মুরগির রক্ত আমাশয়: কার্যকরী প্রতিকার ও প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা

9709

17469_7-3-11_034-620x330

রক্ত আমাশয় বা কক্রিডিওসিস পোল্ট্রি ফার্মে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকর ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি রোগ যা মোরগ-মুরগিতে রোগের সংক্রমণ ও মৃত্যু হার বৃদ্ধি করে, খাদ্যের রুপান্তর হার হ্রাস করে এবং দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে। আমাদের দেশে এ রোগটি এলাকাভেদে মিঠা পায়খানা, ইটা পায়খানা, তালগুড় পায়খানা , কক্রির ইত্যাদি নামে পরিচিত।

কারণ: রক্ত আমাশয় বা কক্রিডিওসিস একটি প্রোটোজোয়াজনিত রোগ। মোরগ মুরগি সাধারণত নিম্নলিখিত ৯ প্রকারের আইমেরিয়া প্রজাতি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। যেমন-আইমেরিয়া টেনেলা, আইমেরিয়া ব্রুনেটি, আইমেরিয়া ম্যাক্রিমা, আইমেরিয়া নেকাট্রিক্র, আইমেরিয়া এসারভুলিনা, আইমেরিয়া মেভেটি, আইমেরিয়া মিটিস, আইমেরিয়া হেগেনি, আইমেরিয়া প্রিকক্র।

এই নয় প্রজাতির আইমেরিয়ার মধ্যে আইমেরিয়া টেনেলা, আইমেরিয়া ব্রুনেটি ও আইমেরিয়া ম্যাক্রিমা এই তিন প্রকারের প্রজাতির আইমেরিয়ার প্রকোপই সবচেয়ে বেশি এবং মারাত্মক। এছাড়া আইমেরিয়া নেকাট্রিক্র, আইমেরিয়া এসারভুলিনা ও অন্যান্য প্রজাতি দ্বারা আক্রান্ত হতে ও দেখে যায়, যার ফলে প্রচুর পরিমাণে ডায়রিয়া হয়।

এপিডিমিওলজি:

গৃহপালিত প্রায় সব প্রজাতির পাখিই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সাধারণত অল্প ও বাড়ন্ত বয়সের মুরগি (৪-৬ সপ্তাহ ) এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। ধারণা করা হয়, বয়স্ক মুরগি এ রোগে আক্রান্ত হয় না। কিন্তু মুক্তভাবে পালিত বয়স্ক মুরগি ছোটদের মতো সমভাবে সংবেনশীল হয়ে থাকে।

সাধারণত ২-১৬ সপ্তাহ বয়সে এ রোগে আক্রন্তের হার বেশি, তবে বেশি বয়সে ও দেখা যায়। দেখা গেছে, সাধারণত ১-২ সপ্তাহ বয়সের বাচ্চাতে এ রোগ হয় না। রক্ত আমাশয়ের আক্রমণের তীব্রতা নির্ভর করে খামারে বিদ্যমান কক্রিডিয়ার ডিমের সংখ্যার ওপর এবং কি পরিমাণ ডিম মোরগ মুরগি খায় তার ওপর। স্পোরুলেটেড ওসিস্ট ভক্ষণ করলে মুরগি এ রোগে আক্রান্ত হযে থাকে। তবে একসাথে এ ধরনের কতগুলো ওসিস্ট ভক্ষণ করেছে তার ওপর রোগের তীব্রতা পরিলক্ষিত হয়। সারা বছরই এ রোগটি দেখা যায় তবে বর্ষাকালে এর প্রার্দুভাব বেশি হয়।

রক্ত আমাশয়ের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি:

খামারীর অর্থনৈতিক ক্ষতির বিবেচনায় মারাত্মক রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম। সারাবিশ্বে প্রতি বছর এ রোগের কারণে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় তিন হাজার ছয়শ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭০% ক্ষতি হয় সাব ক্লিনিক্যাল কক্রিডিওসিসের কারণে। যদিও আমাদের দেশে অর্থনৈতিক ক্ষতির মানদণ্ডে এখনও পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য গবেষণা হয়নি কিন্তু পার্শ্ববতী দেশ ভারতে করা গবেষণায় দেখা যায়-

