মুরগির ভাইরাস জনিত রোগ

3085

মুরগি পালন করতে হলে সর্ব প্রথম মুরগির রোগ সম্পর্কে জানতে হবে। তাই চলুন জেনে আসি মুরগির ভাইরাস জনিত রোগ কি কি ও মুরগির ভাইরাস রোগ সমূহ সম্পর্কে। তাহলে চলুন প্রথমে জেনে আসি ভাইরাস কী? সেই সম্পর্কে। তার পর জানব মুরগির ভাইরাস রোগ সম্পর্কে।

ভাইরাস হল এক প্রকার ক্ষুদ্র জৈব কণা বা মাইক্রো অর্গানিজম যা কেবল জীবন্ত কোষের অভ্যন্তরেই শুধু বংশবৃদ্ধি করতে পারে। এরা হ’ল সহজ জীব।ভাইরাস জৈব রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে গঠিত। উপযুক্ত পোষক দেহের অভ্যন্তরে জৈব রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করে সংখ্যা বৃদ্ধি করতে সক্ষম।

এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য সমস্ত ভাইরাসে বিদ্যমান। অতএব, ভাইরাসটি এক ধরণের জীব হিসাবে বিবেচিত হয়। মানুষ, প্রাণী, পাখি এবং গাছপালার বিভিন্ন রোগের জন্য ভাইরাস দায়ী। আসলে, কিছু ভাইরাস ব্যাকটিরিওফেজস ব্যাকটিরিয়াতে পুনরুত্পাদন করে।

ভাইরাস জনিত রোগের নাম সমূহ

রানীক্ষেত

রানীক্ষেত রোগ হচ্ছে ভাইরাস থেকে সৃষ্টি মারাত্বক সংক্রামক রোগ। রানীক্ষেত মোরগ-মুরগি ভাইরাস জনিত একটি মারাত্মক রোগ। সমস্ত বয়সের মুরগির এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এই রোগটি সর্বপ্রথম দেখা গিয়েছিল ইংল্যান্ডের নিউক্যাসলে নামক শহরে। এই রোগটি বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি খামারে দেখা যায় । এ রোগে আক্রান্ত হলে প্রায় সব মোরগ মুরগি মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে কিন্তু বাচ্চা মুরগি আক্রান্ত হলে প্রায় ১০০% মৃত্যু হয়ে থাকে।

রোগের লক্ষণ

হাঁচি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, গলায় ঘড়ঘড় শব্দ এই রোগের প্রথম লক্ষণ । শ্বাসতন্ত্র এবং স্নায়ুতন্ত্র গুলি বিশেষত ক্ষতিগ্রস্থ হয়। শ্বাস প্রশ্বাসের সংক্রমণ হওয়ার কারণে শ্বাসকষ্ট হয়ে থাকে। স্নায়ুতন্ত্রের আক্রমণের কারণে পরবর্তী তে প্যারালাইসিস হয়ে থাকে। ঘাড়, ডানা এবং পা অসাড় হয়ে যায়। মুরগি গুলা সাদা চুনের মত মল ত্যাগ করে। কিছু রানীক্ষেত রোগাক্রান্ত মুরগী অস্থির হয়ে পড়ে । মুরগি গুলা খাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং মাথা নিচের দিকে ঝুকেদেয় বা লুকিয়ে রাখে । রানীক্ষেত রোগ তীব্র প্রকৃতির হলে হঠাৎ মৃত্যু বরণ করে।

পল্টি মুরগির ভাইরাস রোগ

গামবোরো: গামবোরো রোগ হচ্ছে ভাইরাস থেকে সৃষ্ট মারাত্বক সংক্রামক রোগ । গামবোরো রোগ মোরগ-মুরগি ভাইরাস জনিত একটি মারাত্মক রোগ। সমস্ত বয়সের মুরগির এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। মুরগি শরীরের রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। সাধারণত ২ থেকে ৭ সপ্তাহ বয়সী বাচ্চাদের এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। এই রোগটি বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি খামারে দেখা যায় । বাচ্চা মুরগি আক্রান্ত হলে প্রায় মৃত্যুহার ৪০-৬০% হতে পারে।

