ভালো বীজ চেনার উপায়

1647

বীজ কী ও ভালো বীজের গুরুত্ব : বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে কৃষি। আর যে কোনো ফসল উৎপাদনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হচ্ছে বীজ। কৃষি নির্ভর এ দেশের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ এবং দারিদ্র বিমোচনের জন্য প্রয়োজন উন্নতমানের প্রত্যায়িত বীজ ব্যবহার করে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। কৃষি বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে একই ব্যবস্থাপনায় শুধুমাত্র মানসম্পন্ন প্রত্যায়িত ভালো বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত বর্ধিত ফলন পাওয়া সম্ভব। অপরদিকে বীজের মান যদি ভালো না হয় তাহলে বীজ/ফসল উৎপাদনে অন্যান্য সব উপকরণের ব্যবহার ও অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে, যা প্রকারন্তে দেশ ও জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই বীজের গুরুত্ব অনুধাবন করে পৃথিবীর সব দেশে অধিক ফসল উৎপাদনে, মাঠমান ও বীজমান নিশ্চিতকরণে প্রত্যায়িত বীজের ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। এটা প্রমাণিত সত্য যে মৌল, ভিত্তি, প্রত্যায়িত শ্রেণীর বীজের ব্যবহার ছাড়া ভালো ফলন পাওয়া মোটেই সম্ভব নয়। আর তাই প্রত্যায়িত বীজ সম্পর্কে সবার ধারণা থাকা উচিত।

ভালো বীজের বৈশিষ্ট্য : ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণের প্রথমটিই হলো বীজ অর্থাৎ বীজ হচ্ছে ফসলের প্রাণ। তাই চিরন্তন সত্য হচ্ছে ‘ভালো বীজে ভালো ফসল’। এর কোনো বিকল্প নেই। আর তাই আমাদের বাঙালি সমাজে একটি জনপ্রিয় ও সর্বজনবিদিত প্রবাদ বা শ্লোক হচ্ছে-

‘ভালো বীজে ভালো ফসল সুধীজনে কয়-প্রত্যায়িত বীজই ভালো বীজ জানিবে নিশ্চয়’
আর এ সুবীজ তথা ভালো বীজই হচ্ছে মানসম্পন্ন প্রত্যায়িত বীজ। তাই প্রত্যেক বীজ ক্রেতা-বিক্রেতা, বীজ ব্যবসায়ী ও কৃষক ভাইদের জানতে হবে ভালো বীজ তথা মানসম্পন্ন প্রত্যায়িত বীজের গুণাবলি বা বৈশিষ্ট্য এবং চেনার উপায়। ভালো বীজের বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ-

১. কৌলিতাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা (Genetical Purity) : বীজ যে জাতের সে জাতের নির্দিষ্ট গুণাবলি অবশ্যই থাকতে হবে। জাতীয় বীজ র্বোডের অনুমোদিত বীজ মান অনুসারে একটি ভালো বীজের বিশুদ্ধতা হতে হবে ৯৬% হতে ৯৯% ভাগ।

২. মিশ্রণ মুক্ততা (Free from admixture) : ভালো বীজ অবশ্যই সব ধরনের মিশ্রণ মুক্ত হতে হবে অর্থাৎ একটি ভালো বীজে জড় পদার্থ, আগাছার বীজ বা অন্য ফসলের এমনকি অন্য জাতের মিশ্রণ থাকা চলবে না। জাতীয় বীজ মান অনুসারে একটি ভালো বীজে সর্বোচ্চ ০১ ৩% পর্যন্ত জড় পদার্থ, অন্য ফসলের বীজ বা আগাছার বীজ থাকতে পারে।

৩. রোগ ও কীটপতঙ্গ মুক্ততা (Free from Insect and Diseases) : বিশুদ্ধ ভালো বীজ অবশ্যই রোগ জীবাণুমুক্ত এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ মুক্ত হতে হবে।

৪. অংকুরোদগম ক্ষমতা (Germination Capacity) : ভালোবীজ মানেই উচ্চ অংকুরোদগম ক্ষমতা সম্পন্ন বীজ অর্থাৎ অংকুরোদগম ক্ষমতা হতে হবে ৮৫% বা তার ওপরে। জাতীয় বীজ মান অনুসারে ভালো বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা কোনো ক্রমেই ৮০% এর নিচে নয়।

৫. বীজের আর্দ্রতা (Moisture Content) : ভালো বীজের আর্দ্রতা ধান ও গমের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১২% এবং অন্যান্য ফসলের বেলায় সর্বোচ্চ ১০% হতে হবে।

৬. বীজের আকার-আকৃতি (Seed Size and Shape) : নির্দিষ্ট ফসলের নির্দিষ্ট জাতের সব বীজ প্রায় একই আকারের, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, পরিপক্ব ও পুষ্ট হতে হবে। এছাড়া বীজের জীবনীশক্তি (Viability) এবং বীজের স্বাভাবিক উজ্জ্বল রঙ থাকতে হবে।

