বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান খাদ্যশস্য মসুর ডাল। এ ডাল চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে অনেক কৃষক। আজকের আয়োজন এর বিভিন্ন দিক নিয়ে
ডাল জাতীয় ফসলের মধ্যে মসুর বেশ জনপ্রিয়। তাই দিন দিন এ ডাল চাষে কৃষকরা উৎসাহিত হচ্ছেন। তাছাড়া বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া ডাল চাষের জন্য খুবই উপযোগী। চাষের জন্য উপযুক্ত জমি তৈরি করে নিতে হবে।
মসুর চাষের জন্য বেলে দো-আঁশ ও এটেল দো-আঁশ মাটি উত্তম। পানি নিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা রয়েছে এমন জমি বাছাই করা উচিত। মসুর সাধারণত খরাসহিষ্ণু ফসল ও বৃষ্টিনির্ভর এলাকায় ভালো জন্মে। বাংলাদেশে রবি মৌসুম মসুর চাষ করার উপযুক্ত সময়। অর্থাৎ সেপ্টেম্বরের শেষদিক থেকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বীজ বপনের কাজ শুরু করতে হয়। এরপর অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বীজ বপন করা দরকার। মসুরের বীজ যথাসময়ে বপন করতে না পারলে ফলন তেমন আশানুরূপ হয় না।
জমি তৈরি
মসুরের বীজ আকারে অনেকটা ছোট। তাই জমি কয়েকবার চাষ ও মই দিয়ে বেশ ঝরঝরে ও নরম করে নিতে হবে। মাটি এটেল বা দো-আঁশ না হলে পলি মাটির ক্ষেত্রে বর্ষার পানি চলে যাওয়ার পর বিনা সেচেও মসুরের চাষ করা সম্ভব। মসুর গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না বলে জমি তৈরির সময় নালা কেটে পানি সেচের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
বীজ বপন
যেহেতু মসুর ডালের বীজ খুব ছোট সেহেতু জমিতে ছিটিয়ে বপন করা যায়। অথবা সারিবদ্ধভাবেও বীজ বপন করা সম্ভব। তবে মসুরের ফলনে এ পদ্ধতিতে তেমন কোনো পার্থক্য না থাকায় সাধারণত চাষিরা জমির শেষ চাষের সময় বীজ ছিটিয়ে বপন করে থাকে। তবে সারিতে বপন করতে চাইলে ৩০ সেন্টিমিটার দূরত্বে রেখে সারি করা যেতে পারে। জমিতে নাইট্রোজেন গুটি উৎপাদনকারী ব্যাকটেরিয়া কম থাকলে বপনের আগে উপযুক্ত ইনোকুলাম বা জীবাণু সার প্রয়োগ করলে ফলন বৃদ্ধি পায়। তবে জমিতে আগে মসুর চাষ হয়ে থাকলে প্রাথমিক ইউরিয়া বা জীবাণু সার প্রয়োগ করার প্রয়োজন পড়ে না।
সার প্রয়োগ
নদী অঞ্চলের জমিতে মসুর চাষ করতে জৈব সার প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। অন্যান্য অঞ্চলের বেলে দো-আঁশ বা এটেল দো-আঁশ মাটিতে জৈব সার দিতে হয়। এছাড়া ইউরিয়া সার দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। মাটিতে সামান্য পরিমাণে কোবাল্ট ও মলিবডেনাম নামক গৌণ খাদ্যোপাদানের উপস্থিতিতে মিথোজীবী, ব্যাকটেরিয়াগুলোর বংশবৃদ্ধি ঘটে। ফলে মাটিতে নাইট্রোজেনের বন্ধন বেশি হয়।
পরিচর্যা