রোগের লক্ষণ

সংক্রামিত মোরগ-মুরগি গুলির সাদা পাতলা মল ত্যাগ করে থাকে। পায়ুপথ মলদ্বার ভেজা থাকে। মলদ্বারের মুখ ফুলে উঠে। মোরগ-মুরগি তার নিজের মলদ্বার ঠুকাতে থাকে। গোড়ালি এবং সমস্থ অঙ্গগুলি ফুলে উঠে। দেহের পানিশূন্যতা দেখা দেয় এবং তৃষ্ণা বাড়ে। অতি আক্রান্ত মুরগি মৃত্যু বরণ করে ।

বসন্ত রোগ ও রোগের লক্ষণ

বসন্ত রোগ হচ্ছে ভাইরাস থেকে সৃষ্টি মারাত্বক সংক্রামক রোগ। বসন্ত মোরগ-মুরগি ভাইরাস জনিত একটি মারাত্মক রোগ। সমস্ত বয়সের মুরগির এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। বসন্ত রোগে সংক্রামিত মোরগ মুরগির ঝুটি, কানের লতি, চোখ, ঠোঁট ও মুখের ভিতর গুটি , ফোসকা বা পক্স এর মত হয়ে থাকে। এই পক্স বা বসন্ত গুলি সাধারণত শরীরের পালকহীন অংশ গুলিতে ভাল দেখা যায়। বাচ্চারা বয়স্ক মুরগির চেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় এবং এই রোগে মুরগির বাচ্চাদের মৃত্যুর হার বেশি হয়ে থাকে । বয়স্ক মুরগির ডিমের উত্পাদন হ্রাস পায় । এই রোগের কোন চিকিৎসা নাই কিন্তু আক্রান্ত মুরগির মৃত্যুর হার অনেক কম ।

ব্রয়লার মুরগির ভাইরাস

ম্যারেকস্‌: ম্যারেকস্‌ এক প্রকার ভাইরাস জনিত রোগ । এটি ভাইরাস থেকে সৃষ্টি একটি মারাত্মক সংক্রামক রোগ । এই রোগকে প্রায় সময় ফাউল প্যারালাইসিস বলা হয়। সাধারণত বিদেশী জাতের মুরগি এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয় । এটি হলে মুরগি শরীরের রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। সমস্ত বয়সের মুরগির এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে।

রোগের লক্ষণ

ম্যারেকস্ রোগটি বিভিন্ন অঙ্গ গুলির স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে এবং অজ্ঞগুলি অবশ সৃষ্টি করে। পায়ের স্নায়ু গুলিকে অবশ করে দিলে মুরগি গুলা পঙ্গু হয়ে হাঁটে । অনুরূপ ডানার স্নায়ু গুলিকে অবশ করে দিলে মুরগি গুলার ডান নিচের ডিকে ঝুলিয়ে দেই । পেশী গুলি প্রভাবিত হয়ে গেলে মাথাটি নিচু দিকে দেখা যায়। যখন রোগটি দীর্ঘস্থায়ী হয় তখন মুরগির দেহের ওজন হ্রাস পায় এবং ক্ষুধা হ্রাস পায়। ডায়রিয়াও বহুবার দেখা যায়।

ইনফেকসাস ল্যারিংগোট্র্যাকিয়াইটিস

এই রোগের জীবাণু এক প্রকার ভাইরাস।ইনফেকসাস ল্যারিংগোট্র্যাকিয়াইটিস রোগটি ভাইরাস থেকে সৃষ্টি একটি মারাত্মক সংক্রামক প্রকৃতির রোগ। সাধারণত শ্বাসতন্ত্রে এই রোগটি আক্রান্ত হয়। এই রোগটি তীব্র হলে অনেক রিক্স থাকে , তবে মুরগি এই রোগের সূত্রপাতের এক বা দুদিনের মধ্যে শ্বাসরোধ হয়ে মুরগি গুলা মারা যায়।

