ভেড়া ও ছাগল পালনের মধ্যে তেমন কোনো তফাৎ নেই। তবে ছাগল পালনের চেয়ে ভেড়া পালন ব্যবস্থাপনা সহজ। নিম্নে আমাদের দেশে ভেড়া পালনকারী মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার আলোকে ভেড়া পালনের সাধারন কিছু বিষয়ে আলোচনা করা হলো।
ভেড়ার বাসস্থান
প্রত্যেক জীবের প্রথম ও প্রধান মৌলিক চাহিদা হলো একটি আরামদায়ক বাসস্থান। আমাদের দেশে যেসব কারনে ভেড়ার মৃতু ঘটে। তার মধ্যে অন্যতম হলো বাসস্থান না থাকা বা অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান। ভেড়ার রাখার জন্য অধিকাংশই কৃষকেরই ভালো ঘর নেই। তাছাড়া ২০/৩০টির বেশি ভেড়া আছে এমন খামারীদের ভেড়ার জন্য স্বাস্থসম্মত বাসস্থান নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পারিবারিকভাবে পালিত ভেড়া রাখা হয় কৃষকের ঘরের মাচা বা চৌকির নীচে বা ঘরের পাশে ছোট্ট একটি চালা বেঁধে তার মধ্যে যেখানে আলো বাতাস প্রবেশের সুযোগ কম। কিন্তু সামান্য খরচ করেই ভেড়া রাখার জন্য একটি স্বাস্থসম্মত বাসস্থান তৈরি করা যায়। ছাগল বা ভেড়া বাসস্থান তৈরির সময় একটি বিষয় খেয়াল রাখা খুব জরুরি আর তাহলো মেঝে তা কাঁচা বা পাকা যেমনই হোক সেখানে ভেড়া না রেখে মাচা বা স্লাট এর উপর ভেড়া পালন করা।
ভেড়ার খাদ্য ব্যবস্থাপনা
ভেড়া সবকিছু খায়। ভেড়া একটি সর্বভূক প্রাণি। শুকনা খড় থেকে শুরু করে গরুর খাদ্যের উচ্ছৃষ্টাংশ পর্যন্ত খায়। তাই ভেড়া পালনে খাদ্য খরচ কম। ভেড়া একটি তৃণভোজী স্তন্যপায়ী প্রাণি। ভেড়া সাধারণত চরে খেতে পছন্দ করে এবং ছাগলের মতো কোন গাছের মাথা বা ঘাসের ডগা নয় ঘাসের নীচের অংশ থেকে খাওয়া শুরু করে। ভেড়ার অন্যান্য রোমন্থক প্রাণির ন্যয় চার প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট পরিপাকতন্ত্র এবং ভেড়া আঁশ জাতীয় খাদ্য, লতা-পাতা প্রভৃতিকে সহজেই সাধারণ শর্করা তে পরিনত করতে পারে।
এছাড়া ভেড়া স্বাভাবিক এবং প্রতিকুল উভয় অবস্থাতেই শুকনা খড় এবং খড় জাতীয় খাদ্য খেয়ে থাকে। আমাদের দেশে ভেড়ার চরে খাওয়ার মতো পর্যাপ্ত খাদ্য নেই। তাছাড়া বর্তমান সময়েও আবদ্ধ পদ্ধতিতে ভেড়া পালন একটি বিরল ঘটনা।
গরু, ছাগল এবং পোল্ট্রি আবদ্ধ পদ্ধতিতেও পালন করা হয় এবং এ জন্য তাদের দানাদার খাদ্য সরবরাহ করা হয়। যেহেতু চরে খেয়ে প্রয়োজনীয় পুষ্টি প্রাপ্তি ঘটে না তাই বয়স ভেদে নিম্নোক্ত মিশ্রনের দানাদার প্রতিদিন ২০০-৩০০ গ্রাম হারে খাওয়ানো যেতে পারে।
বাচ্চা, বাড়ন্ত এবং বয়স্ক ভেড়ার জন্য দানাদার খাদ্য মিশ্রনে নমুনা (%)
ক্রমিক নং খাদ্য উপাদান (কেজি) বাচ্চা ভেড়া (৩-৬ মাস) বাড়ন্ত ভেড়া (৭-১৫ মাস) বয়সক ভেড়া (১৫ মাস হতে)
১ চাল/গম/ভূট্টা ভাংগা ৩০ ১৫ ১০
২ বিভিন্ন ধরনের ডালের ক্ষুদ ৫ – –
৩ গমের ভুষি/চালের কুড়া ২৯ ৪৫ ৫০
৪ ডালের ভূষি/ খোসা ৫ ১৫ ১৫
৫ খৈল ২৫ ২০ ২০
৬ প্রোটিন কনসেন্ট্রট ২.৫ ১ ১
৭ ডিসিপি/ঝিনুক চূর্ণ/ডিমের খোসা ২ ২ ২
৮ লবণ ১ ১.৫ ১.৫
৯ ভিটামিন মিনারেল প্রিমিক্স ০.৫ ০.৫ ০.৫
মোট ১০০ ১০০ ১০০
রোগ বালাই
