মাছ-মুরগির খাবার ‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’ আসলে কতটা লাভজনক?

350

‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’ মূলত একটি মাছি জাতীয় প্রাণীর লার্ভা। খামারি ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের ফিশারিজ ও পোলট্রি খাতের জন্য বড় ধরণের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। মাছ ও পোলট্রির প্রচলিত খাদ্যের বিপরীতে এটিই ভবিষ্যতে বিকল্প খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হবে। তবে, মাছ-মুরগির খাবার ‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’ আসলে কতটা লাভজনক?

এটি হওয়ার কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’ তৈরির ফিডের তুলনায় পুষ্টিমান কম নয়। একইসাথে কম খরচের কারণে খাবার হিসেবে এটি ব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এটি মাছি-জাতীয় হলেও ক্ষতিকর প্রাণী নয় এবং একেবারেই প্রাকৃতিক বলে মাছ বা মুরগির মাধ্যমে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কিছু সম্ভাবনা থাকে না।

ইতোমধ্যেই গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও, মুন্সীগঞ্জ সহ নানা জায়গায় গড়ে উঠেছে এ পোকাটির চাষের খামার এবং বর্তমান খামারিদের কাছ থেকে প্রতিদিনই বীজ বা মাতৃপোকা সংগ্রহ করছেন আগ্রহী খামারিরা।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে মাছি জাতীয় এই পোকাটির চাষ শুরু করেন জুলফিকার আলী মামুন। তিনি এই পোকা এনেছিলেন চীন থেকে। এখন গত কয়েকমাস ধরে নিজের খামারের মুরগিকে এটিই খাওয়াচ্ছেন। বাজারের পোলট্রি ফিডে অনেক খারাপ উপাদান থাকে যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এই পোকাটিতে সেই ঝুঁকি নেই,”

সুপরিচিত কৃষি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ বলছেন – ‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’ বা বিএসএফ আগামী দিনে বাংলাদেশে ঘরে ঘরে কুটির শিল্পের মতো হবে। এটি ন্যাচারাল ও উৎপাদন খরচ খুব কম। এর বিপরীতে বাজারে ফিশারিজ ও পোলট্রির যেসব খাবার পাওয়া যাচ্ছে তার দামও অনেক বেশি, আবার এগুলোর পুষ্টিমান নিয়ে সংশয় আছে। অন্যদিকে বিএসএফে প্রোটিন অনেক বেশি,”

তিনি বলছেন, উন্নত বিশ্বে ফিশারিজ ও পোলট্রি ফিড হিসেবে ইতোমধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বিএসএফ। ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’ বা বিএসএফ সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, তাতে এতে প্রোটিনের পরিমাণ ৪৩-৫৫ শতাংশ পর্যন্ত। অন্যদিকে বর্তমানে বাজারে ফিশারিজ ও পোলট্রি ফিড যা পাওয়া যায় – তার প্যাকেটে ৩৩ শতাংশ প্রোটিন উল্লেখ করা হলেও বরাবরই এ নিয়ে অভিযোগ আসে খামারিদের কাছ থেকে।

শাইখ সিরাজ বলছেন এটি এক ধরণের মাছি জাতীয় প্রাণী – যা ব্যক্তি উদ্যোগে খামারিরা বাংলাদেশে এনেছে। কালো রংয়ের এ মাছিটি পোকা হিসেবেও পরিচিত অনেকের কাছে। তবে এটি আকারে মাছির তুলনায় কিছুটা লম্বা। এমনই একজন খামারি গাইবান্ধার জুলফিকার আল মামুন বলছেন, তিনি চীন থেকে এটি আনিয়েছেন।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বলছে, ২০৩০ সাল নাগাদ এই বিএসএফের বৈশ্বিক বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৩৪ শতাংশের বেশি হবে। খামারিরা বলছেন, হাঁস বা মুরগীকে খাওয়ানোর সময় এই বিএসএফের লার্ভার সাথে কিছুটা কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার মিশিয়ে খাওয়ানো হয়। এর ফলে কোন ধরণের রাসায়নিক উপাদান ছাড়াই প্রাকৃতিকভাবেই হাঁস ও মুরগীর বৃদ্ধি অনেক বেশি হয়।

মাছির মতো মূল পোকাগুলো একটি জালের মধ্যে রাখা হয়। সেখানে দিনের বেলায় আলো যেন আসতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। একটা সময় পোকাগুলো নিজেদের প্রজনন ক্রিয়া সম্পন্ন করে। পরে সেখানে কাঠের স্তরের মধ্যে ডিম পাড়ে। সেই ডিমগুলো হ্যাচিং করে ফোটানোর আট থেকে দশ দিন পর আলাদা করে অন্য জায়গায় রাখা হয়।

পড়তে পারেন: এলো নতুন ব্রয়লার মুরগি, ২৭ দিনে ২ কেজি!

