মাছের পোনা চাষ ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ নানা দিক

132

মাছের পোনা পুকুরে চাষোপযোগী করার কয়েকটি ধাপ রয়েছে। এসব ধাপ সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা উচিত। এ লক্ষ্যে কিছু করণীয় রয়েছে, যা যথানিয়মে সম্পন্ন করাকেই চাষ ব্যবস্থাপনা বলে। পোনামাছ উৎপাদনের জন্য চাষ ব্যবস্থাপনাকে অধিক গুরুত্ব দিতে হয়। এগুলো লালন-পালন করা হয় আঁতুড় ও চারাপুকুরে। পোনা ছাড়ার আগে ও পরে যে পদক্ষেপগুলো রয়েছে, তা চাষ ব্যবস্থাপনারই অংশ।

পোনা চাষের জন্য পুকুরের গভীরতা রক্ষা করা প্রয়োজন। পোনামাছ অপেক্ষাকৃত কোমল স্বভাবের হয়, তাই পুকুরের গভীরতা হ্রাস বা বৃদ্ধিতে পোনামাছের সমস্যা হতে পারে। এমনকি মরেও যেতে পারে। সুতরাং গভীরতা নির্দিষ্ট পরিমাণের হওয়া উচিত। আঁতুড়পুকুরের গভীরতা এক মিটার থেকে এক দশমিক পাঁচ মিটার ও চারা পুকুরের গভীরতা এক দশমিক পাঁচ মিটার থেকে দুই দশমিক পাঁচ মিটার পর্যন্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে। কোনো কারণে গভীরতা কম বা বেশি হলেও অন্য কোনো উৎস থেকে পানি সেচ দিয়ে গভীরতা নির্দিষ্ট রাখতে হবে।

পোনামাছ কোমল প্রকৃতির। দ্রুত ছুটতে পারে না। এছাড়া আঁতুড়পুুকুর বা চারাপুকুর ছোট ও অগভীর হওয়ায় এদের ছোটাছুটি করার সুযোগও কম থাকে। ফলে সাপ, ব্যাঙ, রাক্ষুসে মাছ প্রভৃতির সহজ শিকারে পরিণত হয়। পোনামাছের পুকুরে এসব প্রাণীর উপস্থিতি দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে ফেলতে হবে। প্রয়োজনে মেরে ফেলারও ব্যবস্থা করতে হবে।

এবার পোনামাছের খাবার নিয়ে আলোচনা করা যাক। খাবারের চাহিদা যাচাই না করে পুকুরে খাদ্য দেওয়া উচিত নয়। তাছাড়া পরিবেশ ও জৈবিক কারণে পোনামাছ প্রতিদিন একইভাবে খাবার নাও খেতে পারে। এতে সেসব খাবার অব্যবহƒত থেকে যায়, যা তলায় জমে পানি নষ্ট করে। অনেক সময় পুকুরের পানির গুণাগুণ বজায় রাখতে সার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে অতিরিক্ত সার দিলে এর অংশবিশেষ অব্যবহƒত থাকে। এতে পানির গুণাগুণ বজায় না থেকে বরং নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া অতিরিক্ত খাবার ও সার ব্যবহারে পানির উপরিভাগে শেওলাও জš§াতে পারে। সুতি কাপড় দিয়ে পানির উপরিভাগের শেওলা অপসারণ করতে হবে।

আঁতুড় বা চারাপুকুরে নিয়ম অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের বেশি পোনা রাখা উচিত নয়। প্রথমে আঁতুড়পুকুরে চাষ পূর্ণ হওয়ার পর চারা পুকুরে, চারা পুকুরে পূর্ণ হওয়ার পর মজুত পুকুরে স্থানান্তর করা হয়। অনেক সময় আঁতুড় বা চারাপুকুরে চাষাধীন অবস্থায় কিছু পোনা অন্য পোনার থেকে বড় হয়ে যায়। তাই পুকুরে মাঝেমধ্যে জাল দিয়ে টেনে দেখতে হবে, বড় পোনা চোখে পড়লে তা বাছাই করে মজুত পুকুরে সরিয়ে নিতে হবে।

পোনামাছ চাষকালীন ভোরের দিকে দল বেঁধে পানির ওপরে ভেসে ওঠে, সাঁতার কাটে বা ছোটাছুটি করে। পোনা সুস্থতার লক্ষণ এগুলো। তবে মেঘলা আবহাওয়ায় পানিতে দীর্ঘক্ষণ খাবি খেতে থাকলে ধরে নিতে হবে পোনা অস্বস্তিতে ভুগছে বা কোনো সমস্যা রয়েছে। এ সময় দ্রুত প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে। সাধারণত পানি দূষণ কিংবা পানিতে অক্সিজেন কমে গেলে পোনার শ্বাসকষ্ট হয়। তখন পোনা পানির ওপরে ভেসে ওঠে এবং খাবি খেতে থাকে। এমনটি দেখা দিলে পানির গুণাগুণ পরীক্ষা করতে হবে। এ সময় পানি নাড়াচাড়া করতে হয় অথবা মৃদুভাবে পানিতে বাঁশ দিয়ে ঢেউ জাগিয়ে দিলে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ বেড়ে যায়।

পোনা পরিচর্যায় আঁতুড়পুকুর

ডিম থেকে পোনা জন্ম নেওয়ার পর বিশেষ যত্নের সঙ্গে পুকুরে চাষ করা হয়ে থাকে। পোনার পর্যায় পার হওয়ার আগ পর্যন্ত আঁতুড়পুকুরে রেখে পালন করা হয়। এ আঁতুড়ে লালন-পালন করে মজুত পুকুরে ছেড়ে দেওয়া হয়। পোনা পরিচর্যায় আঁতুড়পুকুরের পরিবেশ কেমন হবে বা কেমন হওয়া উচিতÑসে সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন

