মাছ সংরক্ষণ পদ্ধতি বিস্তারিত
মাছ পচনশীল বলে খুব দক্ষতার সাথে সংরক্ষণ করতে হয়। সচেতনতার অভাবে অনেক মাছ প্রতিবছর পঁচে যায়। এজন্য স্বাস্থ্যসম্মতভাবে অর্থাৎ নিরাপদভাবে মাছ সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। ফরমালিন ও রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে মাছ সংরক্ষণ উচিত নয়। ফরমালিনযুক্ত মাছ স্বাস্থ্যসম্মত নয়। স্বাস্থ্যসম্মতভাবে অর্থাৎ নিরাপদভাবে মাছ সংরক্ষণ পদ্ধতি নিচে বর্ণনা করা হলোঃ
ক. সনাতন পদ্ধতি: ১. শুঁটকিকরণ, ২. লবণজাতকরণ।
খ.আধুনিক পদ্ধতি: ১. বরফজাতকরণ, ২. হিমায়িত, ৩. টিনজাতকরণ বা ক্যানিং, ৪. ধূমায়িতকরণ।
১. শুকিয়ে মাছ সংরক্ষণ বা শুঁটকিকরণ
মাছের দেহ থেকে অতিরিক্ত পানি বের করে দিয়ে মাছ শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায়। এ প্রক্রিয়ায় ৮০-৮৫% পানি মাছের দেহ থেকে অপসারণ করা হয়। শুকনো মাছে জীবাণু সংক্রমণ ও বংশ বৃদ্ধি করতে পারে না। রোদ, সোলার ড্রায়ার ও ওভেনে মাছ শুকানো হয়। শুঁটকি মাছ কয়েক বছর সংরক্ষণ থাকে। সব ধরনের মাছ শুঁটকি করা যায়।
পদ্ধতি : ছোট মাছ যেমন: পুঁটি, মলা, চান্দা, চেলা, ঢেলা, কাচকি ইত্যাদি শুঁটকি করা সহজ। প্রথমে মাছগুলোর মধ্যে ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করা। মাছগুলো পানিতে ধুয়ে পেটে আঙ্গুল দিয়ে টিপে নাড়িভুঁড়ি বের করতে হয়। এরপর আবার পানিতে ধুয়ে ১০% লবণ পানিতে ১৫-২০ মিনিট রাখা হয় যাতে জীবাণু আক্রমণ না করে। মাছগুলো রোদে চাটাই বা টিনের উপর ছড়িয়ে দিতে হবে। দিনে ২/৩ বার উল্টিয়ে দিতে হয়। সাধারণত কড়া রোদে ৪-৫ দিনে মাছ শুকিয়ে সংরক্ষণ করার উপযোগী হয়।
বড় মাছ শুঁটকিকরণের জন্য প্রথমে মাছের অপ্রয়োজনীয় অংশ যেমন: আঁইশ, লেজ, পাখনা, নাড়িঁভুড়ি, ফুলকা ইত্যাদি অপসারণ করতে হবে। এরপর মাছ পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে চাকু দিয়ে মাথার পর থেকে লেজের গোড়া পর্যন্ত আড়াআড়ি শুধু মাংসপেশী কাটতে হয়। এই কাঁচা মাছগুলো প্রথমে চাটাই বা টিনের উপর রোদে ৩-৪ দিন শুকাতে হয়। এরপর ঝুলিয়ে শুকাতে হয়। এভাবে বড় মাছ শুকাতে ৮-১০ দিন সময় লাগে।
২. লবণজাতকরণ
লবণ জীবাণুনাশক ও জীবাণু প্রতিরোধের কাজ করে। শুষ্ক লবণায়ন পদ্ধতিতে: প্রথমে মাছের আঁইশ ও পাখনা দেহ থেকে সরানো হয়। এরপর পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করে পানিতে ধুতে হয়। তারপর মাছটির পিঠের দিক থেকে বুক পর্যন্ত আড়াআড়িভাবে কয়েকটি টুকরায় ভাগ করতে হয়। কিন্তু টুকরাগুলো পেটের দিকে কাটা যাবে না সংযোজন থাকবে। কাটা মাছের দেহের বাইরে ও ভিতরে হাত দিয়ে কয়েকবার ঘসে ভালোভাবে লবণ মাখিয়ে দিতে হয়।
