কারো খালি পা, কারো পরনে নেই জামা৷ ছয় দিন ধরে লাগাতার মিছিল করে হাজার হাজার কৃষক পৌঁছেছেন মুম্বইয়ে৷ নিজেদের দাবি জানাতে৷ ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী ভারত৷
রোববার সকালে পশ্চিমবঙ্গের এক স্বনামধন্য সাংবাদিক ফেসবুকে স্টেটাস আপডেট দিয়েছিলেন ‘ইটস স্প্রিং টাইম’, অর্থাৎ বসন্ত এসে গেছে৷ সঙ্গের ছবিতে ছিল দিগন্ত বিস্তৃত লাল পতাকায় ঢাকা কৃষকদের মিছিল৷ মুহূর্তের মধ্যএ যে পোস্ট ভাইরাল হয়ে যায়৷
গত ৬ মার্চ ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের নাসিক থেকে হাজার হাজার কৃষক মিছিল শুরু করেন৷ তাঁদের লক্ষ্য ছিল, ছয় দিনে ১৮০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে তাঁরা মুম্বইয়ে রাজ্যের বিধানসভা ভবনে পৌঁছবেন এবং বিধানসভা ঘেরাও করে নিজেদের দাবি জানাবেন৷ সোমবার সকালে তাঁরা বিধানসভার সামনে এসে পৌঁছেছেন৷ মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফরণবীশ জানিয়েছেন, তিনি কৃষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলবেন৷ ঠিক কত সংখ্যক কৃষক মিছিলে এসেছেন তা নিয়ে ধোঁয়াশা আছে এখনো৷ পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী ১০ হাজার৷ সংগঠনের হিসেব ৫০ হাজার৷ আর সংবাদমাধ্যমের অনুমান ৩৫ হাজার৷ প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, সংখ্যাটি কোনো ভাবেই ৩৫ থেকে ৪০ হাজারের কম নয়৷
গত দু’বছর গোটা গরমকাল জুড়ে খড়া দেখেছে মহারাষ্ট্র৷ খেতের ফসল খেতেই নষ্ট হয়েছে৷ কিন্তু ফসল ফলানোর জন্য ব্যাংকের থেকে লোন নিয়েছিলেন কৃষকরা৷ ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অনেকেই ধার শোধ করতে পারেননি৷ ব্যাংকগুলিও তাদের ওপর চাপ দিতে থাকে৷ ফলে বেশ কিছু কৃষক গত দু’বছরে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন৷ মূলত এই বিষয়টিকে সামনে রেখে এ বছরের গোড়া থেকেই আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু করেন মহারাষ্ট্রের কৃষকেরা৷ তাঁরা বলেছিলেন, বিজয় মালিয়া, আমবানি, আদানিরা ঋণ শোধ না করলে সমস্যা হয় না৷ কিন্তু কৃষকেরা কয়েক লক্ষ টাকা শোধ করতে না পারলে তাঁদের জীবন দুর্বিসহ করে দেয় ব্যাংকগুলি৷ ফলে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, দাবি না মানলে এ বছর কেউ জমিতে নতুন বীজ ফেলবেন না৷ কৃষকদের পাশে দাঁড়ায় ভারতীয় মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিএমের কৃষক সংগঠন৷ মূলত সেই সংগঠনের নেতৃত্বে এবং আরো কিছু বাম সংগঠনের সহায়তায় ছয় দিনব্যাপী মিছিলের পরিকল্পনা হয়৷ কংগ্রেসও কৃষকদের মিছিলের প্রতি সহানুভূতি জানায়৷
এত বিপুল কৃষকের মিছিল এত দিন ধরে এর আগে দেখেনি ভারত৷ সাধারণত, এ ধরনের মিছিল বিরক্তই করে শহরের মানুষকে৷ কিন্তু এ বার সে দৃশ্যও বদলে গিয়েছে৷ গ্রাম থেকে শহরে প্রবেশ করার পর দেখা গিয়েছে, থানের মতো উচ্চবিত্তের এলাকাতেও স্থানীয় মানুষ প্রচুর পরিমাণ খাবার নিয়ে কৃষকদের কাছে যাচ্ছেন৷ খাওয়াচ্ছেন৷ তাঁদের সঙ্গে কথা বলছেন৷ এমনকি, সেল্ফি তোলারও ধুম পড়ে যায়৷ কৃষকেরা থানে থেকে বিধানসভার দিকে মিছিল শুরু করলে বাড়ির ছাদ থেকে তাঁদের উপর পুষ্পবৃষ্টি করা হয়৷ অন্যদিকে স্কুলের পরীক্ষার কথা মাথায় রেখে কৃষকেরাও সকালবেলা তাঁদের মিছিল বন্ধ রাখেন৷ ছাত্ররা স্কুলে পৌঁছে যাওয়ার পর তাঁরা মিছিল শুরু করেন৷
কৃষকদের দাবি, শোধ করতে না পারা ঋণ মকুব করতে হবে৷ জমির ওপর কৃষকের দাবি পূরণ করতে হবে৷ ফসলের ন্যূনতম দাম ধার্য করতে হবে৷ কৃষকদের জন্য পেনশনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং কৃষকের অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে৷ অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে কৃষকদের প্রতিটি দাবিই ন্যায় সংগত৷ এদিকে, কৃষকদের এই বিপুল জমায়েত দেখে রাজনৈতিক দলগুলিও সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে৷ কড়া দক্ষিণপন্থি শিবসেনা থেকে শুরু করে অতিবামপন্থি নকশাল সংগঠন, সকলেই কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে৷ চাপের মুখে বিজেপি-র মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফরণবীশও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলার এবং তাঁদের দাবি বিবেচনা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
বস্তুত, এত বড় কৃষক মিছিল দেখে বহু সমাজবিজ্ঞানীই তেভাগা আন্দোলনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন৷ বলছেন, এভাবেই স্বতঃস্ফূর্ত কৃষক মিছিল ভয়াবহ আন্দোলনের চেহারা নিয়েছিল৷ সরকার গোড়াতেই কৃষকদের মন জিততে না পারলে যে কোনো সময় ঝড় উঠতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা৷
সূত্র: এসজি/ডিজি (রয়টার্স, এএনআই, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, আনন্দবাজার পত্রিকা)
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন