মাটি উদ্ভিদ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য জিংকের প্রয়োজনীয়তা

1268

জিংক মাটি উদ্ভিদ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। উদ্ভিদে জিঙ্কের অপরিহার্যতা ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে আবিষ্কৃত হয়। উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য অপরিহার্য এটি, কারণ সব প্রাণী এবং উদ্ভিদের জৈবিক প্রক্রিয়ায় জিংক বা দস্তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফসলের বিভিন্ন অভাবজনিত উপসর্গের সঙ্গে সঙ্গে, বর্তমানে দস্তার অভাবে মানুষের শরীরে বিভিন্ন রোগব্যাধি দেখা দিচ্ছে। এটি ভিটামিন-এ অভাবের সঙ্গে সঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুপুষ্টি হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। সমগ্র বিশ্বে প্রায় দুই বিলিয়ন মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট জিংক পায় না। ফলে জিংকের অভাবে প্রতি বছর ৮ লাখ মানুষ মারা যান এবং শুধু ডায়রিয়াতেই ১.৫ মিলিয়ন শিশু প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী মারা যায়। জিংকের ঘাটতি বিশেষত শিশুদের মধ্যে ব্যাপক এবং বিশ্বের বহু শিশু মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ। বিশ্বজুড়ে ৪.৫ লাখ শিশু জিংকের অভাবে প্রতি বছর মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে। জিংক ঘাটতির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের প্রায় ৯৩ ভাগ মাটিতে জিংক ঘাটতি আছে। এ দেশের মানুষের খাদ্য এবং পশুর খাদ্যে যে পরিমাণে জিংক থাকার কথা তার চেয়ে কম বিদ্যমান। ফলে এদেশের ৫৫ ভাগ মানুষ জিংক ঘাটতিতে ভূগছে। জিংক ঘাটতির কারণে ৫০ ভাগ (৫ বছরের নিচে) শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি কম হচ্ছে। মৃত্তিকায় অভাব থাকলে খাদ্যে এর প্রাপ্যতা কমে যায় ফলে প্রাণী তথা মানব দেহেও অভাবজনিত উপসর্গ দেখা দেয়।

মানবদেহে দস্তার প্রয়োজনীয়তা

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও খাদ্য ও কৃষি সংগঠন (২০০৪) এর মতে, প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির শরীরে ওজন অনুসারে ১০-১৪সম জিংক থাকা বাঞ্ছনীয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক ১২-১৪ মিলিগ্রাম জিংক প্রয়োজন। উদ্ভিদের ভোগ্যঅংশে জিংক এর অভাবজনিত কারণে মানুষের বৃদ্ধি (বিশেষ করে শিশুদের) ব্যাহত হয়। এর অভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, প্রজননে সমস্যা সৃষ্টি হয়, মানুষের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বৃদ্ধিও বাধাগ্রস্ত হয়। দস্তার অভাব তীব্রতর হলে মানব দেহে গুরুতর উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যেমন- অস্থি সন্ধিতে ব্যথা, অকালে সন্তান প্রসব (অপরিপক্ব শিশু জন্ম), যকৃত বা কিডনি রোগ, ডায়াবেটিস, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল রোগ। যারা বিপুল পরিমাণ আয়রন গ্রহণ করে তাদেরও ঝুঁকি রয়েছে। যদিও লক্ষণগুলো পরিবর্তিত হতে পারে, তবে প্রায়ই লক্ষণগুলো জিংকের অভাবের সাথে সম্পর্কিত। যেমন-দুর্বল স্মৃতিশক্তি, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (ইমিউন সিস্টেম), দীর্ঘস্থায়ী ঠান্ডা, খাবারে স্বাদহীনতা বা গন্ধহীনতা, ঘুমের সমস্যা (বিঘিœত ঘুম), প্রয়োজনীয় মেলাটোনিনের অভাব, চুল পরা, ক্ষুধা মান্দ্য, কম কর্মশক্তি, ডায়রিয়া, ক্ষত নিরাময়ে ধীরতা, নখের ওপর সাদা দাগ ( হোয়াইট স্পট) এবং গুরুতর ক্ষেত্রে শিশুদের বৃদ্ধি রোধ ইত্যাদি।