ইনফেকসাস ল্যারিংগোট্র্যাকিয়াইটিস রোগের লক্ষণ

নাক দিয়ে সর্দি ও মুখ দিয়ে লালা ঝরে । শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত হয় এবং হা করে নিঃশ্বাস নেয় । মাথা নিচু ও চোখ বন্ধ করে ঝিমাতে থাকে । মুরগী দূর্বল হয়ে ঠোঁট ও বুক মাটিতে লাগিয়ে বসে পড়ে । মুরগির শ্বাস নেওয়ার সময় মুরগি শ্বাসকষ্ট অনুভব হয় এবং একটি বড় হা করে নিঃশ্বাস নেই। অন্যদিকে, শ্বাস ছাড়ার সময় মুরগি গুলি মুখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নেই এবং মাথাকে নীচে নামান। চোখ ভিজে থাকে। রক্ত মিশ্রিত শ্লেষ্মা নাক দিয়ে বেরিয়ে আসে। মাথা এবং কানের রং গুলি বেগুনি রঙ্গের দেখা যায়। এ রোগের কার্যকরী কোন চিকিৎসা নাই। রোগটি তীব্র হলে মুরগির অনেক রিক্স থাকে ।

হাঁসের ভাইরাস জনিত রোগ

ডাক প্লেগ

প্লেগ একটি মারাত্মক ভাইরাল সংক্রামক রোগ। প্লেগ নামক এক ধরণের ভাইরাস দ্বারা এই রোগ হয়। এই রোগটি সাধারণত হাঁসদের হয়ে থাকে। সব বয়সী হাঁসের এই রোগ হতে পারে। এই রোগ দেখা দিলে, হাঁস ঝাঁকেঝাঁকে মারা যেতে থাকে । এ রোগে মৃত্যুহার অনেক বেশী হয়ে থাকে।

ডাক প্লেগ রোগের লক্ষণ

হাঁস দাঁড়াতে পারে না। হাঁস সাঁতার কাটতে চায় না, হাঁসের পা অসাড় হয়ে যায়। আক্রান্ত হাঁসের জলের তৃষ্ণা বৃদ্ধি পায় কিন্তু খাবার খাওয়া কমে যায় । পালক গুলি এলোমেলো হয়ে থাকে এবং হাঁস গুলি ডানা ছড়িয়ে দিয়ে থাকে। পাতলা পায়খানা করে। প্রায় সময় পায়খানা গুলি সবুজ এবং হলুদ রং এর হয়। অনেক সময় টয়লেটে রক্ত মিশে যায়। যখন এই রোগের প্রকোপ বেশি হয় , তখন পুরুষ হাঁসের প্রজনন অঙ্গগুলি প্রায়শই বেরিয়ে আসে। অনেক সময় চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়ে। একটি ময়নাতদন্তের মাধ্যমে হাঁসের হৃদয়, যকৃত এবং ডিম্বাশয়ে রক্ত জমাট বেধে থাকে।

ডাক-ভাইরাস হেপাটাইটিস

ডাক-ভাইরাস হেপাটাইটিস একটি মারাত্মক ভাইরাল সংক্রামক রোগ। পিকোরনা ভাইরাস নামক এক প্রকার ভাইরাস দ্বারা এ রোগ সৃষ্ট হয়। এই রোগটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং অল্প সময়ের মধ্যে অনেক হাসেঁর মৃত্যু ঘটে । যকৃত প্রদাহ এ রোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য।

ডাক-ভাইরাস হেপাটাইটিস রোগের লক্ষণ

সাধারণত ১ থেকে ৩ সপ্তাহের বয়সের হাঁসের বাচ্চাদের এই রোগ হয়ে থাকে। প্রায় সময় পায়খানা গুলি সবুজ এবং হলুদ রং এর হয়ে থাকে। একবার আক্রমন হলে খামারে সকল হাঁসের হয়ে থাকে। এই রোগের শতকারা মৃত্যুর হার ৪৫% থেকে ৯৫% হয়ে থাকে।

ফার্মসএন্ডফার্মার/ ২৮ মে ২০২১