

অনেকেই, গরমে মুরগী মারা গেলে তবেই মুরগীতে হিটস্ট্রেস পড়েছে বলে মনে করে। তাদের ধারনা গরমে মুরগী না মারা যাওয়া পর্যন্ত হিটস্ট্রেস পড়ে না। অর্থাৎ মুরগী মারা যাওয়াটাকেই অনেকে হিটস্ট্রেস মনে করে। আসলে হিটস্ট্রেস হলেই যে মুরগী মারা যাবে বিষয়টা এমন না। হিটস্ট্রেস খুবই প্রকট আকার ধারন করলে তবেই মুরগী মারা যায়। এবং সেটা মোটামুটি ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা ৪০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের উপরের তাপমাত্রায় ঘটে।

যদিও ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা ৪০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের উপরের তাপমাত্রায় হিটস্ট্রেসে মুরগী মারা যেতে থাকে তথাপি হিটস্ট্রেস ২৬ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা থেকেই শুরু হয়ে যায়। এরপর তাপমাত্রায় বৃদ্ধির সাথে সাথে হিটস্ট্রেসের মাত্রাও বৃদ্ধি পেতে থাকে যা ৪০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের উপরে এসে মর্টালিটিতে রূপ নেয়।

হিটস্ট্রেসে মুরগী মারা না গেলে খুশি হবার খুব বেশি কারন নেই। কারন আপনার মুরগী যদি হিটস্ট্রেসের শিকার হয় তবে মারা না গেলেও অনেক ক্ষতি হতে পারে। হিটস্ট্রেসে আপনার মুরগীর অদৃশ্য ক্ষতি নিম্নরূপঃ
১. খাদ্যগ্রহনের পরিমান হ্রাস পায়। ফলে টার্গেট ওজন আসতে বাড়তি সময় লাগে।
২. মুরগী ক্রমাগত হিটস্ট্রেসে পড়লে আশানুরূপ ওজন পাওয়া যায় না।
৩. এফসিআর বৃদ্ধি পায়।

৪. ড্রপিংস এ প্রচুর পানি আসে। ফলে পানিশূন্যতায় মুরগী দুর্বল হয়ে যায়।
৫. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়।
৬. ক্যালসিয়াম শোষন ক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে প্যারালাইসিস/ল্যামনেস দেখা দেয়।
৭. পেন্টিং করার ফলে মুরগীর রক্তে প্রাথমিক ভাবে এলকালোসিস ও পরে এসিডোসিস হতে দেখা দেয়। যার ফলে অম্ল-ক্ষারকের ভারসাম্য নষ্ট হয়। যা বিভিন্ন মাইক্রো ও ম্যাক্রো মিনারেলের শোষন হার কমিয়ে দেয়।
৮. ক্রমাগত হিটস্ট্রেস ব্রয়লার মুরগীর মাংসের গুনগত মান হ্রাস করে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধি সাথে সাথে ব্রয়লার শেডে হিটস্ট্রেসের যে লক্ষনগুলো দেখতে পারবেন তা নিম্নরূপঃ
১৮-২৫’C তাপমাত্রা= ব্রয়লার মুরগী স্বাভাবিকভাবে খাদ্যগ্রহন এ পানিগ্রহন করবে। এই তাপমাত্রায় দৈহিক ওজন বৃদ্ধি স্বাভাবিক থাকবে এবং এফসিআর আশানুরূপ হবে।

