যশোরে গাছিদের অভাবে ব্যাহত খেজুরের রস সংগ্রহ

38

‘যশোরের যশ, খেজুরের রস।’ রস-গুড়ের জন্য যশোর বিখ্যাত হলেও যাদের হাত দিয়ে গুড় তৈরির অন্যতম উপাদন সুস্বাদু রস উৎপাদিত হয়, সেই ‘গাছিদের’ (যারা খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করেন) সংখ্যা কমে যাচ্ছে। শীতের ভোরে গাছে ওঠানামা কঠিন পরিশ্রমের বিষয় হওয়ায় নতুনদের কেউ এ পেশায় আসতে আগ্রহী হচ্ছেন না। জেলায় খেজুরগাছের সংখ্যা বাড়লেও পর্যাপ্ত গাছির অভাবে ব্যাহত হচ্ছে খেজুরের রস সংগ্রহ কার্যক্রম। প্রতি মৌসুমে বিপুল পরিমাণ রস সংগ্রহের উপযোগী গাছ থাকছে রস সংগ্রহের আওতার বাইরে। ফলে হারাতে বসেছে জেলার ঐতিহ্য ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস ও গুড় উৎপাদন’।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের তথ্যমতে, বিগত বছরগুলোর তুলনায় বর্তমানে যশোরে খেজুরগাছের সংখ্যা বাড়লেও কমে যাচ্ছে রস ও গুড় উৎপাদন। তাদের হিসাবে, ২০১৯ সালে জেলায় খেজুরগাছের সংখ্যা ছিল ১৬ লাখ ৬২ হাজার ৪৭৫টি, যা কমতে কমতে ২০২৩ সালে দাঁড়ায় ১৬ লাখ ২৫ হাজার ৩৫০টিতে। তবে তাদের ২০২৪ সালের সর্বশেষ হিসেবে গাছের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ লাখ ২৩ হাজার ৪৮০টিতে। অপরদিকে ২০২৩ সালে রস আহরণকারী গাছের সংখ্যা ছিল তিন লাখ ২১ হাজার ৮২৩টি। ২০২৪ সালের হিসেবে রস আহরণকারী গাছের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় তিন লাখ চার হাজার পাঁচটিতে। ২০২৩ সালে গুড় উৎপাদন ছিল তিন হাজার ৬৬৯ মেট্রিক টন। ২০২৪ সালে তা কমে দাঁড়ায় তিন হাজার ৪০ মেট্রিক টনে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সর্বশেষ হিসাবে যশোর জেলায় গাছি রয়েছেন পাঁচ হাজার ১২৫ জন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্যে, এ জেলায় গুড় উৎপাদিত হয়েছে প্রায় শতকোটি টাকার, গড়ে ৩০০ টাকা কেজি ধরে যার বাজারমূল্য ৯১ কোটি ২০ লাখ টাকা।

যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার আজমপুর গ্রামের গাছি (গাছ থেকে খেজুর রস সংগ্রহকারী) সিরাজুল ইসলাম (৬৫) আক্ষেপ করে বলেন, ‘যদি এইরাম এট্টা যন্তর থাইকতো, যা সহজে হাতে কইরে নিয়ে যাইয়ে, সহজে খাজুর গাছে উঠানামা করা যাইতো। তালি (তাহলে), এখন যা রস-গুড় হয়, তার ডবল হইতো।’ গাছি সিরাজুল যখন একথা বলছিলেন, তিনি তখন খেজুরগাছের মাথায় রস সংগ্রহের প্রাথমিক ধাপ পাতা কেটে গাছ পরিষ্কার করছিলেন। প্রায় ৫০ বছর খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করা গাছি সিরাজুল ইসলাম জানালেন, গত বছর শীতের তিন মাসে খেজুর রস ও গুড় বিক্রি করে এবং অন্য মানুষের খেজুরগাছ রস সংগ্রহের উপযোগী করার কাজ করে প্রায় দেড় লাখ টাকা উপার্জন করেছেন। তবে তার ছেলে এ পেশায় আসতে চায় না। কারণ গাছে ওঠা এবং রস নিয়ে নামা বেশ কষ্টের ব্যাপার।

