দেশে উন্নত জাতের মুরগি পালনে জনগণের উত্সাহ দিন দিন বেড়ে চলেছে। আর মুরগি পালনের জন্য বাংলাদেশের আবহাওয়াও বেশ উপযোগী। জনগণের উত্সাহের সঙ্গে সঙ্গে সরকারও উন্নত জাতের মুরগি পালনে সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। কেননা, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে আমিষ জাতীয় খাদ্যের ঘাটতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে পুষ্টির অভাবে মানসিক বিকাশ বিঘ্নিত হচ্ছে দেশের অগণিত শিশুর। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, উন্নত বিশ্বে বছরে মাথাপিছু ডিমের প্রাপ্যতা যেখানে ২০০; সেখানে আমাদের দেশে মাত্র ১৫ থেকে ১৬টি। এ ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে প্রত্যেক বসতবাড়িতে উন্নতজাতের মুরগি চাষ অপরিহার্য। উন্নত জাতের একটি মুরগি ছয় মাস বয়সে ডিমপাড়া শুরু করে এবং বছরে ২০০ থেকে ২৫০ ডিম দেয়।
অন্যদিকে ব্রয়লার (মাংস উত্পাদক মুরগি) মুরগি দুই মাসেই দেড় থেকে দুই কেজি মাংস দেয়। বসতবাড়িতে অল্প শ্রম ও কম খরচে মুরগি পুষে পরিবারের প্রোটিন জাতীয় খাদ্যের ঘাটতি সহজেই মেটানো যায়। পারিবারিকভাবে মুরগি পালনের ফলে পরিবারের অল্প বয়স্ক ছেলে-মেয়ে, যুবক-যুবতী এমনকি বুড়ো-বুড়িরাও তাদের অবসর সময়ে কিছু না কিছু কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারেন। আর এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে আপনিও একটি মুরগি নিয়ে এক মোরগের সংসার গড়তে পারেন। এতে আপনি লাভবান হবেন। মাংস ও ডিমের চাহিদা পূরণ হবে। একটি মোরগের সংসার গড়ার আগে অবশ্যই আপনাকে জানতে হবে উন্নত মুরগি চাষের আধুনিক কলা-কৌশল।
থাকার ঘর : একটি মোরগের সংসার গড়তে প্রথমে প্রয়োজন হবে মুরগির ঘর ঠিক করা। মুরগির থাকার ঘর উচ্চতায় চার ফুট, প্রস্থে সাড়ে ৪ ফুট এবং দৈর্ঘ্য ৬ ফুট করুন। এর ভেতরে ডিম পাড়ার খাঁচি, খাবার পাত্র ও পানির পাত্র রাখুন। আরও খেয়াল রাখবেন
(১) ঘর সব সময় শুকনো ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। (২) খোলামেলা স্থানে ঘর বানাবেন (৩) ঘরের মেঝে তিন ইঞ্চি পুরু হয় এ পরিমাণ তুস, কাঠের গুঁড়া বা বালির সঙ্গে আধা কেজি গুঁড়া চূর্ণ ভালোভাবে মিশিয়ে সমানভাবে বিছিয়ে দিন। (৪) মেঝের কাঠের গুঁড়া বা তুস ৭ দিন পরপর ওলট-পালট করে দেবেন। স্যাঁতসঁতে হলে বা জমাট বেধে গেলে তা পরিবর্তন করে দেবেন। ঘরে আটকে না রেখে বাইরেও মুরগি পালন করতে পারেন।
সংগ্রহের স্থান : উন্নত জাতের মুরগি কোথায় পাবেন এ নিয়ে ভাবনার কোনোই কারণ নেই। ঢাকার মণিপুর কেন্দ্রীয় মোরগ-মুরগি খামার থেকে কিংবা কৃষি খামার সড়কের পশুসম্পদ অধিদপ্তরের বিক্রয় কেন্দ্র থেকে উন্নত জাতের মুরগি সংগ্রহ করুন। চট্টগ্রাম এবং রাজশাহী শহরে যারা উন্নত জাতের মুরগি লালন-পালনে আগ্রহী তারা যথাক্রমে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী এবং