আঙ্গুল দিয়ে চেপে চোখ ও ফুলকার ভিতরে লবণ ঢুকিয়ে দিতে হবে। শতকরা ২৫ ভাগ লবণ দিয়ে মাছ লবণজাত করা হয়। লবণ মিশ্রিত মাছগুলো বাঁশের ঝুড়ি বা কাঠের পাটাতনের উপর স্তরে স্তরে সাজিয়ে রাখতে হয়। প্রতি স্তরে হালকা লবণের ছিটা দিতে হয়। এরপর মাছগুলো মাদুর বা গোলপাতার চাটাই দিয়ে ঢেকে ১০-১৫ দিন রাখতে হয়। একে রাইপেনিং বলে। পানি ঝরে গেলে লবণজাত মাছগুলো টিনের কৌটায় রেখে গুদামজাত করা হয়। সাধারণত ইলিশ মাছ লবণজাত করে সংরক্ষণ করা হয়।
আর্দ্র বা ভিজা লবণায়ন পদ্ধতিতে মাছ সংরক্ষণের জন্য প্রথমে মাছের আঁইশ, ফুলকা ও নাড়িভুঁড়ি অপসারণ করে পানি দিয়ে ধুতে হয়। এরপর মাছের দেহ আড়াআড়ি করে তীর্যকভাবে কাটতে হয়। মাছের টুকরাগুলো ঘষে ভালো করে লবণ মাখিয়ে দেয়া হয়। লবণ মাখানো মাছগুলো টিনের পাত্রে এমনভাবে ভরতে হবে যাতে একটু জায়গা ফাঁকা থাকে। লবণ মাছের দেহে প্রবেশ করে এবং দেহ থেকে পানি বের হয়ে টিনের পাত্রের ফাঁকা জায়গায় জমা হয়। মাছ লবণজাত হতে ১৫-২০ দিন সময় লাগে।
৩. বরফজাতকরণ
বরফের সাহায্যে মাছ সংরক্ষণ হচ্ছে আধুনিক পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে সংরক্ষিত মাছের স্বাদ ও গন্ধ টাটকা মাছের মতো থাকে। বরফ দিয়ে মাছ দেহের তাপমাত্রা ০-৩ ডিগ্রি সে. করা হয়। ফলে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ঘটাতে পারে না। বরফ বাক্সে বা কোন পাত্রে বরফ দিয়ে মাছ রাখা হয়। বরফ গলা না পর্যন্ত মাছ ভালো থাকে। বরফ যাতে না গলে এজন্য বরফ বাক্স তৈরি হয়েছে। শীতকালে মাছের অর্ধেক পরিমাণ বরফ এবং গ্রীষ্মকালে বরফ ও মাছ সমান পরিমাণ করে দিতে হয়।
বরফ বাক্সে মাছ সংরক্ষণের জন্য ৩০ী২৪ী১৮ ঘন ইঞ্চি আকারের বরফ বাক্স ব্যবহার করা হয়। এতে বরফসহ প্রায় ৪০-৫০ কেজি মাছ ধরে। বাক্সটির বাহির ও ভিতরের দেয়াল জিআই সীট দিয়ে তৈরি। তাপ অপরিবাহী করার জন্য বাহির ও ভিতরের দেয়ালের মাঝখানে ১ ইঞ্চি পুরু কর্কসীট বসানো থাকে। উপরের ঢাকনাটিও একইভাবে তৈরি। প্রথমে বাক্সের নিচে বরফের ছোট খন্ডের স্তর দিয়ে মাছ রাখা হয়। এভাবে এক স্তর মাছ একস্তর বরফ দিয়ে বাক্স ভর্তি করে ঢাকনা আটকিয়ে দিতে হয়। এ পদ্ধতিতে সব ধরনের মাছ ১০-১৫ দিন সংরক্ষণ করা যায়।
বর্তমান প্রচলিত পদ্ধতিতে বাঁশের ঝুড়ি বা অন্য কোন পাত্রে একস্তর বরফ ও একস্তর মাছ সাজিয়ে মুখ আটকিয়ে দেয়া হয়। এতে মাছ ২-৩ দিন সংরক্ষণ থাকে।
৪. হিমায়িতকরণ
এ পদ্ধতিতে মাছের দেহের ভিতরে পানি ও মাংসপেশীকে বরফে পরিণত করে সংরক্ষণ করা হয়। সাধারণত -১৮ ডিগ্রি সে. বা এর নিচে হিমায়িত যন্ত্রের সাহায্যে হিমায়িত করা হয়। সব ধরনের মাছ হিমায়িত করা যায়।
প্রথমে মাছের নাড়িভুঁড়ি, আঁইশ, পাখনা ইত্যাদি অপ্রয়োজনীয় অংশ ফেলে দিয়ে পরিষ্কার পানিতে ধুতে হবে। এরপর ২০-৮০ ভাগ ক্লোরিন পানিতে মাছগুলো ডুবিয়ে রাখতে হবে। মাছ বেশি বড় হলে ছোট টুকরা করা যেতে পারে। টুকরাগুলো ১০-১২ ভাগ সোডিয়াম ট্রাইফসফেট দ্রবণে ১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হয়। এরপর পানি ঝরিয়ে মাছগুলো ফ্রিজের ব্লকের মধ্যে রাখা হয়। হিমাগার বা ফ্রিজের তাপমাত্রা Ñ৩৫০ থেকে Ñ৪০০ সে. রাখতে হয়। মাছ ফ্রিজিং হতে সময় লাগে ৪-৫ ঘণ্টা।