বাণিজ্যিক ব্রয়লারে ৯৫.৬১% অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ কক্রিডিওসিস। সব ধরনের পোল্ট্রির ক্ষেত্রে দৈহিক ওজন ৬৮.০৮% কমে যায় এবং এফসিআর ২২.৭০% বেড়ে যায়।

সারাবিশ্বে কক্রিডিওসিসের কারণে ৬-১০% ব্রয়লার মুরগির মৃত্যু ঘটে। বাংলাদেশের খামারে পালিত ৫৪.১৮% ও মুক্তভাবে পালিত ৪৯.৪৫% মুরগির পায়খানায় কক্রিডিওসিস রোগের জীবাণু সনাক্তকরা হয়েছে। (পোল্ট্রি পালন ও চিকিৎসা, ডা. এম এ সামাদ)

রোগের বিস্তার পদ্ধতি:

স্পোরোলেটেড (sporulated) ওসিস্ট খেয়ে মোরগ-মুরগী কক্রিডিওসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এখানেই এর জীবন চক্রের শুরু, যা শেষ হয় আনস্পোরোলেটেড (unsporulated) ওসিস্ট তৈরি হয়ে তা পায়খানার সাথে বেরিয়ে আসার মাধ্যমে। এর মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন ঘটে থাকে। মুরগি ওসিস্ট খেয়ে আক্রান্ত হলেও ওসিস্ট কিন্তু রোগ সৃষ্টিকারী মূল জীবাণু নয়। রোগ সৃষ্টি করে স্পোরোজোয়েট যা স্পোরোসিস্ট নামক এক প্রকার থলের ভেতরে থাকে এবং এ দুটোই বাইরে থেকে শক্ত দুটি দেয়াল দিয়ে আবৃত থাকে। বাইরের প্রতিকুল পরিবেশ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্যই এ ব্যবস্থা।

একটি আইমেরিয়া ওসিস্টের ভেতরে চারটি স্পোরোসিস্ট থাকে, যার প্রতিটির মধ্যে আবার দুটো করে স্পোরোজোয়েট থাকে । অর্থাৎ একটি ওসিস্ট খেয়ে একটি মুরগি আটটি রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু পেয়ে থাকে। ওসিস্ট যখন মুরগি থেকে পাতলা পায়খানার সাথে বেরিয়ে আসে তখন কিন্তু এর ভেতর স্পোরোসিস্ট বা স্পোরোজোয়েট কোনটাই থাকে না।

সাধারণত দুই থেকে আট সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত মুরগির বাচ্চা কক্রিডিওসিস বা রক্ত আমাশয় রোগে আক্রান্ত হয়। তবে এ সময় কালের মধ্যে রক্ত আমাশয় না হলে বাকি জীবনের পরবর্তী যেকোনো সময় কক্রিডিয়ার সংস্পর্শে এলে এবং তা খেয়ে ফেললে রক্ত আমাশয় রোগ সৃষ্টি হতে পারে। কোন একটি প্রজাতি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে রক্ত আমাশয় হলে মোরগ-মুরগি সেই প্রজাতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্তি অর্জন করে কিন্তু অন্য প্রজাতির প্রতি সংবেদনশীল থাকে। ফলে অন্য প্রজাতির আইমেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মোরগ মুরগির রক্ত আমাশয় হতে পারে।

প্রতিটি প্রজাতির আইমেরিয়া মোরগ-মুরগির পরিপাকতন্ত্রের নির্দিষ্ট স্থানে আক্রমণ করে। কখনই তাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যস্থল ছেড়ে অন্য স্থানে আক্রমণ করে না। যেমন টেনেলা সিকামে, ব্রনেটি বৃহদন্তে এবং এসারভুলিনা ডিওডেনামে আক্রমণ করে। টেনেলা কখনই ডিওডেনামকে এবং এসারভুন্ডলিনা সিকামকে আক্রমণ করে না।

মুরগির রক্ত আমাশয় :