রাজশাহীর রাজবাড়ী হাট আঞ্চলিক মুরগির খামার থেকে উন্নত জাতের মুরগি সংগ্রহ করতে পারেন। এ ছাড়া সিলেট, বগুড়া, কুমিল্লা, যশোর, কুষ্টিয়া, পাবনা, রংপুর, রাজশাহী, কুড়িগ্রাম, বরিশাল, চুয়াডাঙ্গা, নোয়াখালী, রাঙামাটি, সীতাকুণ্ড, টাঙ্গাইল, ঠাকুরগাঁও, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ফরিদপুর, দিনাজপুর, মাদারীপুর, পটুয়াখালী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, গোপালগঞ্জ আর জামালপুরে সরকারি মুরগি খামার আছে। স্ব-স্ব এলাকার বাসিন্দারা এসব খামার থেকে উন্নত জাতের মুরগি সংগ্রহ করে নিন।
খাদ্য : অধিক ডিম পেতে হলে মুরগিকে দৈনিক সুষম খাবার খেতে দেবেন, প্রত্যহ প্রতিটি মুরগিকে ১১৫ গ্রাম সুষম খাদ্য, পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি ও ২৫ গ্রাম সবুজ শাক-সবজি বা কচি ঘাস কুচি কুচি করে কেটে খেতে দিন। আপনি নিজেই সুষম খাদ্য তৈরি করতে পারেন।
সুষম খাদ্যের উপাদানগুলো নিম্নরূপ : খাদ্য উত্পাদন-গম/ভুট্টা ভাঙা বা চালের খুদ ৪০০ গ্রাম। গমের ভুসি ৫০ গ্রাম। চালের কুঁড়া (তুষ ছাড়া) ২৫০ গ্রাম। তিলের খৈল ১২০ গ্রাম। শুঁটকি মাছের গুঁড়া ১০০ গ্রাম। ঝিনুকের গুঁড়া ৭৫ গ্রাম। সুষম খাদ্য মোট ১,০০০ গ্রাম বা ১ কেজি।
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা : আপনার মুরগিকে সুস্থ রাখতে নিয়মিত টিকা দেয়ার ব্যবস্থা নেবেন। পশুসম্পদ বিভাগ থেকে বিনামূল্যে রানীক্ষেত, কলেরা, বসন্ত রোগের প্রতিষেধক টিকা সংগ্রহ
করতে পারেন। আরেকটু খেয়াল রাখবেন, আপনার মুরগি অসুস্থ হলে সঙ্গে সঙ্গে পশু চিকিত্সালয়ের পরামর্শ নেবেন। অসুস্থ মুরগিকে চিহ্নিত করে তত্ক্ষণাত্ আলাদা করে রাখুন। তা ছাড়া রোগাক্রান্ত মুরগির বিষ্ঠা ও লালা সতর্কতার সঙ্গে সংগ্রহ করে তা মাটিতে পুঁতে রাখার ব্যবস্থা নেবেন।
আয়-ব্যয় : এক মোরগের সংসারের জন্য একটি ঘর (খাবার পাত্রসহ) তৈরি কর বাবদ প্রায় ২ হাজার টাকা খরচ হবে এবং ঘর কয়েক বছর ব্যবহার করা যাবে। ছয় মাস বয়সের ৯টি মুরগি এবং ১টি মোরগের ক্রয়মূল্য ২ হাজার টাকা। ১ বছর পর এ ১০টি মুরগিকে প্রায় একই দামে বিক্রি করা যাবে। ডিম কিনলে ১টির দাম পড়বে ৮ টাকা। মুরগির বাচ্চা কিনলে ১টির দাম পড়বে ৩০ টাকা। ৯টির দাম হবে ২৭০ টাকা। প্রতি মাসে মুরগির খাবার ক্রয় বাবদ প্রায় ৮০০ টাকা ব্যয় হবে। যদি আপনি নিজেই মুরগির সুষম খাবার তৈরি করেন তাহলে খরচ আরও কম হবে। ৯টি মুরগি থেকে প্রতিদিন গড়ে ৬টি ডিম পাওয়া যাবে। ডিম বিক্রি করে প্রতি মাসে গড়ে ১৪৪০ টাকা আয় করতে পারেন। উত্পাদিত ডিম, খাবার এবং বাচ্চা ফুটানোর ডিম হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। আপনার শ্রমে উত্পাদিত ডিমের একটি অংশ দিয়ে যদি বাচ্চা ফুটানো যায়, তাহলে দেশ এবং জাতি বেশ কিছু ফুটফুটে উন্নত জাতের মোরগ-মুরগির বাচ্চা পাবে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/১৩মার্চ২০