মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার অন্যতম হল খাদ্য। আর খাদ্য হিসাবে ভাতের সাথে থাকে মাছ। এ দেশের একটি গ্রামীণ প্রবাদ আছে যে আমরা ‘মাছে ভাতে বাঙ্গালী’। মাছ ছাড়া বাঙ্গালীদের কোনভাবেই চলবেনা। মাছের এই বিশাল চাহিদার যোগানের উৎস হিসাবে বর্তমানে ‘বায়োফ্লক’ প্রযুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
পরিবর্ত নেরসাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও মাছ চাষে লেগেছে আধুনিক প্রযুক্তির ছোয়া। পুকুর না কেটেই এখন অল্প বিনিয়োগে মাছ চাষ করা যাচ্ছে। স্বল্প খরচে অধিক মাছ চাষের নতুন এক প্রযুক্তির নাম ‘বায়োফ্লক’। এ পদ্ধতিকে দেশীয় আবহাওয়ার উপযোগী করে গড়ে তুলতে গবেষণা করে যাচ্ছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একোয়াকালচার বিভাগের একদল গবেষক। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে প্রথমবার বিশ্ববিদ্যালয়টিতে স্থাপন করা হয়েছে বায়োফ্লক ল্যাব।
বায়োফ্লক সম্পর্কে গবেষক দলের প্রধান ড. এ এম সাহাবউদ্দিন বলেন, বায়োফ্লক প্রযুক্তি মাছ চাষের একটি পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতি যা ক্রমাগতভাবে পানিতে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানগুলোকে পুনরাবর্তনের মাধ্যমে পুনঃব্যবহার নিশ্চিত করে। বায়োফ্লক হলো প্রোটিন সমৃদ্ধ জৈব পদার্থ এবং বিভিন্ন অণুজীবের সমষ্টি। সাধারণত মাছের জন্য পুকুরে যে খাবার দেয়া হয় তার উচ্ছিষ্ট পুকুরে দূষিত অ্যামোনিয়া তৈরি করে যা মাছের জন্য ক্ষতিকর।
বায়োফ্লক মাছ চাষের নতুন পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে উপকারী ব্যাকটেরিয়া অ্যামোনিয়া থেকে একক প্রোটিন তৈরি করে যা মাছ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এতে একদিকে পুকুরে মাছ চাষের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়, তেমনি মাছের খাবার খরচ কমে যায়। ফলে মাছের মজুদ ঘনত্ব বাড়িয়ে দেয়া যায়। সনাতন পদ্ধতিতে যেখানে ১০ টি মাছ চাষ করা যায় , এ পদ্ধতিতে সেখানে ৩০ টি পর্যন্ত মাছ চাষ করা যায়। এই প্রযুক্তি পানিতে বিদ্যমান কার্বন ও নাইট্রোজেনের সাম্যবস্থা নিশ্চিত করে পানির গুণাগুণ বৃদ্ধি ও ক্ষতিকর জীবাণু নিয়ন্ত্রণ করে।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের প্রক্রিয়া সম্পর্কে গবেষকরা জানান, এই পদ্ধতিতে বাড়ির আঙিনায় , ছাদে, অল্প জায়গায় এমনকি সবজি ও মাছ একসাথে চাষ করা যায়। এ পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য ট্যাংক, অক্রিজেন সরবারহের পাম্প ও সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। প্রথমে ট্যাংকে পানি দিয়ে এক সপ্তাহ অক্সিজেন সরবরাহ করতে হবে। এতে আয়রন বা অন্য ভারী পদার্থ থাকলে উপরে জমা হবে।
এরপর প্রতি ১ হাজার লিটারে ১ কেজি হারে আয়োডিন মুক্ত সাধারণ লবণ প্রয়োগ করতে হবে। এরপর টিডিএস ১২০০ এর উপরে হলে প্রতি ১ হাজার লিটারে ১০ গ্রাম চুন প্রয়োগ করতে হবে। পিএইচ ৭.৫ এর কাছাকাছি হলে ভালো ব্যাকটেরিয়া নির্দিষ্ট অনুপাতে পানিতে দিতে হবে। সাথে কার্বন সোর্স হিসেবে মোলাসেস ৫০-১০০ গ্রাম দিতে হবে। সবসময় অক্রিজেনের সরবরাহ রাখতে হবে। দুই সপ্তাহ পর এতে ব্যাকটেরিয়া , প্রোটোজোয়া, শৈবাল তৈরি হবে যা উপকারী।
পানিতে ৩০-৪০ সেন্টিমিটার বায়োফ্লক তৈরি হলে মাছ ছাড়া যাবে। এ পদ্ধতিতে পানি পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় না। তবে অতিরিক্ত ফ্লক তৈরি হলে বা অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে গেলে ৫-১০ শতাংশ পানি প্রতি সপ্তাহে বের করে দিতে হবে। প্রতিদিন পিএইচ, অ্যমোনিয়া এবং ফ্লক ঘনত্ব পরিমাপ করতে হবে। মাছের খাবার হিসেবে ভাসমান খাবার দেওয়া ভালো।
কোনো ধরনের মাচ চাষ করা যাবে জানতে চাইলে ড. এ এম সাহাবউদ্দিন বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করা হয়। আমাদের দেশে এ প্রযুক্তির মাধ্যমে মাছ চাষ এখনও ব্যাপকভাবে শুরু হয়নি। আমাদের দেশে সচরাচর চাষকৃত মাছ যেমন- তেলাপিয়া, রুই, শিং, মাগুর, পাবদা, গুলশা ও চিংড়ীসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করা যেতে পারে। তবে যারা নতুন করে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছ চাষ শুরু করতে চান তাদের ক্ষেত্রে প্রথমে তেলাপিয়া, শিং ও মাগুর মাছ দিয়ে চাষ শুরু করা সমীচীন হবে।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ কেন লাভজনক-প্রশ্নোত্তরে ড. সাহাবউদ্দিন বলেন, মাছ চাষের শতকরা ৬০ ভাগ খরচ হয় খাবারের জন্য। এ পদ্ধতিতে খাবার কম লাগে, রোগের প্রাদুর্ভাব কম হয়। অল্প জায়গায় বেশি পরিমাণ মাছ চাষ করে অধিক মুনাফা অর্জন করা যায়। এ পদ্ধতিতে বাড়িতে যে কোন চাষী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কারিগরি দক্ষতা অর্জন পূর্বক ৩০-৪০ টি ট্যাংকে সহজেই মাছ চাষ করতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, এ প্রযুক্তি যদি মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে দেশে মাছের উৎপাদন অধিক পরিমাণে বৃদ্ধি করা সম্ভব। যা সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সচেষ্ট ভূমিকা পালন করবে।
ফার্মসএন্ডফার্মার২৪/জেডএইচ