এরপর সেখান থেকে লার্ভা তৈরি হয়। ২০-৩০ দিনের মধ্যে এই লার্ভাগুলো দেখতে পোকার মতো হয় যেগুলো মাছ, হাঁস বা মুরগীকে খাবার হিসেবে দেয়া হয়।

এগুলো তাওয়ায় ভেজে নিয়ে ১৮ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা সম্ভব। ২০-৩০ দিন পর লার্ভাটি থেকে গেলে পরে তা মাছিতে পরিণত হয় এবং একেকটি প্রাপ্তবয়স্ক মাছির জীবনকাল ৮-১০ দিন। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই পোকার মতো দেখতে লার্ভাগুলো আলাদা করে পরিষ্কার করে মাছ, হাঁস বা মুরগীকে দেয়া হয়। আবার মুরগীর নাড়িভুঁড়ি, পচা বা জীবিত মাছ বা যে কোন ধরণের নষ্ট বর্জ্য লার্ভার খাবার হিসেবে দেয়া হয়ে থাকে।

শাইখ সিরাজ বলছেন, একদিকে বর্জ্য এদের খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয় – অন্যদিকে এরা খাবার ছাড়াও নানা কিছুতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এমনকি যে মাছি বা পোকাগুলো মরে যাচ্ছে – সেগুলোও মাছ মুরগীর ফিড হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

জুলফিকার আলী মামুন বলছেন, চলতি বছরের শুরুতে তিনি মাত্র পাঁচ কেজি ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই দিয়ে খামার শুরু করেছেন – যা থেকে এ পর্যন্ত তিনি লার্ভা, মূল পোকা ও জৈবসার করেছেন দু’হাজার কেজির বেশি।

তিনি বলছেন তার কাছ থেকে গত কয়েক মাসে অনেকেই মাতৃপোকা, লার্ভা ও জৈবসার কিনেছেন। এখন মাতৃপোকা কেজি দু হাজার টাকা, লার্ভা ৭০ টাকা এবং জৈব সার ১৮-২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে বলে জানান তিনি।

ফিশারিজ ও পোলট্রি ফিডের বর্তমান বাজার ও ‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’ এর সম্ভাবনা বেসরকারি হিসেবে বাংলাদেশে পোলট্রি খাতের বর্তমান বিনিয়োগ চার বিলিয়ন ডলারের বেশি। পোলট্রির পাশাপাশি মাছ ও পশু চাষ বাড়ার কারণে ফিড শিল্প গত এক দশকে অন্তত ২৫ ভাগ বেড়েছে। দেশে নিবন্ধিত ফিড মিল আছে আড়াইশর বেশি। তবে পোলট্রি ফিডের একটি অংশ বিদেশ থেকেও আমদানি হচ্ছে।

প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর বলছে, দেশে প্রায় ষাট হাজার মুরগীর ও ৫ হাজারেরও বেশি হাঁসের খামার আছে। চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে মুরগী আর মাছের খামার। খামারিরা বলছেন, এক কেজি মাছের জন্য দুই কেজি ফিড দিতে হয়। সেই ফিডের উচ্চমূল্যের কারণে মাছ চাষে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে চাষিরা।

বলছেন তার স্বজনরা এই উচ্চ মূল্যের কারণে পোলট্রিতে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছিলো – যা তাকে এই পোকার খামার তৈরিতে উৎসাহিত করেছে। শাইখ সিরাজ বলছেন আগামী দিনে এ সমস্যা সমাধান হয়ে আসবে এই ‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’ বা বিএসএফ।

ফার্মসএন্ডফার্মার/১৪জুন ২০২২