বীজ বপনের এক মাসের মধ্যে নিড়ানি দিয়ে আগাছা দমন করতে হয়। গাছ ঘন থাকলে পাতলা করা যেতে পারে। সাধারণত বাংলাদেশে মসুর চাষে সেচ প্রয়োগ করা হয় না। তবে মাটিতে রসের অবস্থা বুঝে সেচ দেওয়া উত্তম। খেয়াল রাখতে হবে সেচের পানি যাতে জমে না থাকে।
ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
সাধারণত বীজ বপনের তিন থেকে সাড়ে তিন মাসের মধ্যে মসুর ডালে পরিপক্বতা আসে। পরিপক্ব হলে ফসল সংগ্রহ করতে হবে। ডাল সংগ্রহের পর ভালো করে রৌদ্রে শুকিয়ে মাটির পাত্র, টিন কিংবা শুকনো ড্রামে সংরক্ষণ করতে হবে। পোকা-মাকড় বা বাতাস যাতে ঢুকতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
পুষ্টিগুণে ভরা
মসুর ডালে প্রোটিন, খনিজ পদার্থ, আঁশ, খাদ্যশক্তি, আমিষ, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ক্যারোটিন, ভিটামিন বি-২, শর্করা প্রভৃতি রয়েছে। দেখে নিন এর কয়েকটি পুষ্টিগুণ মসুর ডালে উচ্চমাত্রার দ্রবণীয় ফাইবার রয়েছে, যা রক্তের কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে
# হজমে সহায়তা করে
# হার্ট ভালো রাখে। মসুর ডাল ফলেট ও ম্যাগনেসিয়ামের এক বিরাট উৎস, যা হৃৎপিন্ডকে আরও বেশি সতেজ রাখতে সহায়তা করে
# ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ কমায়। এটি শরীরের চিনির পরিমাণ কমিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, উচ্চ রক্তচাপ কমাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে
# গর্ভবতী মায়েদের জন্য উপকারী। এ ডালে একসঙ্গে আয়রন ও ফলেট পাওয়া যায়। গর্ভাবস্থায় এ দুটি উপাদান বেশ প্রয়োজনীয়
# ওজন কমাতে চাইলে নিয়মিত মসুর ডাল খান
# ত্বক সতেজ করতে মসুর ডাল পিষে এর সঙ্গে মধু ও দই মিশিয়ে মুখে লাগান। ২০ মিনিট পর হালকা ম্যাসাজ করে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এতে আপনার ত্বক সতেজ হবে
# মুখের কালচে ভাব দূর করতে মসুর ডাল রাতে দুধের মধ্যে ভিজিয়ে রাখুন। সকালে সেই ডাল পিষে মুখে লাগান। প্রতিদিন মুখে এ প্যাকটা লাগাতে পারেন, চেহারার কালো ভাবটা দূর হয়ে যাবে
# ক্ষতের দাগ সারাতে সাহায্য করে
# মুখ ও পিঠের দাগ দূর করতে মসুরের সঙ্গে পোলাও চাল মিশিয়ে পেস্ট করুন। এতে চন্দন পাউডার, মূলতানি মাটি ও কমলালেবুর শুকনো গুঁড়ো মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করুন। চার চামচ শসার রস দিন। মুখ ও শরীরের নানা স্থানে পেস্টটি লাগান। শুকিয়ে যাওয়ার পর ধুয়ে ফেলুন
# পায়ের পাতা বা আঙুলের কালচে রঙ, হাঁটু, পায়ের গোড়ালির ময়লা ও রুক্ষ ভাব দূর করতে প্রাচীনকাল থেকে মসুর বাটার ব্যবহার করা হচ্ছে
# স্পর্শকাতর অঙ্গ যেমন বগল, কুঁচকি ও কোমরের কালো দাগ দূর করতে মসুর ডালের সঙ্গে কমলালেবুর শুকনো গুঁড়ো ও চার চামচ শসার রস মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে লাগান। শুকিয়ে গেলে ধুয়ে ফেলুন
# বলিরেখা দূর করতে কাঁচা হলুদের সঙ্গে মসুর বাটা ও দুধের সর মিশিয়ে মুখে মাখুন ফেস প্যাক হিসেবে
স ডার্ক সার্কেল সারাতে একমুঠো মসুর ডাল ভিজিয়ে রাখুন ঘণ্টাখানেক। এরপর মিহি করে বেটে নিয়ে পাতলা সুতি কাপড়ের ভেতর মসুর ডাল বাটা দিয়ে পুঁটলির মতো তৈরি করুন। এই পুঁটলি চোখের ওপর রাখুন ২০ মিনিট
