মাত্র ১০টি মুরগি থেকে নাটোরের সবচেয়ে বড় পোল্ট্রি ফার্মের মালিক হোসনে আরা

1271

poultry-farmsandfarmer24.com

নাটোর: নাটোরের সফল নারী উদ্যোক্তা হোসনে আরার পোল্ট্রি হ্যাচারিতে জন্ম নেয়া লাখ লাখ বাচ্চা ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। দশ বছরের এ কর্মযজ্ঞে হোসনে আরা তৈরি করতে পেরেছেন অসংখ্য নারী উদ্যোক্তা। এখন তার অনেক দূরে যাওয়ার প্রত্যয়।

নাটোরের রাণী ভবানী রাজবাড়ীর চারপাশের বেষ্টনী লেকের উত্তরে চৌকিরপাড় এলাকায় হোসনে আরা গড়ে তুলেছেন জিশান পোল্ট্রি হ্যাচারি-যা নাটোর জেলার মোট পাঁচটি পোল্ট্রি হ্যাচারির মধ্যে সবচেয়ে বড়।

হ্যাচারির ইনকিউবেটরের স্যাটার অংশের মোট নয়টি কম্পার্টমেন্টে ট্রেতে করে সাজানো হয় লক্ষাধিক ডিম। ৩৭.৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় এখানে ডিমের অবস্থান ১৮ দিন। এর পর ডিমগুলোকে স্থানান্তর করা হয় ইনকিউবেটরের হ্যাচার অংশের ট্রেতে। হ্যাচারে ৩৭.২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তিনদিনে ডিমের খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসে সদ্য জন্ম নেয়া লক্ষ মুরগির বাচ্চা।

হ্যাচারিতে ডিম সরবরাহের জন্যে আছে সাড়ে এগারো হাজার ধারণক্ষমতার দু’টি সোনালি মুরগির খামার। গুণগত মানের ডিম সরবরাহের জন্যে আছে যৌথ উদ্যোগের আরো মুরগির খামার।

হ্যাচারিতে জন্ম নেয়া মুরগির বাচ্চা ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বাঁশের ঝুঁড়ির মধ্যে ডেলিভারি দিতে হয়। নাটোর ছাড়াও রাজশাহী, বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ জেলার খামারীরা এর ক্রেতা।
প্রতিটি বাচ্চার বিক্রি মূল্য ১৮ থেকে ২০ টাকা। খরচ বাদ দিয়ে মুনাফার পরিমাণ মন্দ নয়। নাটোরের সিংড়া উপজেলা বাজার এলাকার ব্যবসায়ী দৌলত হোসেন নান্টু ১৯ টাকা দরে আট হাজার মুরগির বাচ্চা কিনলেন। নান্টু বললেন, এ হ্যাচারির বাচ্চাগুলোর মান ভালো, অসুখ-বিসুখ কম হয়, তাই ঝুঁকি কম। দীর্ঘদিন ধরে আমি নিয়মিত বাচ্চা নিয়ে এলাকার খামারীদের মাঝে সরবরাহ করে আসছি।

হোসনে আরার এ সফলতা একদিনে আসেনি। অক্লান্ত পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে তিনি অর্জন করেছেন এ সমৃদ্ধি। দশ বছর আগে শুরু করেছিলেন পোল্ট্রি হ্যাচারি। তারও দশ বছর আগে পোল্ট্রি খামার।

আলাপচারিতায় হোসনে আরা ফিরে গেলেন দুই দশক আগে। বললেন, সখের বশে মাত্র ১০টা মুরগি পালনের মধ্য দিয়ে শুরু করেছিলাম। এরপর ধাপে ধাপে বাড়িয়েছি মুরগির সংখ্যা। বর্তমানে স্বামী-সন্তানরা হোসনে আরার হ্যাচারির সহযোদ্ধা হিসেবে কাজ করছেন। তবে শুরুতে তাদের মনোভাবছিল নেতিবাচক।

