মিষ্টি আলুর চাষ করার সহজ পদ্ধতি

51
সংগৃহিত

মিষ্টি আলু বাংলাদেশের একটি অবহেলিত ফসল হলেও গণচীন, পাপুয়া নিউগিনি এবং আফ্রিকার কয়েকটি দেশে এটি মানুষের প্রধান খাদ্য। তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে এটি আলুর চেয়ে বেশি দামে বিক্রয় হয়। মিষ্টি আলুর পুষ্টিগুণ/খাদ্যমান, বাজারদর, সবজি এবং গোখাদ্য হিসেবে এর গুরুত্ব অনেক বেশি। এফএও’র হিসাব অনুযায়ী সারা বিশে-এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল।

মিষ্টি আলুর গাছ একটি লতানো বিরুৎ। বৈজ্ঞানিক নাম Ipomeoa batatas. ইহা Convolvulaceac পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। ইংরেজিতে একে Sweet Potato বলে। গ্রীষ্ম প্রধান জলবায়ুতে এটি দীর্ঘজীবী, একবার লাগালে বছরের পর বছর বেঁচে থাকে। রবি মৌসুমে মিষ্টি আলু চাষ লাভজনক। খরিফ মৌসুমে সবজি/শাক/গোখাদ্য হিসেবে চাষ করা লাভজনক।

জাত : বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা জাতের মিষ্টি আলুর চাষ হয়। স্থানীয় জাতের চেয়ে উন্নত জাতের ফলন অনেক বেশি। তৃপ্তি ও কমলা সুন্দরী জাত দুইটি উচ্চফলনশীল। যার ফলন হেক্টরপ্রতি ৩০-৪০ টন। জাতের কা- বেগুনি, পাতা গাঢ় সবুজ, ফল মূল সাদা, শাঁস হালকা হলুদ। এতে সামান্য পরিমাণ ক্যারোটিন আছে।

লতা/কাটিং প্রাপ্তির জন্য বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা ও কৃষি গবেষণা উপকেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব খামার, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের বিভিন্ন নার্সারিতে যোগাযোগ করতে পারেন।

চাষ পদ্ধতি
স্থান ও মাটি : সারা দিন সূর্যের আলো পড়ে এরকম দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি মিষ্টি আলু চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। নদীর তীরের পলি মাটিতে এ আলু সবচেয়ে ভালো হয়।

কাটিং/লতা লাগানোর সময় : মধ্য অক্টোবর হতে মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত লাগানোর উপর্যুক্ত সময়।
জমি তৈরি : জমি গভীর করে কর্ষণ করা উচিত। এজন্য বার বার চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুর করে বড় ঢেলা ভেঙে দিতে হয়। এতে মিষ্টি আলুর বাড় বাড়তি ভালো হয়।

চারা কাটিং/লতা লাগানো : প্রতি খণ্ড ২৫-৩০ সেমি. লম্বা হওয়া উচিত। আগার খণ্ড (অগ্রীয় কুঁড়িসহ) সবচেয়ে বেশি ফলন দেয়। আগার খণ্ড পাাওয়া গেলে মাঝখানের খণ্ড না লাগানোই উচিত। বেশি বয়স্ক খণ্ড বীজ/কাটিং হিসেবে ব্যবহার বর্জনীয়। মাঝখানের খণ্ড লাগানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে, যাতে গোড়ার দিক মাটিতে পোঁতা হয়।

সারি থেকে সারি ৬০ সেমি., কাটিং থেকে কাটিং ৩০ সেমি. (উন্নত জাতের বেলায়) দূরত্বে লতা রোপণের জন্য প্রতি হেক্টরে কাটিং লাগে- ৫৫,৫৫৫টি, বিঘায় লাগে ৭,৭০৫টি। কাটিংয়ের ২/৩টি আক বা গিঁট মাটির নিচে থাকতে হবে ৩-৪ সেমি. গভীরে সমান্তরালভাবে শুইয়ে দিয়ে উপরের অংশ বাঁকিয়ে খাঁড়া করে দিতে হবে। রোপণের সময় আবহাওয়া শুকনো হলে কয়েকটি পাতা ছাঁটাই করে দিতে হবে। রস না থাকলে কাটিং/চারার গোড়ায় পানি দিতে হবে।

