মিষ্টি চায়না কমলা চাষ পদ্ধতি

998

লেবু জাতীয় ফলের মধ্যে কমলা একটি জনপ্রিয় ফল। চায়না মিষ্টি কমলা সুস্বাদু, সুগন্ধি এবং ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ ফল। কমলা গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Citrus reticulate ইংরেজি নাম Mandarin Orange, Mandarin এবং Mandarine । Rutaceae পরিবার এবং Citrus গোত্রের ভুক্ত। কমলা ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল হওয়ায় সর্দিজ্বর ও বমি নিবারক। কমলার শুকানো ছাল অম্লরোগসহ ও শারীরিক দুর্বলতা নিরসনে কাজ করে। কমলা দিয়ে জ্যাম, জেলি, জুস তৈরি করা হয়ে থাকে।
আমরা বাজার থেকে কমলা কেনার পাশাপাশি সুযোগ সুবিধা থাকলে চাইনিজ কমলা চাষ করতে পারি। বাংলাদেশে ব্যাপক চাহিদা থাকায় বাণিজ্যিকভাবে আধুনিক পদ্ধতিতে মিষ্টি চাইনিজ কমলা চাষ করলে আমাদের দেশেও উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পাবে আমদানী নির্ভরতা কমে আসবে। নিচে চাইনিজ কমলার চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

জমি তৈরি:
কমলা চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে এমন জমি যে জমিতে সারাদিন রোদ থাকে, বৃষ্টির পানি জমেনা, বর্ষার পানি উঠেনা। ভালভাবে জমির আগাছা পরিস্কার করতে হবে। সমতল ভুমি হলে দু-থেকে তিনটি চাষ ও মই দিতে হবে এবং পাহাড়ি জমি হলে কোদালের মাধ্যমে জমি তৈরি করে নিতে হবে।

জমি তৈরি হয়ে গেলে উভয় দিকে ১২ ফিট দুরত্বে ৬০x৬০x৬০ সে.মি আকারে গর্ত তৈরি করতে হবে। বর্ষার আগে গর্ত মাটি দিয়ে ভরাট করে রাখতে হবে। প্রতি গর্তে ১০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম করে ইউরিয়া, এমওপি, ও টিএসপি এবং ৫০০গ্রাম চুন দিতে হবে। চারা রোপন করার ১৫ থেকে ২০ দিন আগে সার প্রয়োগ করতে হবে।

চারা তৈরি পদ্ধতি:
বীজ ও কলমের মাধ্যমে কমলার বংশবিস্তার হয়/চারা পাওয়া যায়। কলমের চারার জন্য যৌন ও অযৌন পদ্ধতির মাধ্যমে বংশ বিস্তার করা হয়। কমলার একটি বীজ থেকে একাধিক চারা পাওয়া যায়। তবে বীজের চারা আমাদের দেশের আবহাওয়া ও মাটির সাথে সমন্বয় করে বেশি দিন বাচতে পারে না।

বীজ থেকে গাছ হলেও ফল দিতে অনেক দেরি করে থাকে। ফল আকারে ছোট ও টক স্বাদের হয়ে থাকে। তাই কলমের মাধ্যমে চারা তৈরি করা উত্তম। তুলনামুলকভাবে অযৌন সতেজ ও মোটা চারায় গুটি কলম, জোড়া কলম, চোখ কলমের মাধ্যমে অযৌন চারা উৎপাদন করা যায়।

এছাড়া কলমের মাধ্যমে চাড়া উৎপাদন করলে চারা গুলো সবল ও মাতৃগাছের গুনাগুন বজায় থাকে চারা গাছে দ্রুত ফল ধরে। এছাড়া রোগ প্রতিরোধী ও বেশি শিকড় সমৃদ্ধ জোড়ের মাধ্যমে কলম করলে গাছের জীবন কাল ও ফলন অধিক হারে বৃদ্ধিপায়। কমলা চাষের জন্য অযৌন চারাই উত্তম।