ভেড়ার রোগ বালাই তেমন হয় না। তবে এন্টরোটক্সিমিয়া, আমাশায়, ধনুষ্টংকার, ক্ষুরা, একথাইমা, পিপিআর, নিউমোনিয়া ইত্যাদি রোগ হতে পারে।ভেড়ার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অবশ্যকরণীয় বিষয় হলো নিয়মিত কৃমিনাশক ব্যবহার করা। গোলকৃমি, ফিতাকৃমি, কলিজাকৃমি ভেড়াকে আক্রান্ত করে। প্রতি ২/৩ মাস পরপর ভেড়াকে কৃমিনাশক প্রয়োগ করতে হবে। আমাদের দেশে ভেড়াকে নিয়মিত শেয়ারিং করা বা পশম কাটা হয় না। তাই শরীরে বড় পশমের কারনে বিভিন্ন ধরনের বহিঃ পরজীবী বাস করে এবং বড় পশমের কারনে বিভিন্ন ধরনের চর্ম রোগ হয়। এজন্য বছরে অন্ততঃ দু’বার ভেড়ার পশম কাটতে হবে এবং গোসল করাতে হবে তাহলে উকুন, আঠালি, টিক ইত্যাদির প্রকোপ কম হবে। নিয়মিত পিপিআর টিকা প্রদান করতে হবে। এছাড়া ভেড়ার বাচ্চাকে কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে।
ভেড়ার প্রজনন
অন্যান্য দলবদ্ধ প্রাণির মতোই ভেড়ার প্রজনন। ভেড়াকে বলা হয় seasonal breeder যদিও কিছু কিছু ভেড়া সারা বছর ধরে প্রজনন হয়। ভেড়ি সাধারণত: ৬-৮ মাসে প্রজনন উপযোগি হয় (reach at sexual maturity) এবং পুরুষ ভেড়া (ram) ৪-৬ সপ্তাহ বয়সে যৌন পরিপক্কতা লাভ করে। তবে জাত ভেদে এই বয়সের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। যেমন- ফিনশিপ জাতের ভেড়ি ৩-৪ মাস বয়সে এবং মেরিনো ভেড়ি কোন কোন সময় ১৮-২০ মাস বয়সে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়।
ভেড়ার ঋতুচক্র ১৭ দিন পর পর আর্বতিত হয়। গর্ভকাল ৫ মাস। ১০-১২টি ভেড়ির জন্য একটি প্রজননক্ষম পাঠাই যতেষ্ঠ। ভেড়ি উপযুক্ত দৈহিক ওজনপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত পাল দেয়া ঠিক নয়। কম ওজনের ভেড়ি থেকে প্রাপ্ত বাচ্চার মৃত্যুহার বেশি হয় এবং মা ভেড়ি হতে পরবর্তীতে ভালো সার্ভিস পাওয়া যায় না। একটি পাঠাকে ১০০-২০০ বারের বেশি প্রজনন করানো ঠিক নয়।
এছাড়া প্রজনন কাজে ব্যবহৃত পাঠার বাড়তি যত্নের প্রয়োজন। প্রজনন ক্ষমতা বাড়াতে প্রতিদিন ১০ গ্রাম করে অঙ্কুরিত ছোলা এবং দৈনিক ৩৫০- ৫০০ গ্রাম দানাদার খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। এছাড়া যে ভেড়ি উপযুক্ত সময়েও ডাকে আসে না সে ভেড়িকে এবং পাঠাকে এডি৩ই ইনজেকশন প্রদান করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এছাড়া অন্তঃপ্রজনন (inbreeding) এড়াতে সময়ে সময়ে নিজের পালের পাঠা বাদ দিয়ে অন্য পাল থেকে পাঠা আনতে হবে।
ভেড়ার বাচ্চার যত্ন ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা
আমাদের দেশে ভেড়ার পরিকল্পিত বাণিজ্যিক খামার নেই বললেই চলে। একেবারে পারিবারিক পর্যায়ে ভেড়া পালন করা হয়। মাঠ পর্যায়ে দেখা গেছে এভাবে ভেড়া পালনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ভেড়ার বাচ্চার অধিক মৃত্যুহার। মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে প্রসবকালীন অব্যবস্থাপনা ও পুষ্টিহীনতা প্রধান।