৫. ধূমায়িতকরণ
কাঠ পোড়ানো ধোঁয়া দিয়ে মাছ সংরক্ষণ করা হয়। কাঠ পোড়ানো ধোঁয়ার তাপমাত্রা ও ধোঁয়ার কণা একত্রে মাছের দেহ থেকে পানি শুকিয়ে দেয়। মাছে অপ্রয়োজনীয় অংশ যেমনÑ আঁইশ, পাখনা, লেজ, নাড়িভুঁড়ি ইত্যাদি পরিষ্কার করে পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হয়। এরপর বড় মাছ টুকরা করে ৬০-৭০% লবণ দ্রবণে ১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখা হয়। পানি ঝরিয়ে মাছগুলো ধুম্র ঘরে ঝুলিয়ে রাখা হয়। চিমনির মেঝেতে কাঠের গুঁড়া পুড়িয়ে ধোঁয়ার সৃষ্টি করা হয়। চিমনির বর্হিগমন পথ বন্ধ থাকায় সব ধোঁয়া ঘরের মধ্যে জমা হবে। এতে ঘরে তাপমাত্রা ও ধোঁয়া বাড়ে। এভাবে ১০-১২ ঘণ্টা দূমায়িত করলে মাছের দেহের পানির পরিমাণ ৮০-৮৫% কমে। এরপর ঘর থেকে মাছ বের করে ঠান্ডা করে প্যাকিং করা হয়। এ মাছ ২-৩ সপ্তাহ পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
৬. ক্যানিং বা টিনজাত পদ্ধতি
মাছ প্রক্রিয়াজাত করে বায়ুশূন্য পাত্রে সংরক্ষণ করাই হচ্ছে ক্যানিং। এ পদ্ধতিতে তিন বছর পর্যন্ত মাছ সংরক্ষণ করা যায়। প্রথমে মাছের মাথা, পাখনা, আঁইশ, নাড়িভুঁড়ি অপসারণ করে পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হয়। মাছ টুকরা করা হয়। টুকরা মাছ লবণ পানিতে ধুয়ে নিতে হবে। পুনরায় পরিষ্কার পানিতে ধোয়া হয়। লবণ দ্রবণে মাছের টুকরাগুলোকে সিদ্ধ করে পানি ঝরিয়ে ঠান্ডা করা হয়। এই সিদ্ধ মাছগুলো জীবাণুমুক্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন টিনের কৌটায় স্তরে স্তরে সাজিয়ে রাখতে হবে। প্রতি স্তরে বিভিন্ন রকম মসলা, তেল, সস, লবণ ইত্যাদি দিতে হয়। এভাবে টিনের কৌটা ভর্তি করতে হবে যাতে কোথাও ফাঁকা না থাকে। তবে টিনের কৌটার উপরে ঢাকনার নিচে একটু ফাঁকা রাখতে হবে।
মেশিনের সাহায্যে কৌটাকে বায়ুশূন্য করে মুখ বন্ধ করতে হবে। কৌটার বর্হিভাগের ময়লা সোডিয়াম ফসফেট মিশ্রিত গরম পানি দিয়ে ধুতে হয়। এরপর উচ্চতাপ দিয়ে কৌটার ভিতরে মাছকে জীবাণুমুক্ত করা হয়। এখানে ১২০০ সে. তাপমাত্রায় ৫০-৬০ মিনিট উত্তপ্ত করা হয়। তাপ দেয়া শেষ হলে ঠান্ডা পানি দিয়ে কৌটা ঠান্ডা করতে হবে। এরপর টিনের কৌটার গায়ে লেবেলিং করা হয়। লেবেলিং কাগজে মাছের জাত, ওজন, উৎপাদনের তারিখ, মেয়াদ উর্ত্তীণের তারিখ, কোম্পানির নাম, মাছ ছাড়া অন্যান্য দ্রব্যের নাম ও পরিমাণ উল্লেখ থকবে।
ফরহাদ আহাম্মেদ, কৃষিবিদ ও সহকারী অধ্যাপক।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২৮জুলাই২০