চারা রোপণ পদ্ধতি:
চারা রোপণের সময় প্রতি গর্তে ১২-১৫ দিন আগে নির্ধারিত হারে সার মাটির সাথে কোদাল দিয়ে ভালভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। কমলার চারা রোপণের জন্য মে থেকে জুন মাস উপযুক্ত সময়। তবে সেচের ব্যবস্থা থাকলে সারা বছর কমলার চারা রোপণ করা যেতে পারে। লক্ষ্য রাখতে হবে যে চারাটি যেন গর্তের মাঝ খানে থাকে। কলমের চারার গেড়ার মাটি যেন সামান্য উঁচু থাকে সে দিকে খেয়াল রাখা উচিত।

সঠিক পরিচর্যা :
চারা অবস্থায় কমলা গাছের বিশেষ যত্ন নিতে হবে। চারা গাছ রোপণের পর যখন নতুন পাতা গজাবে তখন বুঝতে হবে চারা গাছের খাদ্য দিতে হবে। অল্প অল্প করে টিএসপি, এমওপি, ইউরিয়া সার গাছ প্রতি ৫০ গ্রাম দিতে হবে। চারা রোপনের বয়স যখন ৬ মাস হবে তখন জৈব সার দিতে হবে। বাগানের মাটি কুপিয়ে আগলা করে দিতে হবে ।
গোড়া থেকে জন্মানো অতিরিক্ত শাখা গজানোর সাথে সাথে কেটে ফেলতে হবে। চারা গাছের নিচের দিকে ছেটে রাখতে হবে। দেড় ফুট উপর থেকে কান্ডের উৎপাদনশীল শাখা বাড়তে দিতে হবে। গাছে মরা ও রোগাক্রান্ত ডালপালা ছেটে দিতে হবে। গাছের গঠন ছোট থেকে সুন্দর ও শক্ত করে তুলতে হবে। কমলা গাছের উপরের দিকের ডাল-পালা কেটে দিয়ে গাছ ঝাপড়া করতে হবে। এতে করে চাইনিজ কমলা গাছে বেশি ফল আসবে ফলনও বেশি পাওয়া যাবে।
আগাছা থাকলে গাছের বেশ ক্ষতি হয়ে থাকে। গাছের গোড়ায় যেন আগাছা জন্মাতে না পারে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। গাছের উপর পরগাছা থাকলে তা পরিস্কার করতে হবে।

রোগ-বালাই ও প্রতিকার
মাছি পোকা:-
এ পোকা ফল ছোট অবস্থায় ফলের ভিতরে হূল ঢুকিয়ে ডিম পাড়ে। এতে করে ফল নষ্ট হয়ে যায়। মাছি পোকা দমনের জন্য সেক্স ফেরোমন ব্যবহার করলে সব থেকে ভাল উপকার পাওয়া যায়।

পাতা ছিদ্রকারী পোকা:-
এ পোকা পাতার নিচে আকা বাকা দাগের সৃষ্টি করে থাকে। এর আক্রমণে পাতা কুঁকড়ে যায় ও গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। ১০ মিলি মেটাসিস্টক্স ১০ লিটার পানিতে ৪ চা চামচ মিশিয়ে স্প্রে করলে প্রতিকার পাওয়া যায়।

বাকল ছিদ্রকারী পোকা:-
এ পোকা বাকলের মাঝে ঢুকে খেতে থাকে এবং আক্রান্ত বাকল শুকিয়ে ডাল বা কান্ড মারা যায়। রিপকর্ড ১০ ইসি কীটনাশক ১০ লিটার পানিতে ২ চা চামচ মিশিয়ে স্প্রে করলে প্রতিকার পাওয়া যায়।
কমলা গান্ধী পোকা:-
কমলা গান্ধী পোকা ফলের গায়ে ছিদ্র করে ফলের রস চুষে খায়। ছিদ্রস্থানে হলদে রং ধারণ করে ফর ঝরে পড়ে। ম্যালাথিয়ন ০.০৪% অথবা সুমিথিয়ন ৫০ইসি ১০ লিটার পানিতে ৫ চা চামচ মিশিয়ে স্প্রে করলে প্রতিকার পাওয়া যায়।