# মেছতা দূর করতে মসুর ডাল ভিজিয়ে রেখে বেটে নিন অ্যালোভেরার রসের সঙ্গে মিশিয়ে। মিশ্রণটি মেছতার ওপর লাগিয়ে রাখুন আধঘণ্টা। উপকৃত হবেন
স মাথার ত্বকের চুলকানি দূর করতে ভীষণ উপকারী।
বিভিন্ন জাতের হয়ে থাকে…
উৎফলা
উৎফলা জাতটি বারি মসুর-১ হিসেবে পরিচিত। এটি পাবনা থেকে সংগৃহীত জার্মপ্লাজম থেকে উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ জাতীয় ডালের গাছ মধ্যম আকৃতির হয়ে থাকে। এর উপরিভাগের ডগা বেশ সতেজ হয়। গাছের পাতা গাঢ় সবুজ। কাণ্ড হালকা সবুজ হয়ে থাকে। ফুলের রং সাদা। এ জাতের বীজের আকার একটু বড় হয়ে থাকে।
সিন্ধু
জাতটি মূলত বিদেশি। ইকার্ডা থেকে এর বীজ আনা হয়েছে। এ জাতের মসুরের গাছ মধ্যম আকৃতির। গাছের উপরিভাগ সামান্য লতানো। পাতা সরু। গাছের পাতা গাঢ় সবুজ। কাণ্ড ও ফুলের রং উৎফলা জাতের মতো।
ফাল্গুনী
ফাল্গুনী একটি সংকর জাত। ফাল্গুনী বারি মসুর-৩ জাত হিসেবে পরিচিত। বহু স্থানে বিভিন্ন পরীক্ষার পরে বাছাইকৃত এ জাতটি কৃষকরা চাষাবাদের জন্য অনুমোদন লাভ করে। পাতার রং সবুজ। বীজের রং ধূসর। বীজে ছোট কালচে দাগ আছে। এ জাতের বীজ বড়।
সুরমা
সুরমা জাতটি বারি মসুর-৪ হিসেবে পরিচিত। বারি মসুর-১ ও ইকার্ডা থেকে প্রাপ্ত জাতের সঙ্গে সংকরায়ণ করে জাতটি উদ্ভাবন করা হয়। এটি উন্নত জাত হিসেবে চাষাবাদ করা হয়। এ জাতের গাছের রং হালকা সবুজ বর্ণের হয়ে থাকে। ফুলের রং বেগুনি। এর পাতা মূলত বড় আকারের। বীজের আকার স্থানীয় জাত হতে বড় ও চ্যাপ্টা ধরনের হয়।
বারি মসুর-৫
২০০৬ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড ‘বারি মসুর-৫’ জাতটি বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের জন্য অনুমোদন দেয়। এর পাতার রং হালকা সবুজ হয়ে থাকে। পাতার অগ্রভাগে ছোট আকারের টেন্ড্রিল থাকে। গাছের ধরন ঝোপের মতো। ফুলের রং সুরমার মতো হালকা বেগুনি। বীজের রং লালচে বাদামি। এর পরিপক্বতার সময়কাল সাড়ে তিন মাস থেকে চার মাস।
বারি মসুর-৬
এটিও ২০০৬ সালে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের জন্য অনুমোদিত হয়। এর পাতার রং গাঢ় সবুজ। তবে এর পাতার অগ্রভাগে টেন্ড্রিল থাকে না। বারি মসুর-৫-এর মতোই গাছ ঝোপালো হয়। এর ফুলের রং সাদা। বীজ গাঢ় বাদামি। পরিপক্ব হতে তিন থেকে সাড়ে তিন মাস লাগে।
বারি মসুর-৭
এ জাতটি বাংলাদেশের সব এলাকায় চাষাবাদের উপযোগী। বিশেষ করে পাবনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, রাজশাহী, মাগুরা, ঝিনাইদহ ও মাদারীপুরে তুলনামূলক বেশ চাষ হয়। অন্যান্য জাতের মতো এটি বেড়ে ওঠে।