বীজের শ্রেণী (Classes of Seeds) : ভালো বীজ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ করতে হলে আমাদের প্রথমে বীজের শ্রেণী বিন্যাস (Classes of Seeds) জানা একান্ত প্রয়োজন। বীজ বিধি ১৯৯৮ এর ৯নং ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে বীজের ৪ টি শ্রেণী বিদ্যমান আছে। বীজের শ্রেণীগুলো হচ্ছে নিম্নরূপ-

ক. প্রজনন বীজ বা মৌল বীজ (Breeder Seed)
খ. ভিত্তি বীজ (Foundation Seed)
গ. প্রত্যায়িত বীজ (Certified Seed)
ঘ. মান ঘোষিত বীজ (TLS : Truthfully Labeled Seed)
ক. প্রজনন বীজ বা মৌল বীজ (Breeder Seed) :

বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত জাতের যে বীজ গবেষণাগারে/গবেষণাগার মাঠে উৎপাদন করা হয় সেটাই হচ্ছে প্রজনন বীজ বা মৌল বীজ। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ব্রিডার বীজ (Breeder Seed)। কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অধীনে বিশিষ্ট প্রজননবিদের নিবিড় ও সরাসরি তত্ত্বাবধানে উৎপাদিত এবং বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি কর্তৃক প্রত্যয়নকৃত বীজই হচ্ছে ‘প্রজনন বীজ বা মৌল বীজ অর্থাৎ ব্রিডার বীজ’, যা থেকে পরবর্তীতে ভিত্তি শ্রেণীর বীজ উৎপাদন করা হয়ে থাকে।

এ বীজের কৌলিক বিশুদ্ধতা (Genetical Purity) থাকে সর্বাধিক অর্থাৎ ৯৯%-১০০% ভাগ। এ শ্রেণীর বীজ চেনার জন্য বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি কর্তৃক ‘সবুজ রঙের প্রত্যয়ন ট্যাগ’ সংযুক্ত করে দেয়া থাকে। জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক নিবন্ধিত বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বীজ উৎপাদনকারীরা এ বীজ গ্রহণ করে পরবর্তী শ্রেণীর ভিত্তি বীজ উৎপাদন করে থাকে।

খ. ভিত্তি বীজ (Foundation Seed) :
মৌল বা ব্রিডার বীজ হতে বর্ধন কর্মসূচির মাধ্যমে ‘ভিত্তি বীজ (Foundation Seed)’ তৈরি করা হয়ে থাকে। এছাড়া ভিত্তি বীজ হতেও ভিত্তি বীজ উৎপাদন করা হয়ে থাকে যা প্রজনন বীজের বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলি বহন করে থাকে। প্রত্যয়নের স্বপক্ষে ভিত্তি বীজের ব্যাগে অবশ্যই বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি কর্তৃক প্রদত্ত ‘সাদা রঙের প্রত্যয়ন ট্যাগ’ সংযুক্ত থাকতে হবে। নিবন্ধিত ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান এ বীজ হতে পরবর্তীতে ভিত্তি/প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করে থাকে।

গ. প্রত্যায়িত বীজ (Certified Seed) : প্রত্যায়িত বীজ হচ্ছে ওই শ্রেণীর বীজ যা সরকার অনুমোদিত সংস্থা যেমন বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি কর্তৃক বীজ অধ্যাদেশ, বীজ আইন ও বীজ বিধির সব ধারা পূরণপূর্বক প্রত্যয়ন করা হয়ে থাকে। এ শ্রেণীর বীজ হচ্ছে ভিত্তি বীজের বংশধর অর্থাৎ ভিত্তি বীজ হতে বীজ প্রত্যয়নের সব নিয়ম কানুন অনুসরণ করে উৎপাদিত ও বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি কর্তৃক প্রত্যয়নকৃত বীজই হচ্ছে প্রত্যায়িত বীজ (Certified Seed)। এ শ্রেণীর বীজ চিহ্নিত করার জন্য প্রদত্ত ‘প্রত্যয়ন ট্যাগের রঙ হচ্ছে নীল’। এ বীজের বিশুদ্ধতা ভিত্তি বীজের তুলনায় কিছুটা কম থাকে। কিন্তু জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত বীজমান অনুযায়ী গুণাগুণ বজায় রাখা হয়। এ শ্রেণীর বীজ উৎপাদন করতে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির প্রত্যয়ন আবশ্যক। সরকারি/বেসরকারি/ব্যক্তি উদ্যোগে বীজ উৎপাদনকারীরা এ বীজ কৃষকের জন্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে থাকে। মূলত বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ধান উৎপাদনকারী কৃষকই এ বীজ ব্যবহার করে থাকে।

ঘ. মান ঘোষিত বীজ (TLS: Truthfully Labeled Seed)