গ্রীনিং:-
গ্রীনিং রোগাক্রান্ত গাছের পাতা হলুদ রং ধারণ করে। শিরা দুর্বল হয়ে পাতা কিছুটা কোকড়ানো ও ছোট হয়ে সংখ্যা কমতে থাকে। এ রোগ সাইলিড নামক পোকা থেকে সংক্রমিত হয়। নগস ১০০ইসি ১০ লিটার পানিতে ৪ চা চামচ মিশিয়ে স্প্রে করলে প্রতিকার পাওয়া যায়।
কিভাবে গাছে সেচ দিবেন
শুষ্ক মৌসুমে বা খরার সময় নিয়মিত কমলা গাছে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। ফল পরিপক্ক হওয়ার সময় সেচ দিলে কমলা আকারে বড় ও রসালো হয়ে থাকে। বর্ষাকালে গাছের গোড়ায় যেন পানি জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কমলাগাছের গোড়ায় পানি জমে থাকলে মাটি বাহিত রোগ দেখা দিতে পারে।

ফল সংগ্রহের সঠিক সময়
চাইনিজ মিষ্টি কমলা পরিপক্ক হওয়ার সাথে সাথে রং বদলাতে শুরু করে। রং যখন হলদে লাল হয়ে যায় তখন ফল পাকে। গাছে চাইনিজ মিষ্টি কমলা ভালভাবে পাকার পর সংগ্রহ করলে ফল মিষ্টি ও সুস্বাদু হয়।

ফলন
চাইনিজ কমলা দু-বছর বয়স থেকে গাছে ফুল আসতে থাকে। প্রথম বার ফুল আসা থেকেই গাছে ফল ধরে থাকে। ফল পরিপক্ক হতে সময় লাগে ৬ মাস। গাছের বয়স যখন আড়াই বছর হয় তখন একটা গাছ থেকে ৪০-৪৫ কেজি ফল পাওয়া যায়। এবং প্রতি বছর ফলন বাড়তে থাকে। একটি পূর্ণ বয়স্ক কমলা গাছ থেকে ৮০-১০০ কেজি পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। বেশি বয়স্ক একটি গাছ থেকে ২০০-২৫০ কেজি পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। একটি গাছ সাধারণত ৫০ থেকে ৭০ বছর পর্যন্ত ফল দিয়ে থাকে।

কমলা বাগানে সাথী ফসল আবাদ
কমলার বাগানে ৪-৫ বৎসর পর্যন্ত সাথী ফসলের চাষ করা যায়। সাথী ফসল আবাদ করে কমলার বাগান থেকে অতিরিক্ত আয় করা যায়। এতে কমলা চাষে ফলনের কোন ক্ষতি হয় না। নিয়মিত কমলার বাগান পরিচর্যার কারণে রোগ বালাইয়ের আক্রমণ কম হয়। সাথী ফসল হিসাবে কমলার বাগানে শাক-সবজি, তৈল ও ডাল জাতীয় ফসলের আবাদ করা যায়। আবার অনেক চাষীরা চাইনিজ কমলা চাষের সাথে সাথী ফসল হিসাবে বারমাসি পেয়ারা চাষ করে থাকেন। এতে করে একজন চাষী বেশি লাভবান হয়ে থাকে।

মিষ্টি চাইনিজ কমলা চাষ করে একজন চাষী একদিকে নিজের কর্মসংস্থান তৈরি হবে। চাষী অন্যসব ফসল থেকে কমলা চাষ করে বেশি মুনাফা আয় করতে পারবে। বেকার সম্যসার সমাধান ও অন্যদের কর্মসংস্থানের জন্য বাণিজ্যিকভাবে চাইনিজ কমলার চাষাবাদ করা যেতে পারে।

ফার্মসএন্ডফার্মার/০৬ফেব্রুয়ারি২০২১