তাছাড়া বাচ্চা প্রসবের পর পর মা ভেড়ির সাথে বাচ্চাকেও মাঠে নিয়ে যাওয়া। সারাদিন মা ভেড়ির সাথে মাঠে মাঠে ঘুরার কারনে শারিরীকভাবে দুর্বল বাচ্চাতে প্রচন্ড ধকল পড়ে এবং মারা যায়। তাই বাচ্চা প্রসবের পর ধকল সহ্য করার সামর্থ্য তৈরি না হওয়া পর্যন্ত মা ভেড়ির থেকে কিছুদিন আলাদা করে রাখতে হবে। বাচ্চাকে শাল দুধ খাওয়াতে হবে এবং যেহেতু মা ভেড়ি থেকে প্রয়োজনীয় পরিমান দুধ পাওয়া যায় না সেজন্য দুধের বিকল্প খাওয়াতে হবে।
ভেড়া পালনের উপযোগিতা
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভেড়া পালন করা হয় প্রধানত মাংস এবং উলের জন্য। আমাদের দেশে কোন উপযোগিতা অনুসরণ করে ভেড়া পালন করা হয় না। সমাজের নিরুপায় কর্মহীন কিছু মানুষ জীবন জীবিকার জন্য ভেড়া পালন করে। তবে বিক্রয় করা হয় মাংশের জন্য। অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ডসহ পৃথিবীর কিছু উন্নত দেশে মাংশের চেয়ে উল উৎপাদন ভেড়া পালনের প্রধান উদ্দেশ্য।
ভেড়া পালনের সুবিধা
১) ভেড়া ছোট নিরীহ প্রাণি। এদের খাদ্য খরচ কম, রাখার জন্য অল্প জায়গা দরকার হয় এবং প্রাথমিক বিনিয়োগ কম বলে শুধুমাত্র বসতঃ বাড়ি আছে এমন কৃষক আনায়সে ৫-১০ ভেড়া পালন করতে পারেন। যে কোন প্রাণি প্রতিপালনের চেয়ে ভেড়া পালনে উৎপাদন খরচ কম।
২) ভেড়া সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে পছন্দ করে তাই কেউ যদি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ভেড়া পালন করতে চায় সেক্ষেত্রে একজন লোক সহজেই ১০০-১৫০ ভেড়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।
৩) ভেড়ার অভিযোজন ক্ষমতা ছাগলের চেয়ে বেশি তাই যেকোন প্রতিকূল পরিবেশে খাপ খাওয়ায়ে চলতে পারে। ভেড়া গরুর পালের সাথে একসাথে পালন করা যায়।
৪) ভেড়া অত্যন্ত নিম্নমানের খাদ্য গ্রহন করে তা উচ্চমূল্যের প্রোটিনে পরিণত করে বলে ভূমিহীন কৃষক, প্রান্তিক চাষী এবং নারী ও কর্মহীন মানুষদের সংসারে বাড়তি আয়ের একটা ভালো যোগান হতে পারে ভেড়া পালন।
৫) ভেড়ার মাংস তুলনামূলকভাবে নরম, রসালো ও গন্ধহীন এবং মাংশের আঁশ চিকন বলে সহজপাচ্য।
৬) ভেড়া প্রধানত: বছরে ২ বার বাচ্চা প্রদান করে এবং প্রতি প্রসবে অনুন্য ২টি বাচ্চা দেয় এ কারণে কম সময়ে দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধি হয়।
৭) ভেড়ার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি।
৮) ভেড়া পালন করে থেকে শুধু মাংসই পাওয়া যায় না, ভেড়া থেকে পাওয়া যায় উন্নতমানের গরম কাপড় তৈরির জন্য পশম এবং চামড়া।
বাংলাদেশে মোট ১.৬৯ মিলিয়ন ভেড়া আছে। জাতীয় আয় ও সং খ্যার দিক থেকে বাংলাদেশে পশুসম্পদের মধ্য ভেড়ার স্থান চতুর্থ। ভেড়া উৎপাদন বৃদ্ধির হার ১২%, যাহা গরু, ছাগল ও মহিষের তুলনায় অনেক বেশি।
ভেড়া ভূমিহীন, ক্ষুদ্রও মাঝারী চাষিদের অতিরিক্ত আয়ের উৎস। ৩০টি ভেড়ার খামার থেকে বছরে ৩০,০০০/- থেকে ৫০,০০০/- টাকা পর্যন্ত আয় হয়। বাংলাদেশে অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় ভেড়া পালন খুবই লাভজনক।