উদ্ভিদ দেহে দস্তার ভূমিকা

উদ্ভিদ দেহে জিঙ্কের স্বাভাবিক ঘনত্ব ২৫-১৫০%। ২০%-১ ঘনত্বের নিচে দস্তা ঘনত্ব পাওয়া গেলে ওই উদ্ভিদ দস্তা অভাবে ভুগছে বলে যায়। জিঙ্ক উদ্ভিদের বিপাকীয় কার্যক্রমের জন্য একটি অপরিহার্য মাইক্রোনিউট্রেন্ট যা ৩০০ টিরও বেশি এনজাইমের অনুঘটকের/প্রভাবকের কাজ করে। সব প্রকারের জীবনের অপরিহার্য এই গৌণ খনিজ পদার্থটি জিন প্রকাশ, কোষ উন্নয়ন ও সংখ্যা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। আপনার শিশুর মতো আপনার ভালো ফসলটিও মুখ্য পুষ্টি উপাদানের পাশাপাশি অত্যাবশকীয় গৌণ পুষ্টি উপাদান চায়। জিংক তেমন একটি অত্যাবশকীয় গৌণ পুষ্টি উপাদান। এই উপাদানটি এনজাইম এক্টিভেশন যেমন আরএনএ পলিমারেস, সুপারঅক্সিড ডিসমিউটেজ, এলকোহল ডিহাইড্রোজিনাজ, কার্বনিক আনহাইডরেজ, প্রোটিন সংশ্লেষণ, কার্বোহাইড্রেড, লিপিড, নিউক্লিক এসিড বিপাক ও ক্লোরোপ্লাস্ট তৈরিতে সাহায্য করে। জিংক প্রজনন প্রক্রিয়ায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর অভাবে ফসলের ফলন কমে যায় এবং তীব্র ক্ষেত্রে ফসল মারা যায়, যা প্রায় ৩০ ভাগ ফলন কমিয়ে দেয়।

মৃত্তিকায় দস্তা ঘাটতির কারণ

অতিরিক্ত মাত্রায় ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি সার ব্যবহার করা এবং দস্তা সার ব্যবহার না করা। মাটিতে অধিক মাত্রায় ফসফরাস উপস্থিতি দস্তার অভাব ঘটাতে পারে যা অদ্রবণীয় দস্তা-ফসফেট গঠন করে। সারা বছরব্যাপী উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল চাষ করা। মাটিতে অধিক চুন দেওয়া। দস্তা ঘাটতির প্রতি সংবেদনশীল জাত চাষ করা। মৃত্তিকার উপরের স্তর অপসারণ। ফসলের অবশিষ্টাংশ জমি থেকে তুলে নেয়া, জমিতে বিশ্রাম না দেয়া, আবার উদ্ভিদ দেহে অত্যধিক মাত্রায় ফসফরাস থাকলে দস্তার চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়, ফলে উদ্ভিদ মূলে দস্তা ঘনত্ব বৃদ্ধি পায় অন্যদিকে শীর্ষ অঞ্চলে ঘাটতি দেখা দেয়।

দস্তা সারের প্রতি সাড়াপ্রদানকারী ফসল

শুকনো ভোজ্য মটরশুটি, ভুট্টা, পেঁয়াজ, জোয়ার, মরিচ এবং ভুট্টা দস্তা সারের প্রতি সবচেয়ে সংবেদনশীল ফসল। ভুট্টা উচ্চ মাত্রায় দস্তা ঘাটতির প্রতি সাড়া প্রধান করলেও, আলু, ধান, তুলা ও গম মধ্যম মাত্রায় সাড়া প্রদান করে। তৈল ও ডাল জাতীয় ফসলও মধ্যম মাত্রায় সাড়া প্রদান করে। সবজি জাতীয় ফসলের মধ্যে টমেটো, পালং ও লেটুস মধ্যম মাত্রায় সাড়া প্রধান করে। লেবু জাতীয় ফসলের জন্য দস্তা ঘাটতি একটি বৃদ্ধি প্রতিবন্ধক কারণ এই ফসল উচ্চ মাত্রায় দস্তা ঘাটতির প্রতি সংবেদনশীল।