সার প্রয়োগ : আমাদের দেশের অধিকাংশ কৃষকই মিষ্টি আলু চাষে কম পরিমাণ সার প্রয়োগ করেন। কাক্সিক্ষত ফলন পেতে হলে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হবে। সারের মাত্রা হেক্টরপ্রতি গোবর ১০ টন, ইউরিয়া ১৪০ কেজি, টিএসপি ১০০ কেজি ও পটাশ ১৫০ কেজি।
কোন জমিতে সালফার ও দস্তার অভাব থাকলে প্রয়োজনীয় সার ব্যবহার করতে হবে।

পানি সেচ : মিষ্টি আলু হচ্ছে খরা প্রতিরোধ সম্পন্ন ফসল। তাই সাধারণত সেচের কম। প্রয়োজনে সেচ দেয়া যেতে পারে।
পরিচর্যা : মিষ্টি আলুর ক্ষেত লতা দিয়ে পরিপূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আগাছামুক্ত রাখতে হবে।

ফসল : ১৫০ দিনের মাথায় ফসল সংগ্রহ করা হয়। তবে মার্চ মাসের মধ্য ফসল সংগ্রহ করা উচিত। হেচ্কা টান দিয়ে কন্দমূল লতা থেকে লতা আলাদা না করে ধারালো চাকু দিয়ে কেটে সংরক্ষণ করলে রোগাক্রান্ত হবে না।

হেক্টরপ্রতি ফলন : সাধারণ ২০-৫০ টন। তৃপ্তি স্থানভেদে ৮০ টন ফলন হয়। ইহা নির্ভর করে জাত বা চাষ পদ্ধতি, মাটির অবস্থা ও আবহাওয়ার ওপর।

পোকামাকড় ও রোগ : এ আলুর রোগবালাই খুবই কম, উইভিল নামক একটিমাত্র পোকা ছাড়া অন্যান্য পোকা ও রোগ গৌণ। এদের ক্ষতি তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।

কাণ্ড ও কন্দমূলের শাঁস খেতে খেতে সুরঙ্গ/গর্ত করে পোকা থেকে ডিম ও বিষাক্ত পদার্থ বের হয়। যার ফলে আক্রান্ত কন্দমূল খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে। যেখানে বর্ষাকালে প্লাবিত হয় সেখানে এ পোকার উপদ্রব কম। শস্য পর্যায়ে অবলম্বনসহ হেক্টরপ্রতি ৫ কেজি হেপ্টাক্লোর অথবা ১৫ কেজি ফুরাডান প্রয়োগ করলে ভালো ফলনও পাওয়া যায়।

মিষ্টি আলু সংরক্ষণ : এ আলু সংরক্ষণ প্রক্রিয়া অনেকটা গোল আলুর স্থানীয় পদ্ধতির মতোই। ফ্রেস/ক্ষত/কাটাহীন আলু সংরক্ষণ করতে হবে। গুদামে রাখার আগে কন্দমূল ছায়ায় বিছিয়ে লতাপাতা দিয়ে কয়েক দিন ঢেকে রাখলে ভালো হয়।

পুষ্টি মূল্য : ইহা একটি স্টার্চ প্রধান খাদ্য, এজন্য প্রধান খাদ্য চালও গমের বিকল্প হিসেবে খাওয়া চলে। মিষ্টি আলুর পাতা একটি পুষ্টিকর শাক। যা সারা বছর পাওয়া যায়। তাছাড়া মিষ্টি আলু/লতা একটি উৎকৃষ্ট গোখাদ্য। (পুষ্টি উপাদান নিচের ছকে দেখুন)।

ব্যবহার : সিদ্ধ ও পুড়িয়ে খাওয়া যায়। সবজি হিসেবে কন্দমূল, পাতা শাক হিসেবে খাওয়া হয়। পাতলা স্লাইসে সিদ্ধ করে রৌদ্রে শুকিয়ে পরে তেলে ভেজে ক্র্যাকার্স হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বরিশাল এলাকায় চিংড়ি ও ইলিশ মাছ সহযোগে এ তরকারি খুবই জনপ্রিয়। ভর্তা করেও খাওয়া যায়।

আমাদের করণীয় : আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা খাবার খাই দেহ রক্ষার জন্য। রসনা তৃপ্তির জন্য নয়। সুতরাং কৃষক ভাইসহ সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের অবহেলিত ফসলটি চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করতে নিজ দায়িত্ববোধ থেকে আরও এগিয়ে আসতে হবে যাতে আমাদের কৃষক ভাইরা অল্প পুঁজি ও কম ঝুঁকিপূর্ণ মিষ্টি আলু চাষের মাধ্যমে স্থায়ী কৃষিসহ আত্মসামাজিক উন্নয়নে একটি ইতিবাচক ফলাফল রাখতে পারে।