তবে নতুনদের এ পেশায় আসতে না চাওযার কারণ এবং প্রতিকারের পাশাপাশি রস ও গুড় উৎপাদন দ্রুতই দ্বিগুণ করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন এ অঞ্চলের গাছি ও খেজুরগাছ মালিকরা। তারা বলছেন, নারকেল গাছে ওঠার সহজ যন্ত্রের মতো খেজুরগাছে ওঠার জন্য সহজে বহন ও ব্যবহার-উপযোগী কোনো যন্ত্র উদ্ভাবন আবার ফিরিয়ে আনতে পারে খেজুর রস গুড়ের সুদিন। এতে যশোরের পাশাপাশি সারা দেশের খেজুর রস সংগ্রহকারী গাছিরা উপকৃত হবেন। দেশে বাড়বে রস ও গুড় উৎপাদন। উৎপাদন বাড়লে আয় বাড়বে। একই সঙ্গে নতুনরাও উৎসাহী হবেন এ পেশায় আসতে। গত কয়েক দিন যশোর জেলার কয়েকটি উপজেলায় ঘুরে গাছিদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এদিকে গুণগত মান ঠিক রেখে রস-গুড় উৎপাদন বাড়াতে গত কয়েক বছর যশোরে সরকারি-বেসরকারিভাবে গাছিদের গাছ কাটার উপকরণ বিতরণ, গাছি প্রশিক্ষণ, গুড় মেলাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চালানো হয়েছে। তবে তা খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি।

ঝিকরগাছা উপজেলার বড় কুলিগ্রামে বাড়ি গাছি তাইজেল মোড়লের (৭০)। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু রাস্তার পাশের গাছ কাটি। মাঠের মদ্যির গাছ কাটলি লস্। যখন রস আসার সুময় হয়, তখন ইরি ধান করার জন্যি মাঠে পানি ছাইড়ে দেয়। মাঠ কাদা-কাদা হইয়ে যায়। ওই সুময় ঠান্ডাও বেশি পড়ে। ঠান্ডায় কাদা-পায় গাছে ওঠা যায় না, রস পাড়া যায় না। পা পিছলোয় গাছতে পইড়ে বিপদ হইয়ে যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাগের এলাকায় অনেক গাছ পইড়ে থাকে। মাঠে কাদার জন্যি সব গাছেরতে রস আনা যায় না। কিন্তুক মাঠে রোইদ (রোদ) বেশি থাকায় ওইসব গাছে রস বেশি হয়, ভালোও হয়। যদি গাছে ওঠার সহজ ব্যবস্থা থাইকতো তালি সব গাছেরতে রস বাইর করা যাইত।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাগের আমলের (বয়স্ক) লোকজন চইলে গিলি (মারা গেলে) গাছ কাটার লোক পাওয়া কঠিনও হয়ে যাবে।’

যশোরের খাজুরা এলাকার নামকরণ খেজুরগাছের আধিক্যের কারণে বলে জানালেন এ এলাকার কয়েকজন প্রবীণ। এ এলাকার সদর উপজেলার তেজরোল গ্রাম। গ্রামটি খেজুর রস-গুড় উৎপাদনের জন্য সুপরিচিত। এখানে কথা হয় গাছি মান্নান লস্করের সঙ্গে। তিনিও জানালেন, সহজে গাছে উঠে রস পাড়ার জন্য কোনো ব্যবস্থা থাকলে পড়ে থাকা গাছের সংখ্যা অনেক কমত। বাড়ত রস-গুড়ের উৎপাদন।

এ বিষয়ে কথা হয় মনিরামপুর উপজেলার হরিহর নগর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার নিজের প্রায় ৬০টি খেজুরগাছ রয়েছে। তবে গত শীতে গাছির অভাবে প্রায় অর্ধেক গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতে পারিনি।’

এ ব্যাপারে কথা হয় সদর উপজেলার আয়েশা আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী প্রধান শিক্ষক ফজলুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘যদি গাছিদের জন্য সহজে বহন ও সহজে ব্যবহারযোগ্য কোনো যন্ত্র থাকত, তাহলে যেসব গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। বিপুল পরিমাণ সেসব গাছ রস আহরণের আওতায় আসত। এতে রস-গুড় উৎপাদন অনেক বেড়ে যেত।
এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (উদ্যান) প্রতাপ মণ্ডল বলেন, ‘খেজুরগাছে ওঠানামার জন্য দেশে এখনও এমন কোনো যন্ত্র নেই। এমন যন্ত্রের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।’