২৬-৩০’C তাপমাত্রা= হিটস্ট্রেসের শুরু। এই সময় মুরগী খাদ্যগ্রহনের পরিমান কমিয়ে দিবে। ২৬ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের পর প্রতি ১ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে খাদ্য গ্রহনের হার ১.৫% কমে যায়। এভাবে ৩০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত চলতে থাকে। এবং ৩০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার মুরগীর খাদ্য গ্রহনের পরিমান প্রায় ৫-৬% হ্রাস পায়। এই সময় মুরগী চলাফেরা কম করে।
৩১-৪০’C তাপমাত্রা= হিটস্ট্রেসের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। মুরগীর খাদ্য গ্রহনের পরিমান ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। ৩০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের পর প্রতি ১ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে খাদ্য গ্রহনের পরিমান ৪-৫% হারে হ্রাস পেতে থাকে। এই সময় মুরগী প্রচুর পানি পান করে (স্বাভাবিক মাত্রার ২-৩ গুন বেশী) এবং ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্সের কারনে ড্রপিং এর সাথে প্রচুর পানি বের হয়ে যায়। মুরগী পানিশূন্যতায় দুর্বল হয়ে পরে। এবং ফ্লোরের সাথে পুরো শরীর ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পরে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে মুরগীতে ব্যাপক আকারে পেন্টিং করতে দেখা যায়। ক্যালসিয়াম শোষন হার হ্রাস পায় ফলে অস্থায়ী প্যারালাইসিস দেখা দিতে পারে।
৪১’C এর উপরের তাপমাত্রা= শরীরের তাপমাত্রা হ্রাস করতে মুরগী প্রচুর পরিমানে পেন্টিং করে। যার ফলে হূদস্পন্দন ও রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। ফলাফল হিসেবে করেনারী আর্টারী ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে কনজেসটিভ হার্ট ফেইলরে মুরগী মারা যেতে পারে।

প্রতিকার
১. সাধারনত অত্যাধিক গরমে মুরগীকে খাদ্য দিলে খাদ্যস্থিত এনার্জি মেটাবলিজমের কারনে মুরগীর শরীরে অত্যাধিক তাপ উৎপন্ন হয়। খাদ্য গ্রহনের ৪-৫ ঘন্টার মাঝে এনার্জি মেটাবলিজমের কারনে মুরগীর শরীরে প্রায় বাড়তি ৭% তাপ উৎপন্ন হয়। যা মুরগীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। এই কারনেই গরমের সময় বেশীর ভাগ মর্টালিটি বিকেলে বা সন্ধ্যার সময় ঘটে। এসব ক্ষেত্রে দুপুর ১-৩ টা পর্যন্ত খাদ্য খায় এবং ৪-৫ ঘন্টা পর বিকেলের দিকে মুরগী মারা যায়। তাই গরম অাবহাওয়ার সময় মুরগীকে ০৯.০০-৫.০০ টা খাদ্য দেয়া বন্ধ রাখতে হবে।
২. মুরগীর শেডে সিমেন্টের টিনের ছাদ বানিয়ে দিলে ঘরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকে।
৩. তাপ কুপরিবাহী বস্তু দিয়ে শেডের সিলিং দিতে হবে।
৪. ঘরে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৫. লিটার ভিজে গেলে তা থেকে হিট উৎপন্ন হয় যা মুরগীকে বাড়তি হিটস্ট্রেস দেয়। সুতরাং লিটার ভিজে গেলে তা সরিয়ে ফেলতে হবে।
৬. গরমের সময় দুপুর বেলা মুরগীকে বার বার ঠান্ডা পানি খেতে দিতে হবে। খাদ্য পাত্র সরিয়ে দিয়ে পানির পাত্র বাড়িয়ে দিতে হবে।

হিটস্ট্রেসে তাৎক্ষনিক করনীয়

১. মুরগীতে হিটস্ট্রেসের লক্ষন দেখা দিলে তাৎক্ষনিক ভাবে পানিতে বরফ যুক্ত করে দিলে (পানির তাপমাত্রা 5-10’C) হিটস্ট্রেসের মাত্রা ব্যাপক ভাবে হ্রাস পায়।

২. পুরো শেডে বরফ যুক্ত পানি দিয়ে স্প্রে করে দিতে হবে।
৩. ফ্লোরের সাথে শুয়ে পরা নিস্তেজ মুরগীগুলোকে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিয়ে দ্রুত ঠান্ডা জায়গায় সরিয়ে ফেলতে হবে।

চিকিৎসা
রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারিয়ানের পরামর্শে

ফার্মসএন্ডফার্মার/১৪ফেব্রুয়ারি২০২১