রোগবালাই ও প্রতিকার
মসুর চাষ করে বর্তমানে আমাদের দেশের কৃষকরা লাভের মুখ দেখছেন। তবে চাষ করার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তাদের। কেননা মসুর বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই আক্রমণের শিকার হয়। এসব রোগবালাই ও তার প্রতিকার জেনে রাখা যেতে পারে।
গোড়া পচা: মসুরের যে কোনো গাছ এ রোগ আক্রান্ত হতে পারে। চারা গাছের মাটির ঠিক উপরের কাণ্ডে এ রোগের আক্রমণ দেখা যায়। রাইজকটনিয়া নামক এক ধরনের ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগটি হয়ে থাকে। এ রোগে আক্রান্ত গাছের অংশ পচে নরম হয়ে যায়। এর আক্রমণে গাছের পাতা শুকিয়ে যায়। গাছের শিকড় ও কাণ্ডেও এ রোগ হতে পারে। কখনও বা গাছ মাটির ওপর ঢলে পড়ে।
স্টেমফাইলিয়াম ব্লাইট: স্টেমফাইলিয়াম বোট্রাইওসাম নামক ছত্রাক এ রোগের কারণ। আক্রান্ত হলে গাছ বাদামি হয়ে যায়। বেশি আক্রমণ হলে গাছ দ্রুত মরে যায়। কুয়াশাচ্ছন্ন বা মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া অথবা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে এ রোগের বিস্তার ঘটে। আক্রমণের শেষ পর্যায়ে গাছ বাদামি থেকে কালো রং ধারণ করে ও নুইয়ে পড়ে।
মরিচা: ইউরোমাইসিস ফেবেই নামক ছত্রাক এ রোগের কারণ। এ রোগ সাধারণত বয়স্ক গাছে বা ফুল আসার সময় দেখা দেয়। প্রথমে পাতায় মরিচা রঙের ছোট ছোট ফুসকুড়ি পড়া দাগ দেখা যায়। পরে দাগগুলো গাঢ় বাদামি বা কাল রং ধারণ করে। কাণ্ড বা ফলেও এমন লক্ষণ দেখা যায়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে পাতা ঝরে যায় এবং ফল পাকার আগেই গাছগুলো শুকিয়ে যায়।
হোয়াইট মোল্ড রোগ: ছত্রাকের আক্রমণে মসুরের গাছে এ রোগ দেখা দেয়। এর আক্রমণে পাতার বোটায় ও কান্ডে সাদা তুলার মত বস্তু দেখা যায়। পরে ধীরে ধীরে তা পচে যায়।
এনথ্রাকনোজ রোগ: মসুরের চারা অবস্থায় ও ফুল আসার আগে এনথ্রাকনোজ রোগ দেখা দেয়। কচি অবস্থায় এ রোগ দেখা দেয় বলে দ্রুত মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ রোগের আক্রমণে পত্রফলকে চকলেট রং ধারণ করে ও ফ্যাকাসে দাগ দেখা দেয়। এ রোগ কান্ডেও হতে পারে।
প্রতিকার: বীজ বপনের পর জমিতে অতিরিক্ত ইউরিয়া ও জৈবসার প্রয়োগ করা যাবে না। সময়মতো সেচ দিতে হবে। স্প্রিংলার সেচের পরিবর্তে প্লাবন সেচ দেওয়া উত্তম। রোগ আক্রান্ত জমিতে কৃষি অধিদফতরের পরামর্শ অনুযায়ী ছত্রাকনাশক ওষুধ স্প্রে করতে হবে, তবে তা শেষ বিকেলে দেওয়া আবশ্যক। যেগুলো আক্রান্ত হবে সেগুলো জমি থেকে দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে। এতে অন্য গাছ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।