আয়তন

আঁতুড়পুকুর শূন্য দশমিক শূন্য তিন থেকে শূন্য দশমিক শূন্য সাত হেক্টর পরিমাপের হতে হবে। ছোট ডোবা, গর্ত, মিনি পুকুর প্রভৃতি আঁতুড়পুকুর হিসেবে ব্যবহার করা যায়

অবস্থান

বন্যামুক্ত পরিবেশ পানির উৎসের নিকটবর্তী স্থানে আঁতুড়পুকুর খনন করা উচিত, যাতে সহজে পানি সরবরাহ ও বের করে দেওয়া যায়। পর্যাপ্ত রোদ ও আলো-বাতাসযুক্ত স্থান নির্বাচন করা উচিত

গভীরতা

পানির গভীরতা এক থেকে এক দশমিক পাঁচ মিটারের মধ্যে স্থির থাকা প্রয়োজন। পাড় শক্ত ও তলদেশ সমতল হতে হবে। কোনো ইট, পাথর ও আবর্জনা যাতে না থাকে, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে মাটি দোআঁশ মাটি আঁতুড়পুকুরের জন্য উপযোগী।

আঁতুড়পুকুর তৈরিতে করণীয়

মাছের পোনাকে প্রথম দিকে আঁতুড়পুকুরে রেখে প্রতিপালন করা হয়। কিন্তু এ আঁতুড়পুকুরে পোনা চাষোপযোগী করার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এতে পোনা অনুকূল পরিবেশে বেড়ে উঠবে।

রাক্ষুসে মাছ ও আমাছা দমন

আঁতুড়পুকুর তৈরির আগে কোনো রাক্ষুসে মাছ ও আমাছা (উৎপাদনে বাধা সৃষ্টিকারী গাছ) থাকলে তা অবশ্যই দমন করতে হবে। আঁতুড়পুকুরে এদের উপস্থিতি স্বাভাবিক। এ সময় পুকুরের পানি নিষ্কাশন করে রাক্ষুসে ও আমাছা দূর করতে হবে। পুকুরের তলদেশ শুকিয়ে চাষ করা ভালো। এতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পাবে মাছ। পানি নিষ্কাশন সম্ভব না হলে ব্লিচিং পাউডার, চা-বীজ পাউডার বা অন্য কোনো রাসায়নিক ছিটিয়ে রাক্ষুসে মাছ ও আমাছা দূর করা সম্ভব।

চুন ও সার প্রয়োগ

আঁতুড়পুকুরে চুন ও সার দেওয়া আবশ্যক। তবে রাক্ষুসে মাছ দূর করতে যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর ক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত চুন বা সার দেওয়া ঠিক নয়। পুকুরে সার দেওয়ার আগে প্রথমে চুন ব্যবহার করতে হবে। চুনের ব্যবহারে পুকুরের

রোগ-জীবাণু দূর হবে। এছাড়া অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব বজায় থাকে বা তলদেশের মাটির উর্বরতা বাড়ায়। শুকনো অথবা ভেজা অবস্থায় চুন দেওয়া যাবে। পুকুরের মাটি বেশি ক্ষারধর্মী হলে কলিচুন দেওয়া উচিত। সরাসরি চুন না দিয়ে পানির সঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করতে হবে। আঁতুড়পুকুরের পরিমাণ, মাটির গঠন ও প্রকৃতি অনুযায়ী চুন পানিতে মিশিয়ে পুকুরে সমভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, ছিটিয়ে দেওয়া চুন তলদেশের মাটির সঙ্গে যেন ভালোভাবে মিশে যায়। চুন দেওয়ার সপ্তাহখানেক পরই সার দেওয়া যাবে। তবে পোনা ছাড়ার আগেই এ সার দিতে হবে। তাছাড়া এ সার থেকেই কিছু প্রাকৃতিক খাবার তৈরি হতে পারে, যা পোনার জন্য সুবিধার হবে। সার ব্যবহারের তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে এ প্রাকৃতিক খাবার তৈরি হতে শুরু করে। পুকুরে সার হিসেবে ইউরিয়া, টিএসপি ও খৈল দেওয়া যেতে পারে।

পোকামাকড় দূর করা

পুকুরে সার প্রয়োগের পরপরই বিভিন্ন পোকামাকড় যেমন পানিপোকা, বিছা, হাঁসপোকা প্রভৃতি জন্ম নেয়। পানির পোকামাকড়ের মধ্যে হাঁসপোকা বেশি ক্ষতিকর। পাশের জলাশয় বা ক্ষেত থেকে এসব পোকা উড়ে এসে পুকুরে পড়ে। জাল দিয়ে টেনেও এদের সম্পূর্ণ শেষ করা যায় না। তাই কেরোসিন তেল ও সাবান-পানি মিশিয়ে দিলে সহজেই মেরে ফেলা সম্ভব। সাবান পানিতে গুলিয়ে নিয়ে তাতে তেল মিশিয়ে ভালো করে নেড়ে এক ধরনের মিশ্রণ তৈরি করে নিতে হবে। এ মিশ্রণ পুকুরের চারদিকে সমানভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। তবে ঠাণ্ডা আবহাওয়া বা বৃষ্টির দিনে এ মিশ্রণ না দেওয়াই উত্তম। উষ্ণ আবহাওয়ায় ভোরে অথবা সন্ধ্যায় যখন বাতাস থাকে না, তখন এটি দিলে ভালো উপকার পাওয়া যাবে। পোনা ছাড়ার অন্তত পাঁচ দিন আগে এ পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া আলোর ফাঁদ পেতেও এসব পোকামাকড় মেরে ফেলা সম্ভব।