নানামুখী সংকটে পড়ে ধুঁকছে দেশের পোলট্রি খাত। ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ায় একে একে বন্ধ হচ্ছে পোলট্রি খামার। দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে পোলট্রির চাহিদা এমনিতেই কমতে থাকে। তালা পড়ে অনেক খামারে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতির পর মুরগির চাহিদা বাড়লেও সে তুলনায় সরবরাহ বাড়েনি। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে পোলট্রি ফিড, সয়ামিলসহ এই খাতের কাঁচামালের দাম চড়ে আছে। জোগান কম ও উৎপাদন খরচ বেশি- এ দুইয়ে মিলে বাজারে এখন সব জাতের মুরগির দাম চড়া।
রাজধানীর বাজারে গতকাল বৃহস্পতিবারও সোনালি মুরগি ৩০০ টাকা ও ব্রয়লার মুরগি ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। দেশি মুরগির কেজি কেনা যাচ্ছে ৫০০ টাকায়। এ রকম প্রেক্ষাপটে আগামীকাল শনিবার পালিত হবে আন্তর্জাতিক পোলট্রি দিবস। বাংলাদেশে ২০২০ সাল থেকে দিবসটি পালন করছে ওয়ার্ল্ড’স পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের (বিপিকেআরজেপি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৯৮ হাজারের বেশি পোলট্রি খামারি ছিলেন। করোনার দুঃসময়ে ২৮ শতাংশ খামারি তল্পিতল্পা গুটিয়ে নেন। উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে সামনে এ সংখ্যা আগামীতে আরও বাড়তে পারে।
খামারিরা বলছেন, এক বছরের মধ্যেই ৫০ কেজির প্রতি বস্তা পোলট্রি খাদ্যের দাম এক হাজার ৭০০ থেকে বেড়ে দুই হাজার ৪০০ টাকায় ঠেকেছে। উৎপাদন খরচ বাড়লেও আনুপাতিক হারে বাড়েনি ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দাম।
পাবনা জেলা প্রান্তিক পোলট্রি শিল্প সংগঠনের আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম বলেন, খাবার, ওষুধসহ পরিচর্যা ব্যয় ধরে একটি লেয়ার মুরগি ডিম দেওয়ার উপযোগী করতে উৎপাদন খরচ কমপক্ষে ৭০০ টাকা; ডিম দেওয়া শুরু করলে মুরগিটি প্রতিদিন আট টাকার খাবার খায়। খামারের সব মুরগি খাবার খেলেও প্রতিদিন ডিম দেয় না। বর্তমান বাজারে প্রতিটি ডিমের পাইকারি দাম আট টাকা। এতে খামারিদের টানা লোকসান গুনতে হচ্ছে। পাশাপাশি কোনো কারণে মুরগি মারা গেলে সর্বস্বান্ত হতে হচ্ছে খামারিদের। সরকারি নজরদারি বাড়ানো না হলে প্রান্তিক পোলট্রি শিল্প ধ্বংস হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৪৫ শতাংশের জোগান দেয় পোলট্রি খাত। বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) গত বছরের তথ্য বলছে, করোনার আগে সারাদেশে প্রতি সপ্তাহে পোলট্রি মুরগির আড়াই কোটি বাচ্চা উৎপাদিত হতো। সেটি কমে এক কোটি ২৫ লাখে নেমেছে, অর্থাৎ উৎপাদন কমেছে ৫০ শতাংশ।
প্রতিবেশী দেশগুলোতে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সয়াবিন মিল রপ্তানির অনুমতি দিয়েছিল বাংলাদেশ। পোলট্রি ও গবাদি পশুর খাদ্য তৈরির গুরুত্বপূর্ণ এ কাঁচামাল রপ্তানি শুরুর পর তখনও দেশের বাজারে এ পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। ওই সময়ও পোলট্রি খামারিরা সয়ামিল বন্ধের দাবি জানিয়েছিলেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রপ্তানি বন্ধে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়। পরে ২০২১ সালের ১৪ অক্টোবর থেকে সয়াবিন মিল রপ্তানি বন্ধ করে সরকার। তবে এ বছর ৬ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত গণবিজ্ঞপ্তিতে সয়াবিন মিল রপ্তানি বন্ধে আগের আদেশ প্রত্যাহারের কথা বলা হয়। এর পর থেকে সংকটে পড়েন পোলট্রি খামারিরা।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, রপ্তানির কারণে গত তিন মাসে প্রাণিখাদ্যের দাম প্রায় ২০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। দেশে সয়াবিন মিলের মোট চাহিদা বছরে প্রায় ১৮ থেকে ২০ লাখ টন। এর মধ্যে ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ দেশীয় সয়াবিন তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে, বাকি ২০ থেকে ২৫ শতাংশ আমদানি করা হয়। যেখানে নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে ফিডমিলগুলো সয়াবিন মিল প্রতিনিয়ত আমদানি করছে, সেখানে সয়ামিল রপ্তানির সিদ্ধান্ত দেশের জন্য আত্মঘাতী।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (প্রাণিসম্পদ-২ অধিশাখা) ড. অমিতাভ চক্রবর্ত্তী বলেন, সয়ামিল রপ্তানি বন্ধ এবং প্রাণিখাদ্যের দাম কমানোর বিষয়ে আমরা দ্রুত উদ্যোগ নেব।
ফার্মসএন্ডফার্মার/০৫জুন ২০২২