এ শ্রেণীর বীজ সাধারণত ভিত্তি ও প্রত্যায়িত শ্রেণীর বংশধর হয়ে থাকে যা উৎপাদনের পর বীজ ব্যাগে বা মোড়কে বীজের সমুদয় মান, উৎপাদনকারীর নাম, ঠিকানা লেবেল করে বা প্যাকেটের গায়ে সুস্পষ্টভাবে লিখে দিতে হয়। এ বীজের ক্ষেত্রে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির কোনো প্রত্যয়ন বা প্রত্যয়ন ট্যাগ সংযোজনের প্রয়োজন হয় না। তবে এ শ্রেণীর বীজের বীজমান অবশ্যই প্রত্যায়িত বীজের মানের সমতুল্য হতে হবে এবং এ মান বজায় রাখার সব দায়-দায়িত্ব বীজ উৎপাদনকারীর। এ শ্রেণীর বীজ চেনার জন্য বীজ ব্যাগে ‘হলুদ রঙের লেবেলিং কার্ড’ লাগানোর বিধান রয়েছে

প্রত্যয়ন ট্যাগ (Certification Tag) : প্রত্যয়ন ট্যাগ হচ্ছে অদৃশ্য গোপনচিহ্ন সংবলিত একটি সরকারি প্রত্যয়নপত্র যা বীজ বপন হতে শুরু করে মাঠ পরিদর্শনকালীন মাঠ মান ও বীজ পরীক্ষাগারে বীজ মানের সন্তোষজনক ফল প্রাপ্তি সাপেক্ষে সরকারিভাবে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি কর্তৃক ০২ কেজি ও ১০ কেজির বীজ ব্যাগে সংযোজনের জন্য প্রদান করা হয়ে থাকে। বীজের শ্রেণী অনুসারে প্রত্যয়ন ট্যাগের রঙ বিভিন্ন হয়ে থাকে। ব্রিডার, ভিত্তি ও প্রত্যায়িত শ্রেণীর বীজের জন্য প্রত্যয়ন ট্যাগের রঙ যথাক্রমে সবুজ, সাদা ও নীল রঙ হয়ে থাকে। প্রতিটি প্রত্যয়ন ট্যাগে লেখা থাকে ফসলের নাম, জাতের নাম, বীজের শ্রেণী, বীজ ডিলার/উৎপাদকের নাম ও ঠিকানা, লট নম্বর, বীজ পরীক্ষার তারিখ, ট্যাগ ইস্যুর তারিখ, বৈধতার মেয়াদ ও যে পরিমাণ বীজের জন্য প্রত্যয়ন ট্যাগ প্রদানকৃত তার পরিমাণ।

প্রত্যায়িত বীজের মাঝে যেহেতু একটি ভালো বীজের সব প্রকার ভালো গুনাগুণ ও বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান, তাই এ বীজ ব্যবহারে ফসলের ফলন অনেক বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। সুতরাং অধিক ফসল উৎপাদনে প্রত্যায়িত মানের বীজের গুরুত্ব অপরিসীম। সে কারণেই বলা যায়-

‘আজ তাই সব কৃষকের দৃঢ় সংকল্প, প্রত্যায়িত বীজ বিনা নাই যে বিকল্প’
বাংলাদেশ সরকারের বীজ আইন অনুসারে প্যাকেটকৃত বীজের মানের নিশ্চয়তা বীজ বপন হতে শুরু করে বীজ প্যাকেট করা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে জাতীয় বীজ র্বোডের অনুমোদিত বীজের মাঠ মান ও বীজ মান নিশ্চিত প্রাপ্তি সাপেক্ষেই যেহেতু প্রত্যয়ন পত্র দেয়া হয়ে থাকে তাই প্রত্যয়নকৃত বা প্রত্যায়িত বীজ মানেই ভালো বীজ, এ বিষয়ে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। তাই সব বীজ উৎপাদনকারী ও কৃষকের জন্য একটাই পরার্মশ,‘প্রত্যায়িত বীজ ব্যবহার করুন, অধিক ফসল ঘরে তুলুন’। সুতরাং বীজ বপন হতে শুরু করে মাঠ পরিদর্শনের মাধ্যমে নির্ধারিত মাঠমান যাচাইকরণ, বীজ সংরক্ষণাগার পরিদর্শন, প্রত্যয়নকৃত বীজ নমুনা সংগ্রহ, সন্তোষজনক বীজ পরীক্ষার ফল প্রাপ্তি সাপেক্ষে প্রতিটি বীজ ব্যাগে যথাযথভাবে প্রত্যয়ন ট্যাগ সংযোজন এবং মার্কেট মনিটরিং পদ্ধতি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বীজের মান নিয়ন্ত্রণ জরুরি। সেই মহান ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটিই পালন করছে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি।

শেখ মো. মুজাহিদ নোমানী
জেলা বীজ প্রত্যয়ন অফিসার, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, (কৃষি মন্ত্রণালয়) জামালপুর।

ফার্মসএন্ডফার্মার/২২এপ্রিল২০