বাহ্যিক লক্ষণ: মোরগ-মুরগির কক্রিডিওসিস রোগের প্রধান লক্ষণ আন্ত্রিক প্রদাহ। রক্ত ও আমমিশ্রিত পায়খানা অথবা ডায়রিয়া দেখা যায়। পালক উষ্কোখুষ্কো ও ঝুটি ফ্যাকাশে হয়। যেহেতু অন্ত্রনালী প্রধান লক্ষ্যস্থল তাই আক্রান্ত মোরগ মুরগি খাদ্য ও পানি কম খায়। খাদ্য গজম হয় না ফলে দৈহিক ওজন হ্রাস পায়, দুর্বল হয়ে পড়ে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। আক্রান্ত মোরগ-মুরগি এক জায়গায় জড়ো হয়ে থাকে। আক্রান্ত মোরগ-মুরগির দেহ গোল হয়ে বলের আকার নেয়। সাব ক্লিনিক্যাল অবস্থায় কক্রিডিওসিস হলে পেট ব্যথার কারণে আক্রান্ত মোরগ-মুরগি ঠোকরা ঠুকরি করে, অস্থির অবস্থা বিরাজ করে। সাধারণত আইমেরিয় টেনেলা খুবই ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচিত যা মোরগ মুরগির সিকামে থাকে, রক্তক্ষরণ হয় এবং মৃত্যু হার বৃদ্ধি করে। অন্যান্য আইমেরিয়াপ্রজাতিগুল বেশি ক্ষতিকর না হলে ও অন্ত্রের এপিথেলিয়াল কোষ ধ্বংস করে এবং পরবর্তীতে কলস্ট্রিডিয়াম নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে নেক্রোটিক এন্টারাইটিস নামক রোগ সৃষ্টি করে ।

প্রতিরোধ:

খামারে মোরগ মুরগির কক্রিডিওসিস বা রক্ত আমাশয় প্রতিরোধ করা সম্ভব এবং প্রত্যেক খামারীকেই সে চেষ্টা করা উচিত। কারণ খামারে কক্রিডিওসিস রোগের প্রাদুর্ভাব হলে সে খামারে এ রোগের পুনরায় প্রাদুর্ভাবের সম্ভাবনা থাকে। রক্ত আমাশয় পুনরায় প্রতিরোধে সঠিক ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বদ্ধ খামারে পালিত মোরগ-মুরগিতে কক্রিডিওসিস নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন, কারণ কক্রিডিয়ার ‘উসিস্ট’গুলো প্রচুর পরিমাণে খামারের সর্বত্র ছড়ানো থাকে এবং খুব সহজে বেশি পরিমাণ উসিস্ট অন্য মোরগ মুরগি খেয়ে ফেলে।

রক্ত আমাশয় প্রতিরোধে নিচের ব্যবস্থাপনাগুলো মেনে চলা ভালো:

১। খামার ও পানির পাত্র মোরগ– মুরগির পিঠ বরাবর রাখা, যেন খামার ও পানির পাত্র পায়খানার সংস্পর্শে না আসে।
২। খাবার ও পানির পাত্র নিয়মিত পরিষ্কার রাখা।
৩। আক্রান্ত মোরগ- মুরগির বিষ্টা সরিয়ে ফেলা যেন সুস্থগুলো এ বিষ্টার সংস্পর্শে না আসে।
৪। বাচ্চা মোরগ- মুরগির বয়স্কগুলো থেকে আলাদা রাখা কারণ বয়স্ক মোরগ-মুরগির রোগের বাহক গিসাবে কাজ করে।
৫। লিটার সবসময় শুষ্ক রাখা, মাঝে মাঝে ওলট পালট করা এবং ভিজা লিটার সরিয়ে ফেলা।
৬। খামারের জায়গার তুলনায় অধিক মুরগি পালন না করা।
৭। পুষ্টির ঘাটতি হলে রোগের সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়। এজন্য নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। অতিরিক্ত প্রোটিনযক্তি খাদ্য দেয়া যাবে না। পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন এ ও কে সরবরাহ করতে হবে ।
৭। পুরাতন লিটার সম্পূর্ণ ফেলে না দিয়ে ৫-১০% পুরাতন লিটার নতুন লিটারের সাথে মিশানো।
৮। খাদ্য কক্রিডিওস্ট্যাট ব্যবহার করেন রক্ত আমাশয় নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

লেখক: ডা. এএইচএম সাইদুল হক ।

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/এম