ফসলে দস্তার জৈব সমৃদ্ধকরণ

দস্তা জৈবসমৃদ্ধকরণের লক্ষ্য হচ্ছে এমন ফসল তৈরি করা যাদের ভোজ্য অংশগুলোতে পুষ্টি উপাদানটি সহজলভ্য হবে। দানাশস্য বিশ্বের জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশের জন্য প্রধান প্রধান খাদ্য হিসেবে কাজ করে কিন্তু এইসব দানাশস্যের ক্রটি হলো দস্তা এবং অন্যান্য অপরিহার্য পুষ্টি উপাদানগুলো কম বিদ্যমান। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায় যে, প্রজনন পদ্ধতির দ্বারা দানাফসল যেমন চাল ও গম দস্তা সমৃদ্ধকরণ করলে ভারতবর্ষে প্রতি বছর ৪৮ হাজার শিশুর জীবন বাঁচানো সম্ভব। প্রজনন পদ্ধতির মাধ্যমে উচ্চ সমৃদ্ধ নতুন দানাশস্য তৈরি/উৎপাদন উচ্চ দস্তা ঘাটতি সমস্যা মোকাবেলার সবচেয়ে বাস্তবসম্মত এবং খরচ-সাশ্রয়ী কার্যকর কৌশল। যাই হোক, এই কৌশলটি একটি দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি এবং মৃত্তিকার দস্তা পুল এখানেও নতুন উদ্ভাবিত জাতের দস্তা সংকলনের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে/কমিয়ে দিতে পারে। অতএব, দস্তা সার প্রয়োগ করে ফসল দস্তা সমৃদ্ধ (বায়োফর্টিফিকেশন) করা একটি দ্রুত এবং কার্যকর পদ্ধতি।

দস্তা সার প্রয়োগ পদ্ধতি

দস্তা মৃত্তিকা বীজ এবং পাতা অথবা দস্তা সার দ্রবণে চারা ডুবিয়ে প্রয়োগ করা যায়। সাধারণত, ফসলে প্রয়োগ করা দস্তা মূল বা পাতার মাধ্যমে শোষণ করে কিন্তু ফসলে দস্তা ঘনত্ব মূলত শিকড়ে প্রয়োগ করা দস্তা থেকেই হয়। পাতায় ০.৫-২.০% দ্রবণ প্রয়োগ মৃত্তিকায় দস্তা প্রয়োগের পরিপূূরক হতে পারে। বীজের উপরে দস্তা দিয়ে আবরণ তৈরি করে ২-৪% তরলে চারা ডুবিয়ে দস্তা প্রয়োগ মৃত্তিকায় দস্তা প্রয়োগের পরিপূরক হতে পারে। ফসল দানায় দস্তা আহরণে পাতায় দস্তা প্রয়োগ মাটিতে দস্তা প্রয়োগের চেয়ে বেশি কার্যকর। অন্যদিকে, শস্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে মাটিতে দস্তা প্রয়োগ বেশি কার্যকরী। এক গবেষণায় দেখা যায়, ফসলের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী মৃত্তিকায় ও পাতায় জিংক প্রয়োগ পদ্ধতি সমন্বিতভাবে এর অভাব দূর করে ফলন বাড়াতে পারে। জলাবদ্ধ ধানী জমি, বিস্তৃত চা ও ফল বাগানে জিংক দ্রবণ পাতায় প্রয়োগে দস্ত্মার অভাব দূর করে ভালো ফলন দিতে পারে। বিশ্বব্যাপী সুষম সার ব্যবহার করে ফসলের ভোগ্য অংশে দস্তাসহ অন্যান্য অনুপুষ্টি বাড়ানো একটি প্রায়োগিক ও কার্যকরী পদক্ষেপ। তাই মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও আন্তর্জাতিক দস্তা প্রতিষ্ঠান (আইজেডও) খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ফসলে দস্তা সার ব্যবহার বৃদ্ধি করা ও ফসলে দস্তা ঘনত্ব বাড়ানো বিষয়ে গবেষণা করছে। এতদিন বাংলাদেশে এই বিষয়ে গবেষণা কেবলমাত্র দস্তা ব্যবহার করে ফসলের ফলন বৃদ্ধির বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এই গবেষণায় দেখা গেছে, মাটির প্রকারভেদে ৬ কেজি পর্যন্ত সার প্রয়োগে দানা জাতীয় ফসল ফলন ও ভোগ্য অংশে দস্তা ঘনত্ব বাড়ে। আবার ৬ কেজি ও ৯ কেজি প্রয়োগের মধ্যে কোন তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য পাওয়া যায় না। কিন্তু ৯ কেজি পর্যন্ত দস্তা সার প্রয়োগ করলে সবজি জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

লেখক: কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন।

ফার্মসএন্ডফার্মার/২৬এপ্রিল২০