মিরপুরে গমে বাম্পার ফলনের আশা

347

KRISHE-5
ধানের পরেই খাদ্যশস্যের পরের স্থান রয়েছে গম। কুষ্টিয়ায় একসময়ে প্রচুর পরিমানে গম চাষ হতো। তবে ব্লাস্ট রোগের আক্রমন এবং তামাকের দাপটে পিছু হটতে বাধ্য হয় গমের আবাদ। ব্লাস্ট রোগের আক্রমনের ব্যাপক আকারে ক্ষতিগ্রস্থ হয় গম চাষীরা। এর পরেই মুখ ফিরিয়ে নেয় এ গম চাষে। তবে বিগত বছরের তুলনায় এবছর কুষ্টিয়ায় রেকর্ড পরিমান গম চাষ হয়েছে। ২০১৫–১৬ মৌসুমে কুষ্টিয়াসহ যশোর অঞ্চলের ৫ জেলায় (কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, যশোর ও ঝিনাইদহ) মহামারী আকার ধারন করে ছত্রাকজনিত রোগ ব্লাস্ট। পরের মৌসুমে এ ৫ জেলায় গম চাষের নিষেধাজ্ঞা দেয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এরপরেও কয়েকটা কৃষক নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে গম চাষ করে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কৃষকরা প্রায় মুখ ফিরিয়ে নেয় এ গম চাষ থেকে। পরে এসব গম চাষের জমি দখল করে নেয় বিষবৃক্ষ তামাক। তবে এ বছর কৃষি অফিসের পরামর্শে আবারো গম চাষ করছেন কৃষকরা।

অনুকুল আবহাওয়া থাকায় গমও ভালো হয়েছে। তবে এবছর জেলায় কোথাও ব্লাস্টের আক্রমন দেখা দেয়নি। তবে কিছু স্থানে দেখা দিয়েছে মরিচা রোগ। তবে কৃষি অফিসের তৎপরতায় তা মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছেন কৃষকরা। বর্তমানে রোগটি কৃষি বিভাগের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কুষ্টিয়া জেলা শহর থেকে দুরে মেহেরপুর জেলার ও কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা মিরপুর ও দৌলতপুর। কুষ্টিয়ার অনান্য উপজেলার তুলনায় এ উপজেলা দুটিতে ২০১৫ সালে দেখা দেয় ব্লাস্ট রোগ। এর ফলে কমে যায় গমের উৎপাদন। কৃষকরা গম চাষের পরিবর্তে তামাক চাষ শুরু করে। কিন্তু এবছর চিত্রটা পাল্টে গেছে। বিগত দিনের মতো চাষীরা ঝুঁকেছে গম চাষে। কৃষি বিভাগের পরামর্শে তারা গম চাষ করেছেন। কৃষি অফিসের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দ্বিগুন গম চাষ হয়েছে।

মিরপুর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০১৬–১৭ মৌসুমে ব্যাপকহারে গমে ব্লাস্টের আক্রমন হয়। ২০১৭–১৮ মৌসুমে আমরা কৃষকদের গম চাষে নিরুৎসাহিত করি। যার কারনে কৃষকরা অনেকটা ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যায়। ২০১৮–১৯ মৌসুমে মিরপুর উপজেলায় ৪১৩ হেক্টর জমিতে গম চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়। চাষ হয় প্রায় ৬৫০ হেক্টর। চলতি ২০১৯–২০ অর্থবছরে ৬৫০ হেক্টর জমিতে গম চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে। চাষ হয়েছে প্রায় ১৩৫০ হেক্টর।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তদরের দেওয়া তথ্য মতে, ২০১৫–১৬ মৌসুমে কুষ্টিয়া জেলায় ১৬ হাজার ৬শ ৮৮ হেক্টর জমিতে গম চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়। চাষ হয়েছিলো প্রায় ১৬ হাজার ৭শ ১০ হেক্টর। উৎপাদন হয়েছিলো ৫০ হাজার ১৩০ মেট্রিক টন। ২০১৬–১৭ মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ১৩ হাজার ৮৩০ হেক্টর। চাষ হয়েছিলো প্রায় ৪ হাজার ৩৭০ হেক্টর। উৎপাদন হয়েছিলো ১৫ হাজার ৭৩২ মেট্রিকটন। সে বছর ব্লাস্টের আক্রমন দেখা দেয়। এর ফলে ২০১৭–১৮ মৌসুমে কুষ্টিয়া জেলায় গম চাষে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। ২০১৮–১৯ মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ১০ হাজার ৩৬৮ হেক্টর। চাষ হয়েছিলো প্রায় ৯ হাজার ২৯৫ হেক্টর। উৎপাদন হয়েছিলো ৩৬ হাজার ২৫০ মেট্রিকটন। চলতি ২০১৯–২০২০ মৌসুমে জেলায় গম চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ হাজার ২৯৫ হেক্টর জমি। আবাদ হয়েছে ১১ হাজার ৫০৫ হেক্টর, উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে ৩৬ হাজার ৭১৫ মেট্রিকটন। গমের আবাদ ভালো হওয়ায় উৎপাদন বলে আশা করছেন ৪৫ হাজার ৪শ মেট্রিকটন এর উপরে। চলতি মৌসুমে রেকর্ড পরিমান গমের চাষ হয়েছে। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায় ৫ হাজার ৩৮৭ হেক্টর, ভেড়ামারায় ১ হাজার ৬শ হেক্টর, মিরপুরে ১ হাজার ৩৫০ হেক্টর, কুমারখালীতে ১ হাজার ৫৫০ হেক্টর, কুষ্টিয়া সদরে ১ হাজার ১৫০ হেক্টর এবং খোকসা উপজেলায় ৪৬৮ হেক্টর জমিতে।

কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার কচুবাড়ীয়া এলাকার গম চাষী আয়নাল হক জানান, গমে রোগ হওয়ার কারণে কয়েক বছর আগে অনেক ক্ষতি হয়েছিলো। কৃষি অফিসের লোকজন এসে গম চাষ নিষেধ করেছিল। এজন্য গম চাষ করিনি। জমি তামাকের জন্য বর্গা দিয়েছিলাম। কিন্তু এবছর আবারো গম চাষ করতে বলেছে সকলেই তাই গম চাষ করেছি। এবছর বেশ ভালো গম হয়েছে। দুইবছর এই জমিতে গম চাষ বন্ধ করে রেখেছিলাম। এত সুন্দর গম আগে কখনো হয়নি। এবার বেশ ভালো ফলন পাবো বলে আশা করছি।

একই এলাকার কৃষক জুমির আলী জানান, আমি এক বিঘা জমিতে এবছর গমের চাষ করেছি। ব্লাস্ট রোগের আক্রমন হয়নি। তবে পাতায় মরিচা পড়ার মতো দেখা যাচ্ছে।

সদরপুর ইউনিয়নের কাকিলাদহ এলাকার কৃষক কামরুজ্জামান জানান, গত বছর আমার জমিতে তামাক ছিলো। এবছর দেড় বিঘা জমিতে গম চাষ করেছি। গম বেশ ভালো হয়েছে। বিগত বছরের তুলনায় এলাকায় গম চাষ বেড়েছে।

মিরপুর উপজেলার চিথলিয়া এলাকার কৃষক মাজেদুল হক জানান, এবছর আমি ৬ বিঘা জমিতে বারি গম–২৮ এবং বারি গম–৩০ জাতের গম চাষ করেছি। অনান্য বছরের তুলনায় গম খুব ভালো হয়েছে। তবে কিছুদিন আগে গমের পাতার মরিচা রোগ দেখা দেয়।

উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুকেশ রঞ্জন পালের পরামর্শে আমি নাটিভো নামের একটা ছত্রাকনাশক স্প্রে করি। এতে বেশ ভালো ফল পায়। আশা করছি গমে বেশ ভালো লাভ হবে।

দৌলতপুর উপজেলার তারাগুনিয়া এলাকার কৃষক ফরিদ আহম্মেদ জানান, দুই বছর আগে গম চাষ করে রোগে গম নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। এজন্য লোকসান হয়েছিলো। এজন্য পরের বছর আর গম চাষ করিনি। এবার কৃষি অফিসের পরামর্শে আমি এক বিঘা জমিতে গম চাষ করেছি। বেশ ভালো হয়েছে। এবার কোন রোগও হয়নি। আশা করছি গত দুই বছরের লস এবার পুঁশিয়ে যাবে।

ভেড়ামারা উপজেলার ঠাকুর দৌলতপুর এলাকার কৃষক দেলোয়ার হোসেন জানান, ব্লাস্টের কারনে দুই বছর গম করিনি। এবার দুই বিঘা জমিতে গম চাষ করেছি। আগের চেয়ে বেশ ভালো হয়েছে। রোগবলাই লাগেনি। দানাও বেশ ভালো।

মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রমেশ চন্দ্র ঘোষ জানান, এবছর মিরপুর উপজেলায় রেকর্ড পরিমান গমের চাষ হয়েছে। চলতি মৌসুমে ৬৫০ হেক্টর জমিতে গম চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়। কিন্তু মিরপুর উপজেলায় গম চাষ হয়েছে প্রায় ১৩৫০ হেক্টর জমিতে। ২০১৫ সালে এই অঞ্চলে গমে ব্লাস্টের আক্রমন মহামারী আকার ধারন করে। সেসময় কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরবর্তী বছর ২০১৬ সালে আমরা এই এলাকায় গম চাষে নিষেধাজ্ঞা জারি করি। এতে ব্লাস্টের পার্দুভাব কম হয়।

তিনি আরো বলেন, গত বছর থেকে আমরা আবার গম চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি। তারা পূনরায় গম চাষে আগ্রহ দেখিয়ে চাষ করছেন। কিছু কিছু জমিতে স্বল্প পরিমানে গমের পাতায় মরিচা রোগ দেখা দেয়। আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে তা প্রায় নিয়ন্ত্রণ করেছি ফেলেছি। তিনি জানান, এই অঞ্চলের মাটি গম চাষের জন্য উপযুক্ত। আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধী জাতের গম চাষের জন্য পরামর্শ দিচ্ছি।

কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) রঞ্জন কুমার প্রামানিক জানান, এবছর জেলায় গম চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে। আমরা ব্লাস্ট রোগের আক্রমন যাতে না হয় এজন্য কৃষকদের বীজ শোধন করে বপন করিয়েছি। জেলা জুড়ে কোথাও ব্লাস্টের কোন আক্রমন দেখা দেয়নি। এছাড়া এবছর গম চাষের আবহাওয়া অনুকুলে রয়েছে। রোগবলাইও আমাদের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। তিনি বলেন, গম চাষে আমরা কৃষকদের সার, বীজ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করছি। সেই সাথে আমরা আধুনিক উপায়ে গম চাষের জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি।

ফার্মসএন্ডফার্মার/০৭মার্চ২০