তার স্বামী হাফেজ লুৎফর রহমান জানান, একবার খামার ভেঙেও দিয়েছিলাম! কিন্তু ভেঙে পড়েননি হোসনে আরা। হার না মানার কারণেই দুই দশক পরে স্পর্শ করতে পেরেছেন সমৃদ্ধির মাইলফলক।

বস্ত্র ব্যবসায়ী স্বামীর সংসারে অভাব-অনটন না থাকলেও খুব একটা স্বাচ্ছন্দ ছিল না। চার সন্তানের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হিমসিম অবস্থা। কিন্তু হোসনে আরা মুরগির খামারের পরিধি বাড়িয়েছেন তিল তিল করে। এক সময় হাল ধরেছেন পুরো সংসারের। চার ছেলের মধ্যে বড় ছেলে জিশান আইনে পড়াশুনা শেষ করে মায়ের হ্যাচারি দেখাশোনা করছে, মেজ ছেলে ইমরান বিসিএস নন ক্যাডার সার্ভিসে চাকরি পেয়েছেন, সেজ ছেলে নাঈম পটুয়াখালী প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিতে অনার্স করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ সমাপ্ত করেছে এবং ছোট ছেলে তানভির ওআইসি পরিচালিত আইওটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রিপল ই’তে অনার্স করছে।

আমাদের পড়াশুনার প্রেরণার উৎস আমাদের মমতাময়ী মা বলে জানালেন চার ছেলে। তাই বলা চলে তিনি রত্নগর্ভা।

হোসনে আরা শুধু নিজের ব্যবসায়ের প্রসার ঘটিয়েছেন তা নয়, খামার ও হ্যাচারিতে তৈরি হয়েছে স্থায়ী ও খণ্ডকালীন মিলিয়ে প্রায় ৩০ জনের কর্মসংস্থান। তিনি তৈরি করেছেন অসংখ্য নারী উদ্যোক্তা। ওইসব উদ্যোক্তারা খামার স্থাপন করে তাদের সংসারে স্বাচ্ছন্দ নিয়ে এসেছেন।

এর মধ্যে ঘোড়াগাছা এলাকার খামারী সাজেদা বললেন, হোসনে আরা আপা আমাদের আলোর পথ দেখিয়েছেন, আমরা তার কাছে চির কৃতজ্ঞ।

ন্যাশনাল ব্যাংক নাটোর শাখায় প্রায় একশ নারী উদ্যোক্তার ব্যাংক ঋণের গ্যারান্টার হয়েছেন হোসনে আরা। মাত্র পাঁচ শতাংশ লভ্যাংশে বিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকার দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির ঋণ পেয়েছেন তারা।

ঋণগ্রহীতা মর্জিনা বলেন, আপা গ্যারান্টার হওয়ায় ব্যাংক ঋণ পেয়েছি। ঋণের টাকায় খামার করে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছি।

নাটোর সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. সেলিম উদ্দিন জানান, সততা, অক্লান্ত পরিশ্রম আর অধ্যবসায় হোসনে আরাকে সফলতা দিয়েছে। তিনি আজ নাটোর জেলার সবচেয়ে বড় পোল্ট্রি হ্যাচারির মালিক।
সফলনারী উদ্যোক্তা হিসেবে হোসনে আরার কার্যক্রম সকলের জন্যেই অনুকরনীয় বলে জানালেন জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. বেলাল হোসেন।

নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন হোসনে আরার হ্যাচারি পরিদর্শন করে বলেন, হোসনে আরা শুধু নিজে সফল উদ্যোক্তা নন, অসংখ্য উদ্যোক্তা তৈরি করে যাচ্ছেন তিনি। সকলের আশীর্বাদে তিনি পৌঁছে যাবেন তার অভিষ্ট লক্ষ্যে।

তার লক্ষ্য সম্পর্কে হোসনে আরা বললেন, এখনো অনেক দূরে যেতে হবে। এন্টিবায়োটিকমুক্ত মুরগি পালনে সফলতা অর্জনের চেষ্টা করছি। দেশ ও জাতিকে নিরাপদ মাংস উপহার দেওয়ার পাশাপাশি লক্ষ্য আছে বিদেশে রপ